বন্যার সঙ্গে যোগাযোগ না করেই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার জাকির এ ধরনের তথ্য আদালতকে কিভাবে দিলেন? তার উদ্দেশ্যই বা কী?
আইনজীবী গোলাম সারোয়ার জাকির ২২ ডিসেম্বর আদালতে আরো দাবি করেছেন, দূতাবাসের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে বন্যার স্বাক্ষ্যের জন্য সমন পাঠিয়েছেন৷ টেলিফোনেও কথা বলেছেন৷ কিন্তু শতভাগ ইচ্ছা থাকার পরও নিরাপত্তার কারণে তিনি আসতে পারছেন না৷
এর জবাবে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন বন্যা৷ তিনি বলেছেন, গত প্রায় ছয় বছরে এফবিআই ছাড়া আর কেউ তার সাথে যোগাযোগ করেনি৷ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসও যোগাযোগ করেনি৷ তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘‘এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে তার বাসা, ফোন নাম্বার বা ইমেইল খুঁজে বের করা কি অসম্ভব?'' সেই প্রশ্ন আমাদেরও৷
বন্যা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ ও তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির অমর একুশে গ্রন্থ মেলা গিয়েছিলেন৷ রাত ৮টার দিকে বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির উল্টো দিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে দুর্বৃত্তরা তাদের দুইজনকেই গুরুতর আহত করে৷ হাসপাতালে নেয়ার পর অভিজিৎ মারা যান৷ ঘটনার পর চার বছর লেগেছে এই মামলার চার্জশিট দিতে৷ মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হলেও প্রধান দুই আসামি জঙ্গি নেতা মেজর জিয়া এবং মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন এখনো পলাতক৷
গত বছরের ১ আগষ্ট অভিযোগ গঠনের পর মামলার বিচার শুরু হয় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে৷ এ পর্যন্ত ২৬ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে৷
এই মামলার বাদী অভিজিতের বাবা অধ্যাপক ড. অজয় রায়৷ মামলার বিচার দেখার সুযোগ আর তার নেই৷ মামলায় স্বাক্ষ্য দেয়ার পর তিনি গত বছরের ১৯ ডিম্বের মারা যান৷ অভিজিৎ হত্যার পর থেকে প্রয়াত অজয় রায়ের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল৷ শুরু থেকেই এই মামলার তদন্ত নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন৷ এমনকি চার্জশিট দেয়ার পরও তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ তিনি প্রকাশ্যেই কয়েকজনকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন৷ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহসনের অভিযোগও তিনি করেছেন তখন৷ শেষ পর্যন্ত তাদের চার্জশিটে আনা হয়নি৷
বন্যাও ফেসবুক পোস্টে এই মামলা নিয়ে চরম হতাশার কথাই বলেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘কোনো বিচারের আশা করি না আমি, শুধু এই হাস্যকর মিথ্যার প্রতিবাদটুকু জানিয়ে গেলাম৷''
বন্যার সঙ্গে যোগাযোগের সব ধরনের চেষ্টার কথা বলা হলেও ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম সারোয়ার জাকির আসলে কী করেছেন? আমি সেটা তার কাছেই জানতে চেয়েছিলাম৷ তিনি যা বললেন তাতে অবাক হয়েছি বললে খুব কম বলা হবে৷ তিনি জানিয়েছেন, এজাহারে ঢাকার যে ল্যান্ড ফোন নাম্বারটি ছিল সেই নাম্বারে ফোন করে বন্ধ পেয়েছেন৷ আর সাক্ষীর সমন পাঠানো হয়েছে তাদের ঢাকার ঠিকানায়৷ সেখানে কেউ নেই, তাই সমন ফেরত এসেছে৷
হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে
এই আধুনিক যুগে বন্যার ফোন নাম্বার, যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকানা বা ইমেইল পাওয়া কি অসম্ভব? এর জবাবে এক অদ্ভুত আইনি যুক্তি দেখান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এজাহারে যে ঠিকানা ও ফোন নাম্বার থাকে, তাতেই যোগাযোগ করতে হয়৷ এটাই আইন৷'' তার কথা, সাংবাদিকরা পারেন খুঁজে বের করতে, কিন্তু তারা পারেন না, কারণ ‘‘এজাহারের বাইরে যাওয়া আইনে নাই৷''
বন্যা এই মামলার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী৷ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার পেতে তার সাক্ষ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা কিন্তু বোঝেন এবং জানেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী৷ কিন্তু সেই সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের চেষ্টার নমুনা তো দেখাই গেল৷ প্রশ্ন তোলা যায়, এই ‘অসাধারণ' চেষ্টার নেপথ্যে কী? কাদের বাঁচাতে চান তারা? এজাহারের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারের বাইরে তারা গেলেন না কেন? আইনে বাধা থাকার কথা হাস্যকর বলেই আমার মনে হয়৷
এত কিছুর পরও মামলা চলাকালে বন্যা চাইলে যে-কোনো সময় এসে সাক্ষ্য দিতে পারেন৷ কিন্তু বন্যার আসার পথ কি কেউ সুগম করবে? তাকে কি আসতে দেয়া হবে? আমার তো মনে হয় তিনি যাতে সাক্ষ্য দিতে না আসতে পারেন তার জন্যও তৎপর আছেন কেউ কেউ৷
দেখুন ২০১৭ সালের ছবিঘরটি
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
দাউদ হায়দার
লেখালেখির জন্য মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রথম বাংলাদেশ ছাড়তে হয় দাউদ হায়দারকে৷ ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতার জন্য স্বাধীনতার পরপর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মৌলবাদীরা৷ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কবিতাটি প্রত্যাহার করে দাউদ হায়দার ক্ষমা প্রার্থণা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তিনি গ্রেপ্তার হন৷ মুক্তির পর তাঁকে কলকাতাগামী বিমানে তুলে দেয়া হয়৷ তিনি জার্মানিতে রয়েছেন৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
ড. আহমদ শরীফ
দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের শেষের দিকে মৌলবাদীরা মাঠে নামে৷ ওই বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়৷ ড. আহমেদ শরীফও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কমিটির আন্দোলনে চাপে পড়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল’ হিসেবে পরিচিত জামায়াত৷ সেই পরিস্থিতিতেই আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমানননার অভিযোগ তোলা হয়৷ জামায়াত এ বিষয়ে সংসদেও কথা বলে৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
তসলিমা নাসরিন
ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তসলিমা নাসরিনের নামও সেখানে যুক্ত হয়৷ ১৯৯৪ সালে তসলিমা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে৷ আগের বছর প্রকাশিত ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে ঘিরেই মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ফাঁসি দাবি করে৷ হত্যার ফতোয়া দিয়ে তাঁর মাথার দামও ঘোষণা করা হয়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
হুমায়ুন আজাদ
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে একটি বইয়ের জন্য ‘প্রথাবিরোধী’ লেখক হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মাঠে নামে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এর মধ্যে একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় তাঁর উপর হামলা হয়৷ সে বছরেরই আগস্ট মাসে জার্মানির মিউনিখে তাঁর মৃত্যু হয়৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
শাহরিয়ার কবির
সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা নানা ধরণের হুমকির শিকার হয়ে আসছিলেন, তাদের মধ্যে শাহরিয়ার কবির অন্যতম৷ দীর্ঘদিন যাবত তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের হাল ধরে আছেন৷ ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় হওয়ার পর তিনি ও তার সহকর্মীরা অনেকবার হত্যার হুমকি পান৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
জাফর ইকবাল
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালকেও নানা সময়ে মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-কে হত্যার হুমকি দেয়৷ এরা আগের বছরও তাঁকেসহ প্রগতিমনা ২০ জনকে হত্যার হুমকি দেয়৷ মৌলবাদীদের হামলায় নিহত হন রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং একেএম শফিউল ইসলাম নামের দু’জন শিক্ষাবিদ ও বেশ কয়েকজন বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় দাপটের সাথেই ছিলেন৷ হজ নিয়ে করা মন্তব্যের পর তাঁর ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন মাঠে নামে৷ এক পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে পরিচিত এই মন্ত্রী দলীয় পদ, মন্ত্রিত্ব সবই খোয়ান৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
সুলতানা কামাল
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হন মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল৷ একটি টেলিভিশন বিতর্কে পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে বলা এক কথার পর তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার বা দেশ ছাড়া করার দাবিও জানায় তারা৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
কেবল হুমকি নয়, খুনও হচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর হুমকি দেয়া শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর পর৷ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে তরুণ-তরুণীরা শাহবাগে আন্দোলন শুরু করলে মঞ্চকর্মীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে হুমকি দেয়া শুরু হয়৷ এর মাঝে খুন হন মঞ্চকর্মী রাজিব হায়দার৷ একে একে নিহত হন অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয় ও দীপনসহ অনেকে৷ হুমায়ুন আজাদসহ প্রায় সব হামলায়ই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়৷
-
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
বাঁচার জন্য দেশত্যাগ
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার লালমাটিয়ায় হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে যান ‘শুদ্ধস্বর’-এর আহমেদুর রশীদ টুটুল৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও আতঙ্কে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরতে পারেননি৷ এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়েন৷ তাঁর সঙ্গে আহত হওয়া ব্লগার তারেক রহিমও ওই সময় দেশত্যাগ করেছিলেন৷ গত ৩-৪ বছরে আরও অনেক ব্লগার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷
লেখক: সুলাইমান নিলয়