1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মব বিচারের' ইতিহাস ও বাংলাদেশ

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক যুবায়ের আহমেদ৷
যুবায়ের আহমেদ
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মব বিচারের সংজ্ঞাই হলো একদল লোক আইনি ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে শাস্তি দেবেন৷

https://p.dw.com/p/4kcp6
ঢাকায় সড়কে লাঠি হাতে কয়েকজন ব্যক্তি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই মবদের ঘরে ফেরানোছবি: Privat

 এর প্রেক্ষাপট হলো রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো হয় কাজ করে না, নয় জনতা মনে করছেন তা জনবিরোধী অথবা এই লোকেরা আইনি কাঠামোর তোয়াক্কা করেন না৷

একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক৷ প্রাচীন গ্রীস ও রোমে আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামো ছিল৷ তবে সেখানেও ‘মব বিচার' দেখা যেতো, যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে দুর্বল বা অন্যায় বলে মনে করা হতো৷  যেমন, এথেন্সে নাগরিকরা মাঝে মাঝে ‘অস্ট্রাকিজম'-এ অংশ নিতেন৷ সেখানে নাগরিকরা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করা ব্যক্তিকে নির্বাসিত করার জন্য ভোট দিতেন৷ রোমান প্রজাতন্ত্রেও নাগরিকরা স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাত বা হত্যা করেছেন৷

মধ্যযুগে সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে স্থানীয় প্রভু ও অভিজাতরা বিচার ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতেন৷ তবে যখন প্রভুরা অনুপস্থিত থাকতেন বা ‘প্রয়োজন' পড়তো তখন কৃষক ও শহরের লোকেরা কখনো কখনো চোর, ধর্মবিরোধী বা ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে ‘মব সহিংসতা'র আশ্রয় নিতেন৷ মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রায়ই সন্দেহভাজন ‘ডাইনিদের' আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো৷

পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকার ও আরো সংগঠিত আইনি ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও ‘মব বিচার' পুরোপুরি বন্ধ হয়নি৷ প্রকৃতপক্ষে, জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড, যেমন ফাঁসি বা শিরশ্ছেদ, ছিল ‘মব বিচারের' সাধারণ রূপ, যেখানে বড় জনসমাগমে শাস্তি প্রদর্শন করা হতো৷

১৬শ ও ১৭শ শতকে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন ও ক্যাথলিক প্রতিসংস্কার‘মব সহিংসতা'কে উস্কে দেয়৷ কারণ, ধর্মীয় উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার জন্য ‘মব', অর্থাৎ একদল মানুষ ব্যবস্থা নিতো, যেখানে কর্তৃপক্ষ হয় সহায়তা করতো, অথবা নীরব থাকতো৷

মব বিচার কেমন করে ১৮ শতকের বিপ্লবগুলোতে প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে, বিশেষ করে অ্যামেরিকান ও ফরাসি বিপ্লবের সময় ‘মব বিচার' নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়৷ কারণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অসন্তোষ সৃষ্টি করে৷ ফরাসি বিপ্লবের সময়, স্থিতিশীল বিচারব্যবস্থার অভাবে ‘জনগণের আদালত৷' ও গিলোটিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যেখানে বিপ্লবের শত্রুদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য মবরা জড়ো হতো৷ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় পেট্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) মব বিচারের ঘটনা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়৷

যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রায়ই অনুপস্থিত বা দুর্বল ছিল৷ সেখানে ভিজিলান্তে বিচার ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়৷ এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারীরা ‘ভিজিলেন্স কমিটি' গঠন করতো তাদের নিজস্ব আইন প্রয়োগের জন্য৷ সেখানে মবরা প্রায়ই কোনো ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা ছাড়াই ব্যক্তিদের আটক, বিচার ও মৃত্যুদণ্ড দিতো৷

মব বিচারের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে দক্ষিণে পুনর্গঠন (১৮৬৫-১৮৭৭) এবং এর পরবর্তী সময়ে৷ দাসত্বের অবসান এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীগুলির উত্থানের ফলে জাতিগত উত্তেজনা তীব্র হয়ে ওঠে, যা ব্যাপক ‘লিঞ্চিংয়ে' রূপ নেয়৷ আফ্রিকান আমেরিকানরা প্রায়ই এই নৃশংস কর্মকাণ্ডের শিকার হতেন৷ ১৯ শতকের শেষ থেকে ২০ শতকের প্রথম দিকে, হাজার হাজার আফ্রিকান আমেরিকানকে জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় তা করা হতো অথবা তারা কোনো হস্তক্ষেপ করতো না৷

২০ শতকেও মব বিচার অব্যাহত থাকে৷ যেমন, ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়, কখনো কখনো মবরা উপনিবেশিক প্রশাসকদের শাস্তি দিতেন

ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থানে মব বিচার আরো বাড়ে৷ নাৎসি জার্মানিতে ১৯৩৮ সালে ‘ক্রিস্টালনাখট' ছিল রাষ্ট্র-সমর্থিত মব আক্রমণের একটি উদাহরণ, যেখানে ইহুদি ব্যবসা, উপাসনালয় ও ব্যক্তিদের উপর সহিংস আক্রমণ চালানো হয়৷

আধুনিক বিশ্বেও মব বিচারের ঘটনা ঘটেছে অনেক৷ আরব বসন্ত বা সবশেষ ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের আক্রমণ বা জার্মানিতেও রাজনীতিকদের প্রতি জনতার আক্রোশ সবই সহিংস রূপ নিয়েছে৷ বিপ্লব বা বিদ্রোহের ক্ষেত্রে মব যেমন ইতিহাস পালটে দিয়েছে, তেমনি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে কখনো কখনো তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, বা একাধিক ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি হওয়ায় গৃহযুদ্ধের দিকেও চলে গেছে৷

বাংলাদেশের ইতিহাসেও যেমন স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনে যেমন ‘মব' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বা দাঙ্গা তৈরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনীতিক মহল নিজ স্বার্থে জনগণকে মুখোমুখি করেছে৷

বর্তমান প্রেক্ষাপটেও জনতা যখন ৫ই আগস্ট রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে জনতার ওপর গুলি চালানো সরকারের প্রধানকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, তখন এই মব দখল করে নেয় রাজধানী, জড়ো হয় গণভবন, সংসদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয়৷

যেহেতু রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে ঔপনিবেশিক সময়ের মতো জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে, সেই বাহিনী যখন আন্দোলন দমনে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, জনরোষের মুখে পড়ে নিজেরাও হয়েছে আক্রমণের শিকার, তখন সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা বিজয়ী আন্দোলনকারীদের সামনে পুলিশের মুখ রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে৷ যেহেতু জনতার একটা বড় অংশ নিজেদের বিজয়ী মনে করছে, এবং তাদের মাঠের লড়াই ছিল মূলত পুলিশ বাহিনী ও সরকারি দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে, তাহলে সেই পুলিশ বাহিনী এখন তাদের ওপর আইনের প্রয়োগ করবে সে দৃশ্য আপাত দৃষ্টিতে এখনো কঠিন বলেই মনে হচ্ছে৷ আর সরকারি দলের বা দলঘেঁষা লোকের বা তাদের বাড়ি ঘরের ওপর হামলার বেশ অনেকগুলো ঘটনা তো দেখাই গেছে৷ এগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা জনগণের অসন্তোষের জায়গা থেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াই ছিল বেশি৷ কিন্তু পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি ঘটনা জনমনে, যারা এই আন্দোলনের সঙ্গেই ছিলেন, প্রশ্নের উদ্রেক করেছে৷ ফেসবুকে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরের ঘটনাগুলো নিয়ে উদ্বেগ দেখা গেছে৷

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তাই এই মবদের ঘরে ফেরানো৷ এই মবদের ভেতর যেমন সাধারণ জনতা আছে, তেমনি আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বা অন্যান্য গোষ্ঠী৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো গভীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই মবের ব্যবহার তাই প্রশ্ন তুলেছে৷

এ অবস্থা থেকে বের হবার একটাই উপায়৷ যারা এই আন্দোলনের মূলে ছিলেন, তাদের নিজেদের অবস্থান প্রশ্নাতীত রাখতে এই ‘মব জাস্টিস' বা বিচার বন্ধ করতে হবে৷ বরং জনতার সঙ্গে অনলাইনে অফলাইনে আলোচনা করতে হবে৷ তাদের আইন বহির্ভূত বিচার বা প্রতিশোধের অবস্থান থেকে সরে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷

সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাদের অংশ করতে হবে৷ যেমন, দেশের যে সংস্কারের আলোচনা চলছে, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এগুলোতে জনগণের মতামত নেয়া যেতে পারে৷ জরিপ হতে পারে, কেমন সরকার দেখতে চান তারা৷

এভাবে জনগণকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারে অংশীদার করতে হবে, যাতে তারা ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা প্রতিহিংসার বাইরে এসে একটা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হতে পারেন৷