অবরুদ্ধ অবস্থায় বেলা তিনটার দিকে অধ্যক্ষ অসুস্থ ও একপর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতাল ও পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে নেওয়া হয়।
অধ্যক্ষের বড় ভাই আবু নাছের আহম্মেদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নুরুল ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ও বহিরাগত লোকজন কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছিল। পরে ২৭ আগস্ট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, শিক্ষক ও অধ্যক্ষকে নিয়ে সভা করেন বিষয়টির মীমাংসা করে দেন। এরপরেও ২৮ আগস্ট সকালে অধ্যক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে কিছু শিক্ষার্থী তাঁকে বিগত সময়ের কিছু হিসাব বুঝিয়ে দিতে বলেন। অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দেওয়ার এক পর্যায়ে বহিরাগত কিছু লোক তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও টানাহ্যাঁচড়া করতে থাকেন। এক পর্যায়ে নুরুল ইসলাম সেখানে অজ্ঞান হয়ে যান। পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কাকলী হক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই শিক্ষক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে সারা দেশে স্কুল–কলেজের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। তবে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের চেয়ে জোরপূর্বকের ঘটনাই ঘটছে বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পদত্যাগকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের গালিগালাজ, গায়ে হাত দেওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এসব ঘটনার ছবি ও খবর দেখা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে যে ছবি উঠে আসছে একটা দেশের শিক্ষকদের জন্য সেটা নিদারুণ অসম্মানের! এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বলপ্রয়োগ না করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এসব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত কলেজসহ) ৪৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের কারণে গত ১৭ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য (ভিসি), সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করতে শুরু করেন। তাঁরা সবাই বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া।
গত তিন সপ্তায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২৭ জন উপাচার্যসহ কোষাধ্যক্ষ, সহ-উপাচার্য, ডিন, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদ থেকে কয়েকশ শিক্ষকের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। এক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে ৬৯ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরসহ সারা দেশেই একই অবস্থা।
অভিযোগ উঠেছে, বিগত সরকারগুলোর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষস্থানীয় পদে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের দলীয় আনুগত্য রয়েছে। ফলে চাপের মুখে তাদের পদত্যাগ করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ‘অভিভাবকহীন' হয়ে পড়া এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে না।
১৯৭৩ সালের আদেশে চলা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজনের একটি প্যানেল ঠিক করার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি এই প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করবেন। তবে অধিকাংশ সময়ে ক্ষমতাসীনরা নিয়ম না মেনে তাদের পছন্দের লোকদের উপাচার্য বানিয়েছেন। ফলে শেখ হাসিনার পতনের পর এই চার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে পদত্যাগ করেছেন নানা পদে থাকা অন্যরাও।
একইভাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুর করে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদ থেকে শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে হচ্ছে। সবমিলয়ে পদত্যাগের কারণে ৪৫টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকহীন বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি জানান, যত দ্রুত সম্ভব অন্তত প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান সংকটের মধ্যেই গত ২০ আগস্ট ঢাকায় ‘কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার ভাবনা' শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলেছে, সব স্তরে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর ভেতরেই একাডেমিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রশাসনের পদে থাকা শিক্ষকদের সমিতির নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে না রাখার প্রস্তাব করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলেছে, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের তুলনায় বিভাগের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। কেবল মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া থেকে সরে আসতে হবে।
অবশ্য শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘটনা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে তাই নয় বরং স্কুল কলেজেও সেটি ছড়িয়েছে এবং অস্মানের ঘটনাগুলো সেখানেই বেশি ঘটছে। বেশ কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, পদত্যাগের ঘটনাগুলোতে সামনে শিক্ষার্থীদের দেখা যাচ্ছে এবং সবাই ভাবছে এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সম্মান করে না তারা বেয়াদব। কিন্তু নেপথ্যে মূলত স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক পদগুলো দখল করতে শিক্ষকদের আরেকটা অংশই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন। অথচ কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক ও যথাযথ প্রক্রিয়া আছে। তবে সেসবের কোনটাই অনুসরণ করা হচ্ছে না। বরং পদত্যাগ করানোর ঘটনাগুলো স্কুল থেকে স্কুলে ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। কোথাও দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে শিক্ষকদের। সবমিলিয়ে এমন সব ঘটনা ঘটছে যেগুলো এই বাংলাদেশে এর আগে কখনো ঘটেনি।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে,প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে ঢুকে তাকে চেয়ার থেকে নামাতে ও পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করাতে জোরাজুরি করছেন একদল শিক্ষার্থী। এক পর্যায়ে শিক্ষিকা জোরাজুরি করা এক ছাত্রীকে চড় মারেন। তবুও শিক্ষার্থীরা তাকে চেয়ার থেকে নামানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। এ নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা। ঘটনাটি ঘটেছে জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার সালেমা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
শিক্ষকদের এই পদত্যাগ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিও চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই যেমন তিন বছর আগে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের সময় মো. আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী। ধীরে ধীরে এই তকমা গেলেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন করে তাঁকে আওয়ামী লীগের লোক বলে অভিযোগ করছে একটি পক্ষ। অধ্যক্ষ মো. আমান উল্লাহ অভিযোগ করেছেন, পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের পেছনে কলেজের একটি স্বার্থান্বেষী মহলের হাত আছে।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ সরকারি কলেজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে কলেজটির অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করেন অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ মাসুদুল হকের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রতিবাদে আবার আরেকদল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে অধ্যক্ষ মাসুদুল হককে কলেজে ফিরিয়ে আনা হয়।
নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাছলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে তুলেছেন স্থানীয় একদল লোক। তাতে যুক্ত হয়েছেন স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীও। তায়জুল ইসলাম অভিযোগ করে বলছেন, "২৬ বছর আগে আমি নিজের জায়গা দিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কিছু লোক সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। তাদের অভিযোগের তদন্ত হোক, প্রমাণিত হলে আমি স্বেচ্ছায় চলে যাবো।”
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের ঘটনা নিয়ে আবার পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন চলছে। ওই শিক্ষকের বিপক্ষে এখন ছাত্ররা আর পক্ষে ছাত্রীরা। তারা পাল্টা-পাল্টি বিক্ষোভ করেছেন। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় দুই ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে জোরপূর্বক এক উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগের খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আনোয়ার হাবিবের দপ্তরে পদত্যাগপত্র লিখে নিয়ে যান একদল শিক্ষার্থী। পরে সেটিতে আনোয়ার হাবিবের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে যান আনোয়ার হাবিব। দেশের বিভিন্নস্থানে অনেক নারী শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে। সবমিলিয়ে আতঙ্কে আছেন হিন্দু শিক্ষকরা।
তবে অনেক জায়গায় শিক্ষকদের হয়রানি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। এই যেমন সুনামগঞ্জের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলা, হেনস্থা, জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করাসহ লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ২৮ আগস্ট মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। কর্মসূচিতে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে শিক্ষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে সারা দেশে শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
ওই সভায় অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সুনামগঞ্জের অন্যতম সমন্বয়ক ইমন দোজা বলেন, "সারাদেশে শিক্ষকদের হেনস্থা ও হয়রানি করা হচ্ছে। কোনো শিক্ষক যদি স্বৈরাচারের দোসরও হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন আছে। কোনোভাবেই একজন শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা যাবে না। কিন্তু আমরা দেখছি জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে, গায়ে হাত তোলা হচ্ছে। গাছের সঙ্গে বেঁধে, জুতার মালা পড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা ভুলে যাচ্ছি। কোনোভাবেই কোনো শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে না পারে এজন্য আমরা শিক্ষকদের পক্ষে আছি।”
সারাদেশে চলমান এই সংকটের সমাধানে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত ২৫ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম বিধি অনুযায়ী পদায়ন ও বদলি করা হয়। তাঁদের বলপূর্বক পদত্যাগের সুযোগ নেই। বরং শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না। শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সম্পর্ক শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরি। সেখানে অনভিপ্রেত ও অনাকঙ্ক্ষিত কিছু ঘটুক, আমরা চাই না। এ ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটিই কাম্য।
উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়টি তদারকি এবং প্রয়োজনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে জানাতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে পাঠানো ওই অফিস আদেশে আরো বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ের প্রধান বা অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের পদত্যাগ বা অপসারণের দাবিতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও শিক্ষকেরা ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই অবস্থা মোটেও কাম্য নয়।
এতে বলা হয়, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের উন্নতির জন্য দেশের জনপ্রশাসন সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সার্বিক পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়টি তদারকি ও প্রয়োজনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগকে অবহিত করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে কেবলমাত্র সরকারি আদেশেই পরিস্থিতি বদলাবে এমনটা আশা করা যায় না। এক্ষেত্রে অভিভাবক থেকে শুরু করে স্থানীয় নাগরিক সমাজসহ সবার ভূমিকা এখন জরুরি। এ প্রসঙ্গে মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীর ও মৌলভীর সেই গল্পটা বলতেই হয়।
বাদশাহ আলমগীগের ছেলেকে পড়াতেন দিল্লীর এক মৌলভী। একদিন বাদশাহ দেখেন ওই শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে তার পুত্র। এই দৃশ্য দেখে মৌলভীকে দরবারে ডেকে পাঠালেন বাদশা। মৌলভী তো ভয়ে অস্থির। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাদশা বললেন, ছেলেকে সৌজন্য তো কিছু শেখাননি। সেদিন দেখলাম পুত্র আপনার পায়ে শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছে। নিজ হাতে ধুইয়ে দিচ্ছে না। এই দৃশ্য দেখে বাদশাহ মনে ব্যথা পেয়েছেন সেকথাও বললেন।
কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা' কবিতায় পুরো বিষয়টি যেমনটি উঠে এসেছে-‘বাদশাহ্ কহেন, ``সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে/নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,/পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।/নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে/ধুয়ে দিল না`ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।``/উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে/কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-/``আজ হতে চির-উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির…