মুখ্যমন্ত্রীর উৎসবে ফেরার বার্তা নিয়ে প্রবল বিতর্ক, প্রতিবাদ
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪সোমবার নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে চলতি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
গত ৯ আগস্ট ধর্ষিত ও খুন হওয়া চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর একমাস কেটে গিয়েছে। মমতা বলেন, "এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোয় ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন।"
মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কথা উঠে আসছে। তাতে মূলত 'উৎসবে ফেরার' আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন প্রতিবাদ করছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাদের মনোভাব বুঝতে পারেননি। তাই এটা উৎসবে ফিরে যাওয়ার সময় নয়, যখন একটা শোকের মধ্যে আমরা আছি। পুজো হবে তার নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, উৎসব নিয়ে সংযম কাম্য।"
ডিডাব্লিউকে চলচ্চিত্র নির্মাতা অশোক বিশ্বনাথন বলেন, "এমনই একটা ভয়ংকর মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে যে, উৎসবের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। বরং যারা প্রতিবাদ করছেন, তাদের সঙ্গে আমি আছি। এত সময় নিচ্ছেন তদন্তকারীরা, এই হত্যার পিছনে কোনো অভিসন্ধি আছে কি না, ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে কি না, সেটা নিয়েই আমাদের চিন্তা। উৎসব নিয়ে নয়।"
মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানের মধ্যে সরকারের একটা লক্ষ্য দেখছেন কেউ কেউ। সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী অনুদান দিয়েছেন। তিনি চাইছেন এই ঘটনাটা ভুলিয়ে দিতে। দুর্গাপুজোর পর কালীপুজো আসবে, একের পর এক উৎসব। জাস্টিসের যে দাবি উঠেছে, তা শুধু আরজি করের ঘটনায় সীমাবদ্ধ নেই। আনিসের মৃত্যু, কামদুনি, সারদা-নারদ, শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি, সব কিছুরই বিচার চাইছে জনতা। সরকার চাইছে উৎসবের কথা বলে এই আন্দোলনকে থিতিয়ে দিতে।"
ডিডাব্লিউকে চিকিৎসক কুণাল সরকার বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী মনে হয় সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে কথাটা বলেননি, রাজনৈতিক ভাবে একটা মরিয়া চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেতৃত্ব চাইছেন যাতে ঝামেলা মিটে যায়, সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু তা সহজে হবে বলে মনে হচ্ছে না। উৎসব মানেই হুল্লোড়ে উদ্বাহু হয়ে ওঠা, সেটা কেউ কেউ হয়ত পারবেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই পারবেন না।"
রুটিরুজির প্রশ্ন
কলকাতার দুর্গোৎসব হেরিটেজের তকমা পেয়েছে। মহালয়া থেকে রেড রোডের কার্নিভাল, দুর্গাপুজোর এই কটা দিন কলকাতা সহ বাংলায় দেখা যায় শিল্পের প্রদর্শনী। প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগরদের এটাই উপার্জনের মূল সময়।
এই সূত্রে কবি সুবোধ সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "পুজো মানে শুধু পুজো নয়। হাজার হাজার মানুষের আর্থিক উপার্জনের সময়। এই অর্থনীতির পরিসরকে অস্বীকার করা যায় না। উৎসব কথাটা যদি আপনার খারাপ লাগে, পুজো তো বলতেই হবে। উৎসব শব্দের পরিবর্তে হয়তো অন্য কথা বলা যায়। আন্দোলন চলতেই পারে, কিন্তু অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে নয়। আমি কাল দেখলাম, গড়িয়াহাট এলাকায় পুরোদমে পুজোর কেনাকাটা চলছে, ঢোকা যাচ্ছে না।"
উৎসব শব্দে সিলমোহর দিচ্ছেন না সংগীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রও। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রতিবাদ করেও উৎসবে আসা উচিত। উৎসব শব্দটা হয়তো বলা ঠিক হচ্ছে না, পুজোয় ফেরা উচিত। পুজো একটা ইন্ডাস্ট্রি, বহু মানুষ তাদের উপার্জনের জন্য এই সময়টার অপেক্ষা করেন। একজন শিল্পী গান করলে তার অনুষ্ঠানের সঙ্গে ২০ জন মানুষ যুক্ত থাকেন। তাই আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদ করলেও আমার মনে হয়, পুজো হওয়া উচিত আগের মতই। যদিও আমি চাই না, যে ঘটনা ঘটেছে তা পুজোয় চাপা পড়ে যাক।"
অর্থনীতির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়েও চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "রিকশাচালক জোর করে রং, তুলি কেনার পয়সা দিয়ে যাচ্ছেন স্লোগান লেখা, ছবি আঁকার জন্য। সুতরাং কেউ পুজোয় চপ, মুড়ি বিক্রি করতে করতে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। অর্থনৈতিক কাজকর্ম সব চলবে। পুজো মণ্ডপে প্রতিবাদের ব্যানার লাগানো থাকবে। স্লোগান, শাউটিং হবে। ঢাক বন্ধ রাখতে হবে।"
শোক ভুলে উৎসব?
রুটিরুজির প্রশ্নকে মান্যতা দিলেও সংযত ভাবে পুজো কাটানোর বার্তা দিচ্ছেন বিশিষ্টজনেরা।
ডিডাব্লিউকে অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বলেন, "পুজো নিশ্চয়ই হবে, ধার্মিক আচার সকলেই পালন করবেন। কিন্তু উৎসব হিসেবে যে জাঁকজমক দেখি, সেটার জন্য মানসিকভাবে আমরা প্রস্তুত নই। গত কয়েক বছরে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের পুজো ঘিরে যে অর্থ ও ক্ষমতার প্রদর্শন দেখা যাচ্ছে, সেটা এবার কাম্য নয়। পুজো আয়োজনের সঙ্গে বহু মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকে, তাই পুজো হবে। কিন্তু উৎসব পালনের জন্য আমরা অনেকেই হয়তো তৈরি নই।"
কারও মতে, উৎসবের পরিস্থিতি আজ রাজ্যে নেই। চিন্তাবিদ ও গবেষক আশীষ লাহিড়ী ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে। তিনি যে সাধারণ মানুষের থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন, এটা তার প্রমাণ। উৎসব মানে হচ্ছে আনন্দের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অন্যান্য পাঁচটা দিনের থেকে উৎসব আলাদা। সেদিন মানুষ নিছক আনন্দে মাতে। কোনো স্বার্থের বোধ থাকে না। সেই পরিস্থিতি কি আজকের পশ্চিমবাংলায় আছে? এই কথাটা যদি কেউ বুঝতে না পারেন, তিনি সংবেদনহীন।"
নাট্যব্যক্তিত্ব মেঘনাদ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই কথাটা বলা উচিত হয়নি। এতে অনেকেই মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন। বিশেষ করে যাদের বাড়ি এই ঘটনা ঘটেছে, তারা সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছেন। এই মেয়েটির জন্য যারা লড়াই করছেন, যারা রাস্তায় নামছেন বিচারের জন্য, তারা অল্পবিস্তর আহত হয়েছেন। মানুষ নিজের মতো করে উৎসবে সামিল হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে সব ভুলিয়ে দিয়ে উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়া খুব অনুচিত কাজ।"
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ফেসবুক ভিডিওতে বলেছেন, ''একজন প্রধান সমাজতত্ত্ববিদ উৎসব সম্পর্কে আমাদের নতুন একটি তত্ত্ব সরবরাহ করেছেন। তিনি বলছেন, উৎসব যদি শুরু হয়ে যায়, তাহলে তোমার প্রতিবাদ থেমে থাকতে হবে, প্রতিরোধ থেমে থাকতে হবে, বিদ্রোহ থেমে থাকতে হবে। ঠিক যেরকম রেফারি খেলাশেষের বাঁশি বাজিয়ে দিলে তুমি আর খেলা খেলাতে পার না। তোমাকে বল নিয়ে চলে যেতে হবে, তা তুমি যত গোলেই হার না কেন। ঠিক সেইভাবে তোমার মনের মধ্যে যতখানি ক্ষোভ সঞ্চিত হোক না কেন, সেটাকে আর তুমি উগড়ে দিতে পারবে না, আছড়ে ফেলতে পারবে না। কারণ, উৎসব শুরু হয়ে গেছে। উৎসব যে একটি সুমহান আব্বুলিশ, যেটা বলে দিলে তুমি আর চোর ধরতে পারবে না, এটা কেউ এতদিন জানত না। কিন্তু এখন নতুন করে জানলো।''