ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যখন ব্রেক্সিট-পরবর্তী বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ব্রাসেলসের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে ব্যস্ত, তখনই ব্রিটিশ সংসদের উচ্চ কক্ষ বিপুল ভোটে তাঁর বিতর্কিত আইনের খসড়ার বিরুদ্ধে রায় দিলো৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে জনসনের সরকার যে আইনের খসড়া পেশ করেছে, তার তীব্র বিরোধিতা করলেন হাউস অফ লর্ডসের সদস্যরা৷ তবে উচ্চ কক্ষের ক্ষমতা প্রতীকি হওয়ায় আইন কার্যকর হওয়ার পথে কিছুটা বিলম্ব ঘটলেও কোনো বাধা সৃষ্টি করা যাবে না৷ নিম্ন কক্ষ এর আগেই অভ্যন্তরীণ বাজার সংক্রান্ত এই আইনের খসড়া পাস করেছে৷
এদিকে ভবিষ্যৎ বাণিজ্য চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ থাকায় বোঝাপড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে৷ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন গত শুক্রবার ইইউ-র মনোভাব সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করার পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয় নি৷ সংলাপের পূর্বশত হিসেবে ব্রিটেন আগেই ছাড়ের দাবি করছে৷ জনসনের দাবি, শুধু ব্রিটেন নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও আপোশ করতে হবে৷ এমনটা স্বীকার করলেই তিনি আলোচনার জন্য সবুজ সঙ্কেত দেবেন৷ অন্যদিকে ইইউ-র প্রধান মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট না করে চুক্তির লক্ষ্যে আবার আলোচনা শুরু করার ডাক দিয়েছেন৷ ব্রিটেনের প্রতিনিধি ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর তিনি এই মন্তব্য করেন৷
ইইউ ব্রিটেনের সর্বশেষ দাবি মনে নিতে প্রস্তুত নয়৷ লন্ডনের দাবি মেনে আইনের খসড়া ও সংলাপের কাঠামো নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হলেও ন্যায্য প্রতিযোগিতার পরিবেশ ও মাছ ধরার অধিকারের মতো বিষয় উপেক্ষা করছে না ব্রাসেলস৷
১লা জানুয়ারি ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হবার পর অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্তরে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা বার বার তুলে ধরেছে জনসনের সরকার৷ মঙ্গলবার সেই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পঞ্চম দফার আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালিয়েছে৷ দুই পক্ষই বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশ করেছে৷ কোনো সময়সীমা স্থির না হলেও ব্রিটেন দ্রুত বোঝাপড়ার আশা করছে৷ মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইটহাইজার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, প্রায় ৩০টি দল লাগাতার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে৷ উল্লেখ্য, খাদ্যপণ্যের মান ও ব্রিটেনের স্বাস্থ্য পরিষেবা কাঠামোয় অংশগ্রহণ সম্পর্কে ব্রিটেনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে৷ অন্যদিকে জনসন সরকারের বিতর্কিত আইনের খসড়ার কারণে উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি বিপন্ন হলে দলমতনির্বিশেষে ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিরোধিতা জোরালো হয়ে উঠবে বলে আগাম পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে৷
এসবি/কেএম (এএফপি, রয়টার্স)
গতবছরের জুলাইয়ের ছবিঘরটি দেখুন...
-
বরিস জনসনের পথচলা
জন্ম পরিচয়
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
বেড়ে ওঠা
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
পড়াশোনা
কিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
-
বরিস জনসনের পথচলা
সাংবাদিকতা
ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
রাজনীতি
টেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
বিতর্ক
টেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
-
বরিস জনসনের পথচলা
ব্রেক্সিটের মুখ
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
পরিবার
জনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
-
বরিস জনসনের পথচলা
লেখালেখি
প্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
-
বরিস জনসনের পথচলা
ব্যাপক জনপ্রিয়তা
বাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷