সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় কোটা সংস্কার আন্দোলন
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বাংলাদেশ৷ দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ কিন্তু সংঘাতময় পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিকেরা৷ তাদের অভিজ্ঞতা নিয়েই এই ছবিঘর৷
হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে
১৬ জুলাই দুপুরে ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের সময় সহকর্মী সমীর কুমার দে সহ যাই লাইভ করতে৷ শুরু হয় গোলাগুলি৷ আমাদের সামনেই একজন পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করছিলেন৷ পাল্টা গুলি ছোঁড়ে পুলিশও৷ আমাদের দিকে ধেয়ে আসে গুলি আর ইট-পাটকেল৷ নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না৷ ইটের একটি টুকরো এসে লাগে আমার বাম পায়ে৷ রক্তক্ষরণ আর প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কাহিল আমি৷ অনেকক্ষণ পর নিজেদের নিরাপদ করতে পেরেছিলাম আমরা৷
সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে
১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা৷ চারদিকে ছিল পুলিশ আর বিজিবি৷ হঠাৎ শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, পাল্টা গুলি ছোঁড়ে পুলিশ ও বিজিবি৷ এমন দৃশ্য দেখা যায় না! আন্দোলনরতদের কয়েকজন মেট্টোরেলে স্টেশনে ভাঙচুর শুরু করে, আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আমি তখন সেখানেই ছিলাম৷ যারা আগুন দিয়েছে, তাদের কাউকে আমার শিক্ষার্থী মনে হয়নি৷ তখন নিজেকে নিরাপদ করা ছিল খুব কঠিন৷
সাজ্জাদ হোসেন, আলোকচিত্রী, বাংলা ট্রিবিউন
১৮ জুলাই সায়েন্স ল্যাবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় ছবি তুলছিলাম৷ ফুটওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় সময় আন্দোলনকারীরা নিচ থেকে ঢিল ছুঁড়ে৷ পায়ে আঘাত পাই৷ দৌড়ে নামার সময় পেছন থেকে রড দিয়ে আঘাত করে৷ ব্যাগ থাকায় আঘাত পাইনি৷ কিন্তু পরে বাঁশ দিয়ে পায়ে আঘাত করে৷ শরীরে কিলঘুষি মারতে থাকে৷ ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ ছবি মুছে দিতে বাধ্য করে৷ সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ছেড়ে দেয় তারা৷
সাজ্জাদ হোসেন, আলোকচিত্রী
১৬ জুলাই ঢাকা কলেজ এলাকায় ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে চলছিল ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া৷ একজনকে মারধর করা হয়৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি৷ তাকে বাঁচানোর এগিয়ে যাই কয়েকজন৷ তাকে একটি ভ্যানে তুলে হাসপাতালে পাঠাই৷ রাতে এক সহকর্মী জানালো মারা গেছেন সেই আন্দোলনকারী৷ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম৷ যদি সেটুকু না পারতাম সারা জীবন নিজের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতাম৷ এখনও মাঝে মাঝে তার চেহারাটা ভেসে উঠে চোখের সামনে৷
নাদিয়া শারমিন, একাত্তর টিভি
১৮ জুলাই দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে সংঘর্ষের সময় পুলিশের দিকে আচমকা তেড়ে আসে আন্দোলনকারীরা৷ পুলিশ গুলি করতে করতে পিছিয়ে যায়, আমরাও পেছাতে থাকি৷ সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী রাশেদ৷ ওইসময় আমার গলার ডানদিকে, বাম বাহু ও ডান পায়ের পাতায় শটগানের ছররা গুলি লাগে৷ চিকিৎসার পর পা ও হাতের দুটি বেরিয়ে গেলেও গলারটি আটকে আছে৷ ভাইটাল নার্ভ থাকায় এখনই অপারেশন সম্ভব নয়৷ এতে প্যারালাইসিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে৷
রাশেদ, একাত্তর টিভি
নাদিয়ার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাপারসন রাশেদেরও গলায় আঘাত করে একটি ছররা গুলি৷ প্রথম দফায় ঢাকা মেডিকেল এবং পরে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তারা৷ রাশেদের গুলিটি বের করে নেয়া সম্ভব হয়েছে৷ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন তিনি এখন বিপদমুক্ত৷
আরিফুর রহমান সবুজ, যমুনা টিভি
১৯ জুলাই সকালে যাত্রাবাড়ী পৌঁছাতেই মুখোমুখি হতে হয় ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার৷ সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানায় আসে আট জনের রক্তাক্ত দেহ৷ তাদের কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে, কারো মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছে ইট দিয়ে৷ তাদের সবাই ছিলেন পুলিশ সদস্য৷ কেউ কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন, কেউ আসছিলেন কাজে৷ আন্দোলনের এই সহিংস রূপে ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র ঘৃণা৷ এমন অভিজ্ঞতা আর কখনও হয়নি৷
খাইরুল ইসলাম বাশার, সকাল সন্ধ্যা
সাত বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন পরিস্থিতিতে খুব কমই পড়তে হয়েছিল আমাকে৷ সংবাদমাধ্যমের উপর কখনো কখনো ক্ষুব্ধ ছিলেন আন্দোলনকারীরা৷ পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছিল আরেক আতঙ্ক৷ অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সংবাদ পাঠানোর সুযোগ ছিল না৷ মোবাইলে ফোন দিয়ে সংবাদ দিতে হয়েছে৷ কারফিউ দেয়ার পর ছিল না গণপরিবহণ৷ সবমিলিয়ে এটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা৷
জুয়েল থিওটোনিয়াস, ডিবিসি নিউজ চ্যানেল
একপেশে সংবাদ প্রচারের অভিযোগে সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয় আন্দোলনকারীরা৷ ১৮ জুলাই আমার নিজের অফিস ঘিরে রেখেছিলেন তারা৷ সেদিন সন্ধ্যা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন আমার সহকর্মীরা, অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন৷ আমি ছিলাম পেশাগত কাজে বাইরে। আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে টিয়ারশেলের ধোঁয়া সহ্য করতে হয়েছে প্রায় সব সংবাদকর্মীকে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমাকেও নিতে হয়েছে ধোঁয়ার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা৷
তানভীর খন্দকার দিপু, ইনডিপেনডেন্ট টিভি, কুমিল্লা
আন্দোলনকে ঘিরে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আমার সাংবাদিকতা জীবনে দেখিনি৷ একদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, অন্যদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান৷ দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি অবরুদ্ধ থাকায় তৈরি হয় জনদুর্ভোগ৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিল অগুণতি গুজবের ছড়াছড়ি৷ ইটপাটকেল, লাঠিচার্জ, গুলি-টিয়ারশেল এড়িয়ে নিজেকে নিরাপদ রেখে ছবি ও সংবাদ সংগ্রহ ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং৷
মাফুজ নান্টু, এনটিভি, কুমিল্লা প্রতিনিধি
১৮ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়িতে পুলিশ-শিক্ষার্থী মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়৷ গুলির খোসা আর ইট-পাটকেল ঢেকে যায় সড়ক৷ পুড়িয়ে দেয়া হয় পুলিশ ও বিজিবির গাড়ি৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিক্ষেপ করা হয় টিয়ারশেল৷ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে আমার৷ পথচারীরা আমাকে উদ্ধার করেন৷ সেদিনের সংঘর্ষে কেউ নিহত হয়নি৷ অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন৷ তাদেরকে নেয়া হয় ঢাকায়৷ আতঙ্কিত ছিল গোটা কুমিল্লা৷