গত ৯ নভেম্বর যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘সংসদ ভেঙে দিন অথবা সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় করুন৷ সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দিতে হবে, উঁচু-নিচু মাঠে খেলা হয় না৷''
পরবর্তীতে সাবেক এই বিএনপি নেতা তাঁর দল ও জোট নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেন৷ সমঝোতা হবার পরও তিনি একই ধারণায় বিশ্বাস করেন কিনা তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে৷
সে যাই হোক, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়েছে কিনা তা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত প্রতিদিনেরই বিবেচ্য বিষয়৷ এই বিরাট দায়টি পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের৷ বিশেষ করে তফসিল ঘোষণার পর ভূমি সমতল করার কাজে নির্বাহী বিভাগ কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা দিতে বাধ্য৷
কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর গোড়াতেই কিছুটা গলদ দেখা গেল৷ দলের মনোয়ন ফরম সংগ্রহের সময় সরকারি দল আওয়ামী লীগ যতটা শোডাউন করলো, ততটা করতে পারেনি বিএনপি৷ তারা দু-তিন দিন দেরিতে শুরু করার পর কমিশন পুলিশকে চিঠি দিয়ে তা আচরণবিধির মধ্যে রেখে নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ করলো৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
চাঁদা দেয়া যাবে না
কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষ থেকে অন্য কেউ নির্বাচনের আগে উক্ত প্রার্থীর নির্বাচনি এলাকায় বসবাসকারী কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা উক্ত এলাকা বা অন্যত্র অবস্থিত কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো চাঁদা বা অনুদান দেয়া বা দেয়ার অঙ্গীকার করতে পারবেন না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন চলবে না
নির্বাচনপূর্ব সময়ে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব বা উন্নয়ন তহবিলভুক্ত কোনো প্রকল্পের অনুমোদন, ঘোষণা বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা ফলক উন্মোচন করা যাবে না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
পোস্টারের আকার
সাদা-কালো রংয়ের ও আয়তন অনধিক ৬০X৪৫ সেন্টিমিটার এবং ব্যানার সাদা-কালো রংয়ের ও আয়তন অনধিক ৩X১ মিটার হতে হবে এবং পোস্টারে বা ব্যানারে প্রার্থী তাঁর প্রতীক ও নিজের ছবি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির ছবি বা প্রতীক ছাপাতে পারবেন না৷ তবে প্রার্থী কোনো নিবন্ধিত দলের মনোনীত হলে সেক্ষেত্রে তিনি কেবল তাঁর বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি পোস্টারে ছাপাতে পারবেন৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
যেখানে পোস্টার লাগানো যাবে না
কোনো প্রার্থী কিংবা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকায় অবস্থিত দালান, দেয়াল, গাছ, বেড়া, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি, সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের স্থাপনাসমূহ এবং বাস, ট্রাক, ট্রেন, স্টিমার, লঞ্চ, রিক্সা কিংবা অন্য কোনো প্রকার যানবাহনে পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল লাগাতে পারবেন না৷ তবে দেশের যে কোনো স্থানে এসব ঝুলানো বা টাঙানো যাবে৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
অন্যের পোস্টারে নয়
কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদির উপর অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার, লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি লাগানো যাবে না এবং উক্ত পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিলের কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন তথা বিকৃতি বা বিনষ্ট করা যাবে না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
হেলিকপ্টার নয়
কোনো দল বা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি ট্রাক, বাস, মোটর সাইকেল, নৌযান, ট্রেন কিংবা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহন নিয়ে মিছিল বের করতে পারবেন না কিংবা কোনো শোডাউন করতে পারবেন না৷ প্রচারণাকাজে হেলিকপ্টার বা অন্য কোনো আকাশযান ব্যবহার করা যাবে না৷ তবে দলীয় প্রধানরা যাতায়াতের জন্য তা ব্যবহার করতে পারবেন৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
ভয় দেখানো চলবে না
কোনো দল বা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবে৷ তবে প্রতিপক্ষের সভা, শোভাযাত্রা এবং অন্যান্য প্রচারাভিযান পন্ড বা তাতে বাধা প্রদান বা ভীতিসঞ্চারমূলক কিছু করতে পারবে না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
দেয়াললিখন নয়
দেয়ালে লিখে প্রচারণা চালানো যাবে না৷ কালি বা রং দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দেয়াল ছাড়াও কোনো দালান, থাম, বাড়ি বা ঘরের ছাদ, সেতু, সড়কদ্বীপ, রোড ডিভাইডার, যানবাহন বা অন্য কোনো স্থাপনায় প্রচারণামূলক কোনো লিখন বা অংকন করা যাবে না৷ প্রতীক হিসাবে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার করা যাবে না৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
খাবার দেয়া যাবে না
নির্বাচনি ক্যাম্পে ভোটারদের কোনোরকম কোমল পানীয় বা খাদ্য পরিবেশন বা কোনো উপঢৌকন দেয়া যাবে না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
মসজিদ, মন্দিরে নয়
মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে কোনো নির্বাচনি প্রচারণা চালানো যাবে না৷ প্রচারণার সময় ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে বক্তব্য দেয়া বা কোনো ধরনের তিক্ত বা উসকানিমূলক বা মানহানিকর কিংবা লিঙ্গবৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক বা ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এমন বক্তব্য দেয়া যাবে না৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
মাইক ব্যবহারের নিয়ম
নির্বাচনি এলাকায় মাইক বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী কোনো যন্ত্রের ব্যবহার দুপুর দুইটা থেকে রাত আটটার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে৷
-
নির্বাচনি প্রচারণার কয়েকটি নীতিমালা
নিয়ম না মানলে
কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো নিয়ম ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ দলের ক্ষেত্রেও এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে৷
অমনি বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ল বিএনপির নেতাকর্মীরা৷ যার পরিণতি সহিংস রূপ নিলো৷ বিএনপির দাবি, পুলিশ তাদের কর্মীদের ওপর গাড়ি তুলে দিয়েছে৷ পুলিশ দাবি করেছে, রাস্তার একটি পাশ অন্তত খালি রাখার চেষ্টা করছিলো তারা৷
তবে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর বা আগুনে পোড়ানো বা লাঠিসোটা নিয়ে শোডাউন করা, মোটেই কাম্য ছিল না৷ যতই বিএনপি দাবি করুক যে বাইরে থেকে লোকজন এসে পুলিশের গাড়িতে আগুন দিয়েছে, দায় তাদেরই নিতে হবে৷ কিন্তু ঘটনার দায় নির্বাচন কমিশনকেও নিতে হবে৷ কারণ, যখন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফর্ম বিতরণ শুরু হয়েছে পুলিশকে চিঠি পাঠালে তার আগেই পাঠানো উচিত ছিল৷
এমনিতেই আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল অংশ না নেয়ায় প্রকৃত অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, দলীয় সরকারের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর এবারই প্রথম হচ্ছে৷
প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী বহাল থাকছেন স্বপদে৷ সংসদ বহাল থাকায় সরকারি অনেক প্রার্থী সংসদ সদস্য থেকেই নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে পারছেন৷ এ অবস্থায় বিরোধী শিবিরে আশঙ্কা আছে, বা থাকবে এটাই স্বাভাবিক৷
বিশেষ করে বিএনপি নেত্রী কারাগারে অন্তরীণ থাকায়, তাদের মধ্যে অবিশ্বাস বেশি৷ তারওপর বিরোধী দলের নেতাকর্মী অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা আছে৷ নতুন করে দেয়া হয়েছে৷
যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে
ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক মামলাগুলোর তালিকায় দেয়া হলে তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যা অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছিলেন সবাই৷ কিন্তু বিএনপি অভিযোগ করে বলেছে যে, এরপরও মামলা দেয়া থামেনি৷ তারা কমিশনে পরবর্তীতে মামলার তালিকাও জমা দিয়েছে৷ তাই মাঠ সমতল করার ক্ষেত্রে কমিশনকে অনেক বেশি তৎপর থাকতে হবে৷ আর সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও অনেক বেশি সহনশীল হতে হবে৷
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷ সরকারের নয়৷ এই কথাটিও সঠিক নয়৷ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং সরকারের৷ সরকার যদি কমিশনকে সহযোগিতা না করে, তাহলে সম্ভব নয়৷
এরই মধ্যে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে পুলিশের বাড়তি তৎপরতায় প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে৷ মাঠ পর্যায়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুষ্ঠুভাবে নির্ভয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে৷
একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমকে সরকারি দলের প্রচারে ব্যবহার করা ঠিক হবে না৷ সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরতে পারে আওয়ামী লীগ৷ কিন্তু তার অন্যান্য উপায় আছে৷ নির্বাচনের সময়ে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ব্যবহার করে তা করা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির সঙ্গে আইনগতভাবে সাংঘর্ষিক কি না তা বিবেচনা করে দেখা দরকার৷
যুবায়ের আহমেদের লেখা আপনাদের কেমন লাগলো লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷