সিভিক ভলান্টিয়ার ও পুলিশে ক্ষুব্ধ পড়ুয়াদের অবরোধ
৩১ আগস্ট ২০২৪পুলিশ কর্মী ও সিভিক ভলান্টিয়ারের আচরণের প্রতিবাদে অবরোধ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের।
আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের হত্যা ও ধর্ষণের মামলার দ্রুত বিচার চেয়ে আন্দোলনের ঝাঁজ ক্রমশ বাড়ছে। এরই মধ্যে ফের প্রতিবাদে মুখর হলেন শহর কলকাতার আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
নিশানায় সিভিক ভলান্টিয়ার
তরুণী চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের বিচারের দাবিতে শহর থেকে জেলায় নানা কর্মসূচি রোজই দেখা যাচ্ছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা সারারাত পথে প্রতিবাদের অভিনব কর্মসূচি নিয়েছিলেন।
শুক্রবার রাত এগারোটা থেকে শুরু হয় তাদের কর্মসূচি। ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা রাস্তায় অবস্থান করছিলেন। বিটি রোডের উপর এক দিক আটকে পথনাটিকার মাধ্যমেও প্রতিবাদ জানানো হয়।
চারটে অবধি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। রাস্তার খোলা অংশ দিয়ে যান চলাচলে সমস্যা হয়নি। গান, ছবি আঁকা, কবিতা পাঠে প্রতিবাদ যখন শেষের পথে, সেই কাকভোরে সাড়ে তিনটে নাগাদ গন্ডগোল শুরু হয়।
পড়ুয়াদের অভিযোগ, এক সিভিক ভলান্টিয়ার ব্যারিকেড সরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি মত্ত অবস্থায় ছিলেন, ধাক্কা মারেন ব্যারিকেডে। এর তীব্র প্রতিবাদ জানান আন্দোলনকারীরা।
এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও সমাজ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। এর সত্যতা ডিডাব্লিউ যাচাই করেনি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সিভিক ভলান্টিয়ারের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের বচসা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সিভিক আপত্তিকর মন্তব্য করেন। সেই কারণে তাকে ঘেরাও করে রাখা হয়। পুলিশ লেখা একটি বাইকে সওয়ার ছিলেন ওই সিভিক ভলান্টিয়ার।
অভিযুক্ত সিভিক গঙ্গাসাগর গোন্দ ক্ষমা চাইলেও তাকে ছাড়েননি পড়ুয়ারা। তারা পাল্টা বলেন, ক্ষমা করতে করতে আজকের এই পরিস্থিতি হয়েছে! ক্ষমা চেয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না।
পুলিশের হস্তক্ষেপ
বিটি রোডের উপর পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সিভিক ভলান্টিয়ারের সহায়তায় এগিয়ে আসেন এক পুলিশকর্মী। সেই সার্জেন্ট পড়ুয়াদের ঘেরাটোপ সরিয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারকে বেরোনোর সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগ। এতে আন্দোলনকারীরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
সিভিক ভলান্টিয়ারকে মুক্তি দিলেও এবার নিজে আটকে পড়েন সার্জেন্ট তারকেশ্বর পুরি। ভোর চারটের একটু আগে থেকে তাকে ঘেরাও করে রাখেন পড়ুয়ারা। তার চারপাশে গোল করে ঘিরে চলতে থাকে স্লোগান। একই সঙ্গে রাস্তা অবরোধ শুরু করেন ছাত্র-ছাত্রীরা। দাবি, ওই সিভিককে ঘটনাস্থলে হাজির করতে হবে, তবে সার্জেন্ট ছাড়া পাবেন।
পড়ুয়ারা পুলিশকর্মীকে ঘিরে বিচারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের বক্তব্য, এর বিচার চাই। মত্ত অবস্থায় কোনো সাধারণ মানুষ গাড়ি চালালে তাকে কি পুলিশ ছেড়ে দিত? তাহলে কেন সিভিক ভলান্টিয়ারকে ছাড়া হবে?
বিটি রোড উত্তর শহরতলির সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগের অন্যতম প্রধান রাস্তা। উত্তর ২৪ পরগনা শুধু নয়, হাওড়া ও হুগলির বহু মানুষ নদী পেরিয়ে কলকাতায় নিত্যদিন যাতায়াত করেন এই পথে। পড়ুয়াদের অবরোধে ভোর থেকেই যানজট বাড়তে থাকে।
দায়ের এফআইআর
ঘটনাস্থলে আরো পুলিশ আসে, আসেন উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। কিন্তু ঘেরাটোপে থাকা সার্জেন্টকে অব্যাহতি দেননি ছাত্র-ছাত্রীরা। সকাল হতেই সার সার পণ্যবাহী ট্রাক, গণপরিবহনের যান ও ব্যক্তিগত গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। যানজট চলে যায় অনেকটা দূরে শ্যামবাজার পাঁচমাথা পর্যন্ত।
পড়ুয়াদের অভিযোগ, কেন পুলিশ বাইকে সওয়ার হয়ে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার হম্বিতম্বি করবেন? মত্ত অবস্থায় কটূক্তি করবেন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে? অভিযোগ দায়ের না করা পর্যন্ত অবস্থানে অনড় থাকেন পড়ুয়ারা।
অবশেষে সিভিক ও সার্জেন্ট এর নামে থানায় এফআইআর দায়ের হয়। এফআইআরের কপি হাতে পাওয়ার পর সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ অবরোধ তুলে নেন ছাত্র-ছাত্রীরা। সাড়ে চার ঘণ্টা অবরোধ চলে।
সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সার্জেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পরিস্থিতির বদল কবে?
৯ আগস্ট আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর থেকে আন্দোলনকারীদের নিশানায় রয়েছে পুলিশ। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়।
এদের বিরুদ্ধে গুচ্ছগুচ্ছ অভিযোগ তুলে জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন চলছে। রাজনৈতিক দল থেকে বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন তীব্র করে তুলছে প্রতিবাদ। তা সত্ত্বেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের আচরণে বদল হচ্ছে কি?
সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে পুলিশের বাইক ব্যবহার করত। হাসপাতালে আসত মত্ত অবস্থায়। শুক্রবার গভীর রাতে বিটি রোডের ঘটনায় সেই একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে।
সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "তৃণমূল এই সিভিকদের নিয়োগ করে। স্থানীয় স্তরে তৃণমূলের প্রভাবেই এদের দৌরাত্ম্য চলে। থানার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হয় সিভিকভলান্টিয়ারদের। এরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।"
তৃণমূলপন্থি পর্যবেক্ষক ভাস্কর সিংহ রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "কিছু কিছু আন্দোলনজীবী বিশৃংখল পরিস্থিতির তৈরি করছেন। মিথ্যা অভিযোগ করছেন। সিভিক, সার্জেন্টকে আটকে রেখেছিলেন আন্দোলনকারীরা, সেটা কি তারা পারেন?"
আন্দোলনে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার অনির্বাণ সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা তো সিভিককে আটকে রাখতে পারিনি, পুলিশের সহযোগিতায় তিনি বেরিয়ে চলে যান। আমরা তাকে ফিরিয়ে আনতে বলেছিলাম। যেভাবে বাইক নিয়ে এসে ব্যারিকেডে ধাক্কা মেরেছে, তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "যাদের শুধু ট্রাফিক পরিচালনা করার কথা, তারা পুলিশের কাজ করছে। এই ব্যবস্থা চলতে দেয়া যায় না। যে কোনো দলই ক্ষমতায় থাক, রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে সিভিকদের মতো চাকরি যেন না হয়। প্রয়োজনে সব নিয়োগ বাতিল করে, ফের বাছাইয়ের মাধ্যমে যোগদান করানো হোক।''