শুখা মরশুমে বনসৃজনে পথ দেখাচ্ছে বীজের বল
২০ জুলাই ২০১৯বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ সঙ্কেতের মধ্যে গোটা পৃথিবীতেই সবুজ বাঁচানোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এ নিয়ে সচেতনতা কম৷ সারা বছর ধরে বৃক্ষচ্ছেদন থেকে জলাভূমি ভরাটের মতো বেআইনি কাজ চলতে থাকে৷ এর প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে৷ গাছ কমে এলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়৷ তাই সরকারের তরফ থেকে নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয় সবুজ বাঁচাতে এবং তার বিস্তার ঘটাতে৷ প্রতি বছর জুলাই মাসে পালিত হয় অরণ্য সপ্তাহ৷ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বঙ্গে বর্ষাকাল৷ এই সময় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ার কথা৷ কিন্তু, এবছর উত্তরবঙ্গে বিপুল বৃষ্টিপাত হলেও দক্ষিণবঙ্গ শুকনো৷ কালো মেঘের দেখা নেই, নামমাত্র বৃষ্টি হচ্ছে৷ এরই মধ্যে অরণ্য সপ্তাহ পালন সবুজের অভিযানের আসল উদ্দেশ্যকেই যেন ব্যাহত করছে৷
তবু অরণ্য সপ্তাহ পালনের সরকারি কর্মসূচিতে ভাটা পড়েনি৷ জেলায় জেলায় বিপুল সংখ্যক গাছের চারা বিলি করা হচ্ছে৷ রাজ্যের মুখ্য বনপাল (কেন্দ্রীয় চক্র) সুরেন্দ্রপ্রসাদ যাদব জানান, রাজ্যে এবার দুই কোটি গাছের চারা রোপণ করা হবে৷ এর লক্ষ্য বনভূমির আয়তন বাড়ানো৷ শুধু জনবসতি এলাকায় বৃক্ষরোপণ নয়, বনাঞ্চলে গাছের ঘনত্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ বৃষ্টির অভাবে স্বাভাবিক কৃষিকাজ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, একই সমস্যা হচ্ছে সবুজ বাড়ানোর ক্ষেত্রে৷ বৃষ্টির জলেই চারাগাছ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলি দৃষ্টান্ত হতে পারে৷ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে বৃষ্টি এমনিতেই কম হয়৷ এই জেলাগুলিতে বনসৃজনের ক্ষেত্রে অল্প বৃষ্টির চ্যালেঞ্জ নতুন নয়৷ তারাই বরং রুখাশুখা আবহাওয়ায় বনসৃজনের ক্ষেত্রে পথ দেখাচ্ছে৷
পুরুলিয়ার একটা বড় অংশের ভূমি পাথুরে৷ পাহাড়শ্রেণীতে ঘেরা বহু জনপদ৷ তার উপর বৃষ্টি কম হয়৷ এমন একটি স্থানে কাজে আসছে সিড বল বা বীজ বলের মাধ্যমে বনভূমি বিস্তার৷ কোটশিলা বনভূমির রেঞ্জ অফিসার সোমা দাসের উদ্যোগে এই কাজ চলছে৷ এই বীজ বল আদতে ছোট আকৃতির গোলাকার মাটির তাল৷ তার মধ্যে বীজ ভরা থাকে৷ বিভিন্ন গাছের বীজ ব্যবহার করা হয়৷ কী ভাবে এই বল তৈরি করা হয়, তা সোমা জানিয়েছেন ডয়চে ভেলেকে৷ তিনি বলেন, ‘‘মাটির মধ্যে মিহি বালি ও জৈব সার মেশানো হয়৷ তার সঙ্গে থাকে চারকোল৷ কাঠের গুঁড়োও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেশানো হয়৷ এই মিশ্রণকে ছোট বলের আকার দেওয়া হয়৷ এই এলাকায় যে গাছ হয়, তার বীজ মাটির মধ্যে থাকে৷''
পরিবেশ রক্ষার এই প্রয়াস অর্থনৈতিক ভাবেও স্থানীয় মানুষদের কাছে লাভজনক হয়ে ওঠে৷ কোটশিলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলা সদস্যদের দিয়ে এই বল তৈরি করানো হয়৷ বন দপ্তর তাদের বল তৈরি বরাত দেয়৷ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত কোটশিলায় জাইকা প্রকল্পের অধীন বনভূমি সম্প্রসারণ কর্মী গৌরাঙ্গ দাস গোস্বামী৷ তিনি বলেন, ‘‘স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা কাঁচামাল জোগাড় করে বল তৈরি করেন৷ বনবাসী মানুষের হাতের কাছেই এ সব থাকে৷ মহুয়া, কুসুম, জাম-সহ নানা বীজ দিয়ে বল তৈরি করে তারা বস্তায় ভরে দেন৷ এক একটি বস্তার দাম দেওয়া হয় ৫০০ টাকা৷ কোন বীজ দেওয়া হয়েছে, তার উপর বলের আকার নির্ভর করে৷ এই আকারের উপর নির্ভর করে, একটি সিমেন্টের বস্তায় কতগুলি বল থাকবে৷''
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বীজ বলের সৌজন্যে৷ সোমা বলেন, ‘‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা খেলাচ্ছলে এই বল নিচ্ছে৷ কেউ গুলতি দিয়ে ছুঁড়ছে৷ বল তাদের খেলার সামগ্রী হয়ে উঠছে, আবার তা মাটিতে পড়ে থাকলে সবুজের জন্ম দিচ্ছে৷ এখনও ২৫ হাজারের মতো বল বিলি করা হয়েছে৷''
বন দপ্তরের কর্মীরা বল ছড়াচ্ছেন পাথুরে ভূমিতে৷ পাহাড়ের উপর উঠে যাচ্ছেন তাঁরা৷ সেখানে থেকে ঢাল লক্ষ করে ছুড়ে দিচ্ছেন বীজের বল৷ পাহাড়ের চারপাশের অরণ্য আরও সবুজ হয়ে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে৷ মুখ্য বনপাল (কেন্দ্রীয় চক্র) সুরেন্দ্রপ্রসাদ যাদব বলেন, ‘‘পরিবেশকে রক্ষা করার লক্ষ্যে গাছ লাগানোর থেকে বড় কাজ কিছু নেই৷ প্রকৃতি রক্ষা পেলে মানুষও বাঁচবে৷ বন দপ্তর সেই লক্ষ্যেই অরণ্য সপ্তাহ পালন করে৷ সব শ্রেণীর মানুষকে এই কাজে সামিল হতে হবে৷''