1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সমাজে কমছে সহিষ্ণুতা, বাড়ছে ধর্মের প্রভাব: মুনতাসীর মামুন

সমীর কুমার দে ঢাকা
২২ এপ্রিল ২০২২

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি অতীতে ভালো ছিল? দিন দিন কি এটা কমছে? ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের পেছনে ইংরেজদের দায়ী করা হয়৷ আসলে তাদের ভূমিকা কতটুকু? রাজনীতি বা সমাজের অসহিষ্ণুতাও এর জন্য দায়ী?

https://p.dw.com/p/4AIQS
ছবি: Tarun Chakraborty Bishnu

এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন লেখক, গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন৷

ডয়চে ভেলে : বলা হয়, ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভালো ছিল৷ বিষয়টি কি আসলে এমন?

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন : আমার মনে হয় বিষয়টি ঠিক নয়৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘদিনের গবেষণার ফলে মনে হয়েছে, আমরা যদি ধর্মের মধ্যে থাকি এবং ধর্মে বিশ্বাসী হই তাহলে অপর ধর্মের প্রতি আমার কিছুতেই আস্থা আসবে না৷

ইংরেজরাই এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করেছে, আপনি কী মনে করেন?

এই বিষয়ে আমার দীর্ঘ গবেষণা আছে তা নয়৷ ইংরেজরা চেষ্টা করেছে বিভেদ আনতে৷ সব শাসকেরাই বিভেদ আনার চেষ্টা করেছেন৷ শুধু ইংরেজরাই এটা করেছে তা নয়৷ আমরা যদি ৫০০-৬০০ বছরের ইতিহাস দেখি, রাজার ধর্ম নির্ভর করেছে সম্পর্কটা কি হবে? রাজা বা সম্রাট যিনিই হোক তিনি সহনশীল হলে সম্পর্ক এক রকম থেকেছে, আবার তিনি যদি সহনশীল না থাকেন তাহলে সম্পর্ক অন্যরকম হয়েছে৷ আমরা যদি ভারতের দিকে দেখি বা অন্য দেশগুলোতে দেখি শাসনক্ষমতায় যিনি থাকেন তার দৃষ্টিভঙ্গিই নির্ভর করে সম্পর্ক কী হবে৷ 

বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বহু নেতিবাচক ঘটনা ঘটছে, এটা কেন?

আমি মনে করি, সব সময়ই ঘটেছে৷ আমি সব সময় বলি, সংখ্যালঘু সব সময় সংখ্যালঘু৷ বাংলাদেশে যারা সংখ্যালঘু তারা সংখ্যালঘু, আবার ভারতে যারা সংখ্যালঘু তারা সংখ্যালঘু৷ পৃথিবীর সব দেশে সংখ্যালঘুদের একই অবস্থা৷ যতই আমরা বলি ইউরোপে সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব আছে, কিন্তু তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক৷ সেটা আমি নিজে গিয়েও দেখেছি৷ বিভিন্ন দেশে এই বিষয়টি হয়েছে৷ আমাদের এখানে এগুলো বেশি করে সামনে আসছে প্রযুক্তির কারণে৷ আগে প্রযুক্তির এত বিস্তার না থাকায় আমরা জানতে পারতাম না৷ কিন্তু কিছু না কিছু ঘটনা সব সময় ঘটেছে এবং এটা ঘটতে থাকবে৷

‘ওয়াজের নামে নারী বিদ্বেষ, ইসলাম বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে’

সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়ার পেছনে রাজনীতি নাকি সমাজের অসহিষ্ণুতা দায়ী?

দু'টোই দায়ী৷ একটা হলো দৃষ্টিভঙ্গি৷ শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় আছেন তিনি জঙ্গি দমন করেছেন৷ জঙ্গিবাদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা জড়িত৷ মৌলবাদকে কিছুটা সীমিত করতে পেরেছেন৷ এবং তার একটা অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি আছে৷ সে জন্য কোন না কোন ক্ষেত্রে বিচার হচ্ছে৷ বা ঘটনাটার দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে৷ আমি যদি আগের আমলগুলো ধরি, তখন তো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই করা হয়েছে৷ তখন কিন্তু আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো কিন্তু আমরা আনি না৷ আমাকে বিএনপি আমলে ২০০১ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ তখন কি খুব সম্প্রীতি ছিল? ছিল না৷ আমরা দ্রুত ভুলে যাই৷ আমার মনে হচ্ছে, সামাজিক সহিষ্ণুতা অনেক কমে যাচ্ছে৷ ধর্মের প্রভাব বাড়ছে৷ এর জন্য অনেকাংশে দায়ী হচ্ছে প্রযুক্তি৷

পশ্চিমা বিশ্বকে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ মনে করি৷ কিন্তু সেখানেও তো অনেক রাজনীতিবিদ ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক কথা বলছেন৷ তাহলে কি বিশ্বব্যাপী এখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পথে?

পাশ্চাত্যে কিন্তু ধর্মের চেয়ে বর্ণ বিদ্বেষটা বেশি৷ ধর্ম তো কাজ করেই৷ মুসলমান হলে সেখানে সবাই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে৷ এটা একেক সময় একেকটা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হয়েছে৷ আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলি, তারা তো আমাদের বিভিন্ন সময় নানা ধরনের পরামর্শ দেয়, তাদের দেশে অবস্থাটা কী? এটা তো ট্রাম্পের আমলে আমরা দেখেছি৷ আমি মনে করি, ইউরোপে খানিক হলেও বর্ণবিদ্বেষ কম৷ ধর্মের ক্ষেত্রে এখনও অনেকটা সহনশীলতা বর্তমান৷ কিন্তু অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ওই ভাবে আমি বলতে পারব কিনা সন্দেহ৷ 

সম্প্রতি আমরা দেখলাম জার্মানিতে ফুটবল ম্যাচ চলাকালে কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ রেখে একজন খেলোয়াড়কে ইফতারের সুযোগ দেওয়া হলো৷ অন্যদিকে সুইডেনে একজন রাজনীতিবিদ কোরআন পোড়ানোর কথা বলছেন৷ ইউরোপে এরকম দুই ধরনের অবস্থা কেন?

এগুলো সবসময় হয়েছে৷ ওই সমস্ত দেশগুলোতে সাধারণত এই ধরনের ঘটনা ঘটে না৷ কিন্তু উগ্র মৌলবাদ এবং উগ্র ধর্মীয়বাদ এখন তো বিকশিত হচ্ছে৷ রাজনীতিবিদরাই কিন্তু এটার জন্য অনেকাংশে দায়ী৷ এই বিষয়গুলো জানা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য ছিল৷ এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে যেভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সব দেশের উচিত ফেসবুক, ইউটিউব যেভাবে বর্ণবিদ্বেষ ছড়াচ্ছে সেটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটার পথ খোঁজা৷ 

তাহলে কি সামাজিক মাধ্যম সম্প্রীতি বিনষ্টের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে?

অনেকাংশে দায়ী৷ আমি এই কথাটা বারবার বলছি৷ আমাদের দেশে এটা নিয়ন্ত্রণের কোন সুযোগ আছে কিনা আমি জানি না৷ এ নিয়ে আমাদের যতটুকু বলা দরকার, লেখা দরকার আমরা করেছি৷ আমাদের সবসময় বলা হচ্ছে, এটা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এটা বন্ধ করে দিতে হবে৷ সবার কাছে মনে হতে পারে, এটা আধুনিকতার বিরোধী কথা৷ কিন্তু যে প্রযুক্তি আমাদের সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে সেটাকে তো আমি রাখতে পারি না৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনি দেখবেন তাদের আদর্শগত বিশাল বাহিনী আছে, তারাই আবার প্রযুক্তির মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ বিষয়টা কিন্তু আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি৷  

বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বেশি দেখা যাচ্ছে৷ হঠাৎ করে কেন এটা বাড়ল?

যে ভারত আমরা দেখেছি, যে ভারত বিকশিত হবে, কিন্তু সেই ভারত এখন আর নেই৷ একটি ধর্মরাজ্যে যদি ভারতকে পরিণত করা হয় তাহলে আশপাশের দেশগুলোতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পড়বে৷ এটা হয়ত ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা সেভাবে বিচার বিশ্লেষণ করছেন না৷ কিন্তু একটা সময় তাদের বিচার করতে হবে৷ ভারত কখনই পুরোপুরি হিন্দুদের রাষ্ট্র হতে পারবে না, তেমনি বাংলাদেশ কখনও পুরোপুরি মুসলিমদের রাষ্ট্র হতে পারবে না৷ আমাদের সহনশীলতার মাধ্যমে বসবাস করতে হবে৷ আমাদের এখানে যখন নির্বাচন সামনে আসে তখন একটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়৷ গত দুই সপ্তাহে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে৷ এগুলো অনেকখানি বাড়বে৷ এখন আমরা যদি সচেতন হই তাহলে অনেকখানি হ্রাস করতে পারব৷ মুন্সিগঞ্জের ক্ষেত্রে আমরা সেখানে গেছি৷ গতকাল শিক্ষক ক্লাসে ফিরেছেন৷ ছাত্ররা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ এভাবেই আমাদের ব্যাপারগুলো হ্যান্ডেল করতে হবে৷  

আমরা কি অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছি?

না, আমরা যা ছিলাম তাই আছি৷ ধর্মের প্রভাব বাড়ছে, সমাজে অসহিষ্ণুতাও বাড়ছে৷ এখন আমরা যদি সহিষ্ণুতা আনতে পারি তাহলে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো হ্রাস পাবে৷ তবে একেবারেই বন্ধ হবে বলে মনে করি না৷  

শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বর্তমানে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এর কারণ কি?

এটা সম্প্রতি, এ কথা ঠিক না৷ আমি প্রথম যেটা বলেছি, কোনো একটি ধর্মে যদি আপনি থাকেন তাহলে একটা পর্যায় পর্যন্ত আপনি অসাম্প্রদায়িক থাকবেন, তারপরে অসাম্প্রদায়িক থাকাটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য৷ সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা কঠিন৷ যারা অত্যন্ত ধর্মভীরু মানুষ তারা অন্য ধর্মকে যে সবসময় সহ্য করতে পারবে সেটাও হয় না৷ ধর্ম যতদুর থাকবে ধর্মীয় বিষয়গুলোও থাকবে৷ এটা একেবারে অস্বীকার করার মানে হয় না৷

দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মারামারি হলেই সেটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বলে মনে করা হয়৷ মানুষের মন আধুনিক না হলে সম্প্রীতি কিভাবে রক্ষা হবে?

আমাদের এখানে আসলে সেভাবে নগরায়িত মন তৈরি হয়নি৷ আপনি যদি কারও কাছে জিজ্ঞেস করেন আপনার দেশ কোথায়? তিনি বলবেন নোয়াখালি বা চট্টগ্রাম৷ বাংলাদেশ বলে না৷ আমাদের এখানে মিডিয়ার একটা অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি আছে৷ আমি একজনকে বলছিলাম, আপনি লিখছেন একটি হিন্দু মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে বা একটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে৷ মুসলমান মেয়েরা কি ধর্ষিত হচ্ছে না? তার চেয়ে বেশি হচ্ছে৷ মিডিয়া কিন্তু বুঝে, না বুঝে এই কাজগুলো করে৷ মারামারি তো মুসলমানে মুসলমানে হয়, সেটাকে আমি কি বলব? সাম্প্রদায়িক বলব না অসাম্প্রদায়িক বলব৷ মারামারি তো মারামারিই৷ হিন্দুদের জমি দখল হচ্ছে, মুসলমানদের জমি দখল হচ্ছে না? আমার জমি তো কয়েকবার দখল হয়েছে৷ মুসলমানেরাই করেছে৷ আপনি কি বলবেন?