ভাইরাসের বিস্তার – বাদুড় থেকে মানুষে
১ ফেব্রুয়ারি ২০১১২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস৷ এশিয়ার বহু দেশে রহস্যজনক এক মহামারি ছড়িয়ে পড়ে৷ সাধারণ জ্বর, গলাব্যথা ও কাঁপুনি দিয়ে শুরু এই মহামারির৷ এক সপ্তাহ পর দেখা দেয় ফুসফুসের সংক্রমণ, রোগীর শ্বাসকষ্ট৷ প্রতি ১০ জনে এক জন মারা যায়৷ বিশেষজ্ঞরা এই রোগের নাম দেন সার্স৷ হামবুর্গ শহরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগবিষয়ক ইন্সটিটিউটের ভাইরাসবিদ ক্রিস্টিয়ান ড্রোসটেন সেই সময় সার্স রোগের জীবাণু বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ এটা হল করোনা ভাইরাস৷ ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন বলেন, ‘‘এই জীবাণুগুলি কোথা থেকে এসেছে, সে সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না৷ বিভিন্ন প্রাণীর দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাদুড়ই হল এই সব ভাইরাসের বাহক৷''
গবেষকরা বাদুড়বাহিত ভাইরাসের ডিএনএ পরীক্ষা করে লক্ষ্য করেছেন, এগুলি মানুষকে আক্রান্ত করার অনেক আগে থেকেই বাদুড়ের দেহে বসবাস করে আসছিল৷ শুধু সার্স নয়, এবোলা, জলাতঙ্ক, ঠাণ্ডা লাগা, ডায়রিয়া ইত্যাদি অনেক রোগের বাহকই বাদুড়৷ ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন জানান, ‘‘আমরা সঠিক জানিনা, কেন কোন কোন ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষের দিকে এগিয়ে যায়৷ তবে যে কথাটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা হল, বাদুড়ের দেহে নানা রকমের ভাইরাস রয়েছে৷ এদের মধ্য থেকে একটি অংশই কেবল মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রতি আগ্রহ দেখায়৷''
ভাইরাসদের বসবাস করার একটা আদর্শ স্থান হল বাদুড়দের শরীর৷ এর কারণ প্রথমত, তাদের সংখ্যাধিক্য৷ ১০ লক্ষের বেশি বাদুড় একসঙ্গে বসবাস করে৷ দ্বিতীয়ত, বাদুড় স্তন্যপায়ী জীব৷ ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, বাদুড়রা তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ভাইরাসগুলিকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয় অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহেও বাসস্থান গাড়তে৷ বাদুড়রা অনেকটা ট্রানজিট স্টেশনের মত৷ তারা নিজেরা স্তন্যপায়ী বলে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে পারে ভাইরাসদের৷''
সম্ভবত বাদুড়ের মল থেকে মানুষের দেহে পৌঁছে যায় এই ভাইরাসগুলি৷ এশিয়ার কিছু দেশে মানুষ বেড়ালের মত দেখতে ‘ভিভাররাডে' নামের এক জাতীয় প্রাণীর মাংস খায়৷ তারা আবার খেয়ে থাকে বাদুড়৷ এইভাবে এশিয়ার অনেক দেশে সার্সের ভাইরাস মানুষের দেহেও বিস্তার লাভ করে৷ তাই শুধু মানুষের দেহের ভাইরাস পরীক্ষা করলেই চলবেনা, এই ভাইরাসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে জানতে হবে, কোন প্রাণী থেকে তারা এসেছে, তাদের আচার আচরণই বা কীরকম? বলেন ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা ভাইরাস ও তাদের বাহককে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারব তারা কীরকম৷ ভাইরাসরা বছরের পর বছর ধরে যেখানে বসবাস করেছে, সেখানে দৃষ্টি দিলেই আমরা বুঝতে পারব তারা এত বিপজ্জনক হল কী করে? কম ক্ষতিকর ভাইরাসের সঙ্গে বেশি ক্ষতিকর ভাইরাসের পার্থক্যটাই বা কী?''
বাদুড়ের দেহ থেকে মানুষের দেহে ঢুকতে গেলে ভাইরাসদের কীভাবে পরিবর্তন হয়, সে ব্যাপারেই গবেষকদের আগ্রহ বেশি৷ এই পরিবর্তনের রকমটা বুঝতে পারলেই বাদুড়ের দেহের জীবাণুগুলিকে খুঁজে পাওয়া ও পরীক্ষা করাও সহজ হবে৷ বোঝা যাবে মানুষের জন্য তারা কী বিপদ বয়ে আনতে পারে৷ ক্রিস্টিয়ান ড্রোস্টেন বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলা সম্ভব হবে, কোন আস্তানায় ও কোন এলাকায় বিপজ্জনক ভাইরাসগুলি জায়গা করে নেয়৷ এখনই এব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করা উচিত, কী ভাবে এই সব ভাইরাসের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়৷''
এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারেনা, আর তা হল, বাদুড় নিধন করা৷ কেননা বাদুড় আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ বাদুড় ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে মানুষের উপকারে লাগে৷ তবে এই প্রাণীগুলিকে টিকা দিয়ে ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা যেতে পারে, সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা যেতে পারে মানুষকে৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন