সরকারের বাজেট ঘাটতির চাপ ব্যাংকের সুদের হারে
১৩ এপ্রিল ২০২৪নতুন হার অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তাকে সাড়ে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনতে হবে৷ গত সেপ্টেম্বরেও যে হার ছিল দশ শতাংশের মতো৷ আর গত জুলাইর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া সর্বোচ্চ হার ছিল নয় শতাংশ৷ এর ফলে চিন্তায় পড়েছেন উদ্যোক্তারা৷ কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বা নতুন বিনিয়োগ করতে তাদের খরচ আগের চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে৷ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের জন্যও বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে৷ অন্যদিকে লাভবান হচ্ছেন ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করছেন যারা৷ আমানতের বিপরীতে আগের চেয়ে বেশি হারে তারা সুদ পাচ্ছেন৷
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ করতে না পারার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের সুদহারের উপরে৷ কিন্তু সুদহার বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না৷
‘স্মার্ট হার স্মার্ট নয়, বরং পশ্চাৎপদ’
ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে ২০২০ সালের এপ্রিলে নয়-ছয় সুদহার নীতি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এই নিয়ম অনুসারে ছয় শতাংশের মধ্যে আমানত এবং নয় শতাংশ সুদের মধ্যে ঋণ বিতরণের বাধ্যবাধকতা ছিল ব্যাংকগুলোর জন্য৷ কিন্তু অনেক অর্থনীতিবিদই এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন৷ বিশেষ করে গত বছর মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর প্রকৃত অর্থে ঋণের সুদহার শুন্য বা ঋণাত্মক হয়ে যায়৷ এতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিলাসবহুল পণ্য কেনার সুযোগ তৈরি হয়৷ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারাও ব্যাপকহারে ঋণ নিতে উৎসাহী হন৷ তাতে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়৷
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম হারে সুদ পাওয়ার কারণে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হন৷ যার কারণে ২০২২ সালে ঋণ বিতরণে ১৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হলেও আমানত বাড়ে প্রায় নয় শতাংশ৷
এমন অবস্থায় গত বছরের জুলাইতে সুদ নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার নাম দেয়া হয় ‘স্মার্ট'৷ সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা আগের ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের সুদের হারের গড় দিয়ে এই হার নির্ধারণ করা হয়৷ তার সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক আরেকটি মার্জিন ধরে ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করে, যা এপ্রিলের জন্য ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ৷ গত জুলাইর পর থেকে স্মার্ট হার ক্রমাগত বাড়ছে৷ এ পরিস্থিতিতে আগের মাসগুলোতে মার্জিন সাড়ে তিন শতাংশ থেকে তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ ধরা হলেও এবার তা কমিয়ে তিন শতাংশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন ‘স্মার্ট সুদহার নীতি বাস্তবে মোটেও স্মার্ট নয়’৷ তিনি বলেন, ‘‘এটি হলো পেছনের ছয়মাসের সুদের গড়, যা কিনা ব্যাকওয়ার্ড লুকিং (পশ্চাৎপদ )৷''
তার মতে এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসেই মূলত সরকার বেশি ঋণ করে৷ সরকারের বাজেট খরচের ষাট শতাংশই হবে আগামী দুই-তিন মাসে, যার বড় অংশটাই হবে ব্যাংক থেকে ঋণ করে৷ এতে সুদের হার আরও বেড়ে যাবে৷
বিকল্প নেই সরকারের সামনে
চলতি অর্থবছরের সরকারের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা বা অর্ধেকই দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বেশি৷
এর আগে গত অর্থবছরে সরকার এক লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয় যার বড় অংশই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে যোগান দেয়া হয়৷ কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেই প্রবণতা থেকে এবার সরকার সরে এসেছে৷ নানা শর্তের বেড়াজালে অর্থ সংগ্রহের আরেক উৎস সঞ্চয়পত্রের বিক্রিও কমেছে৷ তাই এবার বিকল্প হিসেবে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ঝুঁকেছে সরকার৷ এমনকি বিভিন্ন খাতের ভর্তুকির তহবিল সংগ্রহেও বিশেষ বন্ডের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ সেই বিল ও বন্ড কিনে সরকারকে অর্থ সরবরাহ করছে ব্যাংকগুলো৷ এদিকে ডলার সংকট, খেলাপি ঋণসহ নানা কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এমনিতেই তারল্য সংকটে ভুগছে৷ ফলে চাহিদার চেয়ে অর্থের যোগান কম থাকায় সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে৷ ড. আহসান মনসুর বলেন, ‘‘ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কম যা দেড় লক্ষ কোটি টাকার মতো৷ সেই টাকা যদি সরকারই নিয়ে নেয় তাহলে বাজারে কী পরিস্থিতি হবে? আর সেটাই হচ্ছে৷''
অর্থাৎ চড়া সুদে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে সরকারকে৷ গত জুলাইতে ট্রেজারি বিলের ছয়মাসের গড় সুদহার যেখানে সাত দশমিক এক শতাংশ ছিল, মার্চে তা দশ শতাংশ ছাড়িয়েছে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন এক্ষেত্রে আর কোনো বিকল্প সরকারের সামনে খোলা নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারকে ব্যাংক থেকে ধার করতেই হবে, কারণ সরকারের সম্পদ কম৷ এতে সুদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷ এখানে কিছু করার উপায় নেই যদি রাজস্ব না বাড়ে, আয়করের আওতা না বাড়ে৷''
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এর তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দুই লাখ ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার রাজস্ব তারা আদায় করেছে, যা গোটা অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৫৫ শতাংশ৷
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‘কর-জিডিপি অনুপাত যেখানে আট শতাংশের মতো, এত কম অর্থ দিয়ে সরকারের পরিচালন ব্যয়, উন্নয়ন ব্যয় ইত্যাদি পরিচালন করা তো সম্ভব না৷ সরকার যদি ঋণ এত না বাড়াতো তাহলে ব্যক্তিখাতের জন্য ঋণ থাকতো, তখন এতবেশি সুদহার করতো না ব্যাংকগুলো৷''
বিনিয়োগে কতটা প্রভাব পড়বে?
এমন অবস্থায় সুদহার বৃদ্ধির বিষয়টিকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা৷ আমানত আকর্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছেও তার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা৷ কিন্তু এর ফলে ব্যবসায়ীদের ঋণ নেয়ার খরচ বাড়ছে, যা বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ ঋণের সুদহারসহ ব্যবসার যেকোন খরচ বৃদ্ধির প্রভাব বিনিয়োগে পড়ে৷ বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ৷ তবে অন্যদিকে যদি সরকার ভর্তুকি দেয় যেমন, গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সুবিধা যদি পাওয়া যায়, ছাড় দেয়া হয় তাহলে অন্ততপক্ষে বিনিয়োগটা বাড়বে৷'' সুদহার বর্তমান পর্যায় থেকে যাতে আর না বাড়ে সেটি নিশ্চিত করার দাবিও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা৷
তবে বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ বৃদ্ধিতে সুদহারকে বড় নিয়ামক বলে মনে করেন না অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন৷ তিনি বলেন, যখন নয়-ছয় সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছিল তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা ছিল এতে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়বে, ব্যবসার খরচ কমবে৷ কিন্তু সেটি হয়নি৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসার খরচ এককভাবে শুধু সুদের হারের উপর নির্ভর করে না, এর সঙ্গে অবকাঠামো প্রতিবন্ধকতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা,ঘুস, দুর্নীতি, মানবসম্পদের দক্ষতা এ সমস্ত নানা বিষয় জড়িত৷ বরং আমরা দেখেছি নয় শতাংশের উপরে যখন সুদের হার ছিল তখন কিছুটা বিনিয়োগ বেড়েছিল৷ তারপরে বরং ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেছে৷ জিডিপির ২৪ শতাংশের মধ্যে আছে৷ এখান থেকে বাড়ছে না৷''
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বড় ব্যবসায়ীদের বর্তমান সুদহারের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার সামর্থ্য থাকা উচিত৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আর সস্তায় টাকা পাওয়ার সময় নেই৷ এটা তাদের মানতেই হবে৷'' ব্যবসায়ীদের দক্ষতা বাড়িয়ে খরচ কমানোয় পরামর্শ দেন তিনি৷ তবে ছোট ও মাঝারি শিল্প যাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন৷ তাদের জন্য আলাদা সুদহার নির্ধারণের পরামর্শ দেন৷
মূল্যস্ফীতি কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না?
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, সুদের হার কম থাকলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, সুদের হার বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে৷ বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে৷ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে নয় দশমিক ৮১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ফেব্রুয়ারিতে নয় দশমিক ৬৭ শতাংশ আর জানুয়ারিতে ছিল নয় দশমিক ৮৬ শতাংশ৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ঘোষণা এবং সুদহার এত বৃদ্ধির পরও কেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না? এর উত্তরে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘‘আমাদের দেশে শুধু মুদ্রানীতি এককভাবে কাজ করবে না যদি না আর্থিকনীতিও একই হয়৷ আমি মুদ্রানীতিতে টাকার সরবরাহ কমাচ্ছি কিন্তু আর্থিক বা রাজস্বনীতি যদি সম্প্রসারণমূলক হয় অর্থাৎ, আমি যদি খরচই করতে থাকি, প্রশাসনিক ব্যয় ও পরিচালন ব্যয় যদি কমাতে না পারি তাহলে তো মুদ্রানীতি এককভাবে কাজ করবে না৷ দ্বিতীয়ত, বাজার তো বাজারের নিয়মে চলে না৷ বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার সমন্বয়ে দাম নির্ধারণ হয়৷ এখন দেখা যাচ্ছে সরবরাহে ঘাটতি নাই, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়৷ সেই কারণে সরবরাহ হঠাৎ কমে যায়৷ তখন দাম বেড়ে যায়৷ সেকারণে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখতে পারছি না৷''
তবে ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন মূল্যস্ফীতির উপরে সুদহার বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব সামনের দিনে দেখা যেতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘এরইমধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কিছুটা বেড়েছে, ডলার ১১৬-১১৭ টাকায় পাওয়া যায় বাজারে৷ এটা এই হারে যদি চলে তাহলে আমার মনে হয় মূল্যস্ফীতি দ্রুতই কমে আসবে৷''
এই তিন অর্থনীতিবিদই মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন৷ রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে চাপ বৃদ্ধি না করে বরং সরকারকে ব্যয় কমনোর পরামর্শ দেন তারা৷ ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে সরকারের অন্তত এক লাখ কোটি টাকার খরচ সাশ্রয় করা প্রয়োজন৷ এজন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে কাটছাঁট করার কথা বলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ৷ তার মতে, ‘‘অনেক আজেবাজে প্রকল্প থাকে যেগুলোর কোনো মানে হয় না নেওয়ার৷ সেখানে ব্যয় কাটছাঁট হতে পারে৷ তাহলে বাজেটের খরচ কিছুটা কমবে৷’’