সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যবস্থা
৩১ অক্টোবর ২০২৪বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ‘‘ঢাকার বড় সাতটি কলেজ দেখভালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই পুরোপুরি আলাদা একটি ব্যবস্থা থাকবে৷’’
তিনি জানান, সেখানে ‘‘আলাদা রেজিস্ট্রারসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন। তবে এ কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তই থাকবে৷’’
উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এই সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, কথা বলেছেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই একটি জায়গা ঠিক করা হবে, যেখানে সাত কলেজের প্রশাসনিক কাজ-কর্মগুলো করা যায়। তাদের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখা হবে, আলাদা রেজিস্ট্রারসহ সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা–কর্মচারী থাকবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
শিক্ষা উপদেষ্টার কথায় অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা ৩ নভেম্বর ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়ে ফের ব্লকেড কর্মসূচি দিয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সরকার মতামত চাইলে তারা মতামত দেবেন। কিন্তু এখনও মতামত চাওয়া হয়নি৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। ২০১৭ সালের ফেব্রয়ারিতে কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এর আগে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত ছিল।
এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অভিযোগ তাদের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো নজর দিচ্ছে না। ফলে তাদের শিক্ষার মান খারাপ। কলেজগুলোতে দক্ষ শিক্ষক ও অবকাঠামোর ঘাটতি আছে। ঠিক সময়ে পরীক্ষা হয় না। আবার পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ করা হয় না। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। তাই তারা ওই সাত কলেজের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে মাঠে নেমেছেন। ২৯ ও ৩০ অক্টোবর এই দুই দিন ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নীলক্ষেত এলাকায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করলেও বৃহস্পতিবার তাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তারা আবার ৩ নভেম্বর তারা অবরোধ করবে। তাদের কর্মসূচির কারণে ঢাকা শহরে ব্যাপক জনদুর্ভোগ হয়। পুলিশের সঙ্গে তাদের বচসাও হয়েছে।
সরকার তাদের দাবির মুখে সাত দিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কলেজ) সভাপতি করে এই কমিটি গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে উচ্চ পর্যারের কমিশন গঠনের দাবি করে। তারা তিন দফা দাবি জানায় সরকারের কাছে। দাবিগুলো হলো: ১. অনতিবিলম্বে সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করতে হবে। ২. এই কমিশন বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই করে ৩০ দিনের মধ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করবে। ৩. স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কোনো সেশনজট তৈরি করা যাবে না। যতদিন বিশ্ববিদ্যালয় গঠন না হবে, ততদিন সেশনজট যেন না হয়, সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সাকিবুর রহমান বলেন, ‘‘আসলে আমাদের নামে মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে৷ কিন্তু কাজে কিছুই হয়নি। আমাদের শিক্ষকরা বিসিএস পাস কলেজেরই শিক্ষক। তাদের পিএইচডি ডিগ্রি নাই। আমাদের কলেজগুলোতে কোনো গবেষণা হয় না। এক শ্রেনিতে আড়াইশ-তিনশ' ছাত্র। ৪০ মিনিটের ক্লাসে ২০ মিনিট যায় রোল কল করতে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হয় কীভাবে?”
তার কথা, "আমাদের কলেজগুলো তো আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুধু একটি প্রশাসনিক ভবন তৈরি এবং শিক্ষক ও জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে আমাদের শিক্ষার মান উন্নত হবে না। এখন যেটা হচ্ছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা না।”
আন্দোলনে ছাত্রদের মুখপত্র জাকারিয়া বারী বলেন, "যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা আমরা মানি না। আমরা চাই কমিশন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে করতে হবে। আর কমিশনে অবশ্যই ছাত্র প্রতিনিধি রাখতে হবে।”
"সাতটি কলেজে দেড় লাখ ছাত্রের জন্য দেড় হাজার শিক্ষক আছেন। এটা দিয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষা চলতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক তো আমাদের কলেজগুলোতে পড়ান না। তারা তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত আছেন। আমাদের সময় দেবেন কীভাবে!” বলেন তিনি।
তার কথা, ‘‘আমাদের কলেজগুলোতে অবকাঠামো নাই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নাই। ঠিক সময়ে পরীক্ষা হয় না। পরীক্ষার জন্য আমাদের আন্দোলন করতে হয়। আবার রেজাল্ট দেয় পরীক্ষার ৮-১০ মাস পরে। স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হলে এই সমস্যা ধীরে ধীরে কেটে যাবে আশা করি।”
‘‘সাতটি কলেজের অবকাঠামো তো আছে৷ ওই কলেজগুলোতে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিগুলো থাকবে। শুধু একটি আলাদা প্রশাসনিক ভবন তৈরি করলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্ভব,” বলেন তিনি।
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে সরকার কী ভাবছে?
কমিটি গঠনের পর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক বিবৃতিতে রাস্তা আটকে জনদুর্ভোগ তৈরি না করে আন্দোলনরত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধরতে ও শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, " রাস্তায় শিক্ষার্থীদের অবরোধ, আন্দোলন ও আলটিমেটামের মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেয়ার কোনো নজির কোথাও নেই।”
তার কথা,"সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি বিবেচনার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে । কমিটি সাত সপ্তাহের মধ্যে দ্রুত একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে।তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
আর ইউজিসির চেয়াম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, "এখন সরকারের গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে। তারপরও সরকার আমাদের কাছে মতামত চাইলে আমরা সব দিক বিবেচনা করে মতামত দেবো। তবে আমার মনে হয়না যে কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার আগে আমাদের মতামত চাইবে। হয়ত কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর মতামত চাইতে পারে।” তিনি প্রতিবেদনের আগে সাত কলেজের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
শিক্ষার মান বনাম স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন," এই সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল অধিভুক্ত করা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আসলে শিক্ষার মান কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ওপর নির্ভর করেনা। এটা নির্ভর করে অবকাঠামো, শিক্ষক, ছাত্রসহ আরো অনেক বিষয়ের ওপর। এখন সাত কলেজের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় করলে সেই মান উন্নত হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের অধিভুক্ত করেছে। তার ফল তো ভালো হয়নি। ”
তার কথা," দেশে তো এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তাই বলে শিক্ষার মান কি বেড়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি পারে এই সাতটি কলেজের মান উন্নয়নে ব্যবস্থা নিক। আবার মন্ত্রণালয়ও মান উন্নয়নে ব্যবস্থা নিতে পারে। আর সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার দরকার আছে কিনা তা-ও ভাবা দরকার।”
আর শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, "আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শিক্ষার মানের কথা বলছে। এটা ভালো। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় করলে তো দেড় লাখ শিক্ষার্থীর একটা বিশ্ববিদ্যালয় হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে চলবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আর এগুলো আন্দোলন করে আদায়ের বিষয় নয়। এগুলো চিন্তা ও বিবেচনাপ্রসুত হওয়া দরকার।”
তার কথা,"বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়ানো যায়নি। এখন তো অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, তাতে শিক্ষার মানের কী হয়েছে? সার্টিফিকেটধারী বাড়লেই মানসম্পন্ন শিক্ষা হয় না। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় পরিকল্পনা।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ৫৫টি পাবলিক এবং ১১৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে।