লাগাতার শিক্ষক-নির্যাতন, জোরপূর্বক পদত্যাগ ও নিন্দা-বিবৃতি
৩০ আগস্ট ২০২৪অনেক শিক্ষক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ অনেক শিক্ষককে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে৷
শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত রবিবার বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্বরতদের জোর করে পদত্যাগ করানোর সুযোগ নেই৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কারো বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে৷ জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে৷ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে অসুবিধা হবে৷ একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে অপমানিত করা যাবে না৷
নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাছলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় কিছু লোকজন৷ গত মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা চত্বরে ওই শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করা হয়৷ স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীও সেখানে ছিল৷ পরে এলাকার ছয়জনের স্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তার কাছে জমা দেন৷
অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলাম আত্মীয়করণ করে স্কুল পরিচালনা করে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন৷ তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ করে তারা৷ উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানা কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এলাকার লোকজন আমার কাছে এসে একটা অভিযোগ জমা দিয়েছেন৷ অভিযোগগুলো তদন্ত করা হবে৷ পরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তদন্ত ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না৷ তাদের দাবি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক বজলুর রহমান ঠাকুরকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আপাতত এক মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে প্রধান শিক্ষককে৷”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে লেগেছে৷ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে৷ অথচ আমি নিজে জায়গা দিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি৷ এক একর ২৫ শতাংশ জমি আমি বিনা পয়সায় স্কুলকে লিখে দিয়েছি৷ আমি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক৷ ২২ বছর ধরে আমি এখানে আছি৷ আমার চাকরির আর দুই থেকে আড়াই বছর বাকি আছে৷ আমি চাই তাদের অভিযোগের তদন্ত হোক, প্রমাণিত হলে আমি স্বেচ্ছায় চলে যাবো৷ নিয়োগ বাণিজ্যসহ যতগুলো অভিযোগ করা হয়েছে- সবগুলো মিথ্যা৷ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে এই সুযোগে কাজে লাগাতে চাইছেন কিছু মানুষ৷”
একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করেন অন্তত ৪০ জন৷ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তারা অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করেন৷ এ ঘটনা গত ২২ আগস্টের৷ পরে অধ্যক্ষ মাসুদুল হকের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷ এর প্রতিবাদে পরদিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা শহরের বিজয় চত্বরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন৷ পরে তারা অধ্যক্ষ মাসুদুল হককে কলেজে ফিরিয়ে আনেন৷ ২০২১ সালের আগস্টে মাসুদুল হক বীরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি মাসুদুল হক কবি, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হিসেবে পরিচিত৷
ব্যক্তিজীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলেন না মন্তব্য করে মাসুদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে শেখার জায়গা৷ কোনো শিক্ষক যদি কলেজে অনিয়মিত হন, শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান না করেন, সে বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হলাম৷ আমার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা বলুন, আমি এখান থেকে চলে যাবো৷ কিন্তু শিক্ষার্থীদের দিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলা কেন? কতিপয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এ রকম একটি ঘটনার জন্ম দিলো৷”
শুধু এই দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এমন অসংখ্য ঘটনা নিয়মিত ঘটছে৷ এ সম্পর্কে এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা অবশ্যই কোনো ভালো বিষয় না৷ শিক্ষকদের জায়গা তো মর্যাদার৷ সেটাই যদি না থাকে তাহলে শিক্ষা কিভাবে এগুবে? আগে তো আমরা এমন পরিস্থিতি দেখিনি৷ এবারই দেখছি, শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এর ফল কোনোভাবেই ভালো হবে না৷”
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকও মনে করেন, যেটা হচ্ছে, ভালো হচ্ছে না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আসলে গত ১৫ বছরে সবকিছুতেই অবক্ষয় হয়েছে৷ শিক্ষকরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন৷ ফলে তাদের উপরও দলীয় রাজনীতির একটা প্রভাব পড়েছে৷ এর ফলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে৷ কারিকুলাম পরিবর্তনের নামে শিক্ষাকে নিয়ে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া হয়েছে, যা ভালো হয়নি৷ শিক্ষকদের পদত্যাগের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা দ্রুতই বন্ধ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি৷”
শুধু পদত্যাগ নয়, অনেক জায়গায় শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে অপমান করা হচ্ছে৷ ঢাকার সরকারি আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক গীতাঞ্জলি বড়ুয়াকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে৷ পরে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন বহু শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও মিলেছে৷
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় ছাত্র পরিষদ৷ এক বিবৃতিতে সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক এলাহান কবীর বলেন, "ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালীরা জোরপূর্বক শিক্ষকদের পদত্যাগ করাচ্ছেন৷ বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক৷ আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷ দেশে আইন-আদালত বিদ্যমান আছে৷ যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে৷ কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে কাউকে পদত্যাগ করানো কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়৷”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনরতদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, নারী প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শারীরিকভাবে হেনস্তা ও বল প্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো ও অপদস্থ করার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)৷ একইসাথে দেশে বিরাজমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি৷ গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সংগঠনগুলো কী করছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইউনিভাসির্টি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ওবায়দুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা মূলত কারিকুলাম নিয়ে কথা বলছি৷ বিগত সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে৷ আমরা সেটা পূর্ণগঠন করতে বলছি৷ আর শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় আমরা একটা বিবৃতি দিয়েছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে কথা বলেছি৷ আমরা এভাবে পদত্যাগকে সমর্থন করি না৷ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটার বিচার হতে পারে৷”
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষকদের অপমান এবং হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি৷ কমিটির পক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, "সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ বা উপাচার্যকে শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে৷ জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছে না৷ এই হেনস্তা থেকে নারী শিক্ষকরাও রেহাই পাচ্ছেন না৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করা হচ্ছে৷ সারা দেশে সৃষ্ট এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাসমূহে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীরভাবে লজ্জিত, দুঃখিত এবং উদ্বিগ্ন৷ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি মনে করে, এসব ঘটনা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠদান প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলবে৷
বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য জোটের সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা এইসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছি৷ তবে এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৫ বছর যেভাবে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে তার রেশ কিছু পড়বেই৷ এখনো তো স্কুল-কলেজের গর্ভনিং বডির সদস্য যারা আছেন তারা তো আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ করা৷ সরকার এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সভাপতি পদ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দিয়েছে৷ অন্যরা তো আছে৷ যা হচ্ছে সেটা তো তারাই করছেন৷ আর শিক্ষার্থীরা যদি ক্ষোভ থেকে কিছু করে সেটা আপনি ঠেকাবেন কিভাবে? আমরা সারাদেশে সবাই বলেছি, এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে৷”