1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যুক্তরাষ্ট্রে গোলাপের ৯ বাড়ি, হাইকোর্টের তদন্তের নির্দেশ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপের যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ লাখ ডলারের ৯টি বাড়ি থাকার অভিযোগ দুদককে তদন্ত করতে বলেছেন হাইকোর্ট। ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের এক রিটের প্রেক্ষিতে সোমবার এই আদেশ দেয়া হয়।

https://p.dw.com/p/4O2ec
Bangladesch Büro der Anti-Korruptions Kommission
ছবি: bdnews24.com

হাইকোর্টের বিচারপতি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ আগামী চার মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে দুদককে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।

রিটে আবদুস সোবহান গোলাপ নামে পরিচিত মো. আবদুস সোবহান মিয়া এবং স্বরাষ্ট্র সচিব, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকেও বিবাদী করেছেন ব্যারিস্টার সুমন৷

দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, "হাইকোর্টের নির্দেশের কারণে এটা আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করবো। তবে তদন্তে কতদিন লাগবে তা বলা যায় না।”

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, " অর্থ পাচারের  একাধিক ঘটনায় হাইকোর্টের বার বার নির্দেশনা প্রমাণ করে যে, অর্থ পাচারের বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু এইসব ব্যাপারে দুদকসহ অন্যান্য সংস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না।”

যুক্তরাষ্ট্রে আবদুস সোবহান গোলাপের বাড়ির তথ্য বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে  বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট' বা ওসিসিআরপির বরাত দিয়ে প্রথমে প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে মোট ৯টি বাড়ির মালিক হন। এসব সম্পত্তির  মূল্য ৪০ লাখ ডলারের চেয়েও বেশি।

২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পাঁচটি কনডোমিনিয়াম কেনেন আবদুস সোবহান গোলাপ। সে সময় ওই সম্পত্তির মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ ডলার। এছাড়া তিনি আশপাশে ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার মূল্যের তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। ওইসব সম্পত্তি নগদ অর্থে কেনা। সম্পত্তি কেনা হয় তার স্ত্রী গুলশান আরার নামে।

আবদুস মোবহান গোলাপ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মাদারীপুর-৩ (কালকীনি ও মাদারীপুর সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আবদুস সোবহান গোলাপ নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আরো একটি কেনেন। যার তখনকার মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ ডলার। ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। এর সাত মাস আগে বাংলাদেশে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত: ড. ইফতেখারুজ্জামান

আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সস্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদও পান। এক সময় দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন গোলাপ।  সোমবার তার যুক্তরাষ্ট্রের বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি একটি জনসভায় আছেন জানিয়ে পরে ফোন করতে বলেন। এরপর আর ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এর আগে ৪৫৯ জনের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ

গত জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ কেনার অভিযোগের বিষয়ে ৩০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান করতে দুদকসহ চার সংস্থাকে নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়নি দুদক

গত ১১ জানুয়ারি একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির এক হাজারের মতো সম্পত্তি আছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ওই ৪৫৯ বাংলাদেশি।

২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে বলে সেখানে দাবি করা হয়, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ইউএস ডলার।

গত ৯ জানুয়ারি হাাইকোর্টের ওই বেঞ্চ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি থাকার বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন।

দেড় বছর আগে দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে সেখানে যারা সম্পদ গড়ে তুলেছেন তাদের একটি তালিকা দুদকের কাছে চায় হাইকোর্ট। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি  এরকম মোট ৬৭ জনের তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক।  তবে ওই তালিকায় বিস্তারিত তথ্য না থাকায় আদালত তখন অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর আগেও আদালতের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ২৯ ব্যক্তি ও ১৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়।

১৫ জানুয়ারি একটি বাংলা দৈনিকের খবরে বলা হয়, লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ি কেনায় বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে আছে। খবরে বলা হয়, প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশি এখন ৪০ শতাংশ। তাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরা।

দুদকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান সেল্ফ স্টার্ট নেয় না, ধাক্কা দিতে হয়: ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টনস এই তথ্য জানিয়েছে। তারা বলছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ওই এলাকায় ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশিরা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায়  এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে দুদক কোনো তদন্ত এখনো শুরু করেনি।

আর ২০২১ সালের  জুন মাসে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল জানান যে কানাডায় ২৮ জন বাংলাদেশির বাড়ি কেনার তথ্য আছে তার কাছে। তিনি তখন জানান, ওই ২৮ জনের চারজন মাত্র রাজনীতিবিদ, বাকিরা সরকারি কর্মকর্তা। সে ব্যাপারেও দুদকের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।

রিটকারী আইনজী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন জানান," এক মাস আগেই আমি যুক্তরাষ্ট্রে আবদুস সোবহান গোলাপের বাড়ির বিষয় তদন্ত করার জন্য দুদকে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে দুদক বিষয়টি আমলেই নেয়নি। তাই আমি তদন্তের জন্য হাইকোর্টে রিট করি। আমি নিজেও আওয়ামী লীগ করি। তিনিও আওয়ামী লীগ করেন।  তিনি একজন সংসদ সদস্য। আমার মনে হয়েছে এটা দল এবং দেশের স্বার্থে তদন্ত ও বিচারের আওতায় আসা উচিত।”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, "দুদকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সেল্ফ স্টার্ট নেয় না। তাদের ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করাতে হয়। তাই আমি রিটের আশ্রয় নিয়েছি। তা না হলে কবে তদন্ত হতো তা বলা অসম্ভব।”

তিনি বলেন," আমি আবেদনে ওসিসিআরপি ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কপি জমা দিয়েছি। ৩০ ডলার জমা দিয়ে তার বাড়ির ঠিকানা ও ছবি সংগ্রহ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ ডলার জমা দিয়ে যেকোনো ব্যক্তির সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।”

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "আদালতের মাধ্যমে এই অর্থ পাচারের ঘটনা যে বার বার সামনে আসছে, আমি মনে করি এটা ভালো। এই বিষয়গুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু দুদক সবগুলো আমলে নিতে পারছে না। এর কারণ হতে পারে এত বেশি ঘটনা যে তারা সব বিষয় আমলে নিতে পারে না। আবার তাদের জনবল ও দক্ষতারও প্রশ্ন আছে। তবে যারা এই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। সে কারণেও ব্যবস্থা নেয়া তাদের জন্য কঠিন হতে পারে।”

চার মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেবো: অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন," শুধু দুদক নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিআইডিসহ আরো কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এই অর্থ পাচারের ঘটনা দেখা। কিন্তু তাদের কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা দেখতে পাই না।”

‘আরো ওয়েট করতে হবে'

দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম দাবি করেন, "কোনো ঘটনার তদন্ত সম্ভব, আবার কোনো ঘটনা সম্ভব নয়। আমাদের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্সের মাধ্যমে অন্য দেশ থেকে তথ্য নিতে হয়। তথ্য না পেলে তো কিছু করার থাকে না।”

হাইকোর্টের আদেশ দিতে হয়; কিন্তু তার আগেই পত্রিকায় ছাপা হলে দুদক তা দেখে তদন্ত শুরু করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন," আমরা পত্রিকা দেখেও তদন্ত করি। কিন্তু সেটা তো সিরিয়ালি আসতে হবে। যেগুলো পেন্ডিং আছে, আগে তো সেগুলো শেষ করতে হবে। ব্যাস্টিার সায়েদুল ইসলাম সুমন আবেদন করেছিলেন। কিন্ত তার আগে তো আরো অনেক সিরিয়াল আছে। সেগুলো শেষ করে আমরা ধরতাম। আমরা এখন ২০২২ সালের আবেদনগুলো দেখছি। ওনাকে তো আরো ওয়েট করতে হবে।”

"তবে যেহেতু হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন তাই চার মাসের মধ্যে আমরা তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করবো। এই সময়ের মধ্যে না হলে আবেদন করে সময় বাড়িয়ে নেবো,” জানান দুদকের এই আইনজীবী।

২০২২ সালের ছবিঘর