কেন সংলাপে যাননি? এই সংলাপে আদৌ কী কোন ফল মেলে? কীভাবেই বা একটা ভালো নির্বাচন কমিশন হতে পারে? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম৷
ডয়চে ভেলে : নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির যে সংলাপ, সেটা কতটুকু সফল হওয়া সম্ভব?
মুজাহিদুলইসলামসেলিম : মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই ধরনের সংলাপ এর আগেও করেছেন৷ সেই সংলাপে আমরা যোগদান করেছিলাম৷ তিনি যে চিঠি পাঠিয়েছেন, আগেও সেই বয়ান দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন৷ যে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে৷ এবং সেজন্য পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ প্রথম কথা হলো, সংবিধানের একটা অংশ তিনি উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু সংবিধানের যে অংশটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সব বিষয়েই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করতে হবে৷ যাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মত কাজ করতে হয় তিনি আবার অন্য কারও পরামর্শ নিলেও সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার তো অধিকার রাখেন না৷ আমরা আগেও বলে এসেছিলাম তিনি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ না করে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করতে হলে সংবিধানে আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে৷ ওখানে বলা আছে, আইনের বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে হবে৷ সেই আইনী বিধিবিধানটা কোথায়? ৫০ বছরে এটা হয়নি৷ মহামান্য রাষ্ট্রপতির এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি তিনি একটা বার্তা পার্লামেন্টের কাছে পাঠাতেন যে, সংবিধানের এই ধারাটাকে কার্যকর করার জন্য আগামী এক মাসের মধ্যে তোমরা নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ব্যাপারে বিধিবিধান প্রণয়ণ করে আমার স্বাক্ষরের জন্য পাঠাও৷ তাহলে সেটা কার্যকরী কোন কাজ হতো৷
বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের চাওয়া উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতির পক্ষে কী স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব?
সাংবিধানিকভাবেই এটা সম্ভব না৷ আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাঝে মধ্যেই বলেন, আমার তো কোন কাজ নেই৷ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতে হয়৷ প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া আর কারও জানাযায় যোগ দেওয়া ছাড়া তো আমার কোন কাজ নেই৷ ফলে উনি তো না জানার মতো মানুষ না৷ আমরা তো গতবার সব কথাই বলে এসেছি৷ এগুলো আবার নতুন করে বলার তো প্রয়োজন নেই৷ গতবার আমরা যে গেলাম, পরামর্শ দিলাম তার রেজাল্টটা কী দাঁড়াল? রাষ্ট্রপতি এমন একজন মানুষকে নিয়োগ দিলেন যে, তিনি ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ তারিখে রাতের অন্ধকারে করে ফেললেন৷ সেটা সরকারসহ স্বীকার করল এটা খুব একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি৷ আইন রক্ষার জন্য আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে৷ তিনি যে একটা ভুল লোককে নিয়োগ দিয়েছিলেন তার জন্য আমাদের নির্বাচনের মুখে চুনকালি পড়ে গেল৷ মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়ে গেল৷ সেটার জন্য তিনি নিশ্চয় দুঃখিত হয়েছেন বলে আমি আশা করব৷ জনগনের কাছে সেটা দুঃখপ্রকাশ করে বলা উচিৎ ছিল আমি ভুল লোককে পছন্দ করেছি৷ এবার আর এটা হবে না৷ সেই কথা তো তিনি বলেননি৷
আগের বার সার্চ কমিটি যে নামগুলো দিয়েছিল, তাদের বাদ দিয়ে পৃথক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল, এটাই কি আপনি বলছেন? তাহলে এই ধরনের সংলাপের ফল কী?
এটা সেকেন্ডারি প্রশ্ন৷ সার্চ কমিটি করুক আর যে কমিটি করুক শেষ পর্যন্ত তো প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছু করতে পারেন না৷ নাম প্রস্তাব করার জন্য বারবার কেন এই কাজের মধ্যে যাবেন? আইনের বিধান করার জন্য তো সংবিধানে নির্দেশনা আছে৷
আইনের বিধানটা কেন হচ্ছে না?
এটা হচ্ছে না এই কারণে যে, ক্ষমতাসীনেরা চাবিকাঠিটা নিজেদের হাতে রাখতে চায়৷ বিএনপিও তাই করেছে, তাদের শাসনামলে তারা আইনটা করেনি৷ আওয়ামী লীগও করছে না, কারণ তারা ক্ষমতাসীন৷
আপনারা যারা এই সংলাপে যাননি, রাষ্ট্রপতি অন্য কোনভাবে উদ্যোগ নিলে কী যেতেন?
আমরা তো রাষ্ট্রপতিকে সব কথা বলে এসেছি৷ আমরা এবার চিঠি দিয়ে বলেছি যে, আমরা আগেই আপনাকে সব কথা বলে এসেছি৷ আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই৷ আমরা আগেই ৫৩টি সুপারিশ দিয়েছি৷ নির্বাচন ব্যবস্থা আমূল ঢেলে সাজাতে হবে৷ এই সিস্টেম চলবে না৷ রাজনৈতিক দলগুলো যত শতাংশ ভোট পাবে, তত শতাংশ আসন পাবে৷ এর ব্যাখা আমরা করেছি৷ নির্বাচনকে পেশিশক্তি, টাকা, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এগুলো থেকে মুক্ত করে অবাধ নিরপেক্ষ করতে হবে৷ পাকিস্তান আমলে আমি নিজেই লড়াই করেছি, সর্বজনীন ভোটাধিকার দিতে হবে৷ এক লোক এক ভোট চাই৷ এরশাদের আমলেও আমরাও দেশের চার প্রান্ত থেকে হেঁটে ঢাকায় এসে মহাসমাবেশ করেছি৷ আমি নিজেই ২১ দিন হেঁটে খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছি৷ অন্য চার নেতা চার প্রান্ত থেকে এসেছেন৷ শ্লোগান ছিল আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব৷ আমি যেটা বলতে চাই, ফেরেশতাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন করলেও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যাবে না৷ যদি নির্বাচনের সিস্টেমটা না বদলান৷
আসলে কী রাষ্ট্রপতির বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা, নৈতিকতা প্রয়োগের কোন সুযোগ আছে? নাকি বর্তমান সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটা শুধুই আলঙ্কারিক-শোভাবর্ধণকারী?
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী তাই৷ আমরা ব্রিটিশ সিস্টেম অনুসরণ করি৷ এখানে তো মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা৷ এখানে তো ৭০ ধারা নিয়ে বড় রকমের প্রশ্ন আছে৷ সংসদের কাছে সরাসরি জবাবদিহি করতে হয় না৷ আরও কিছু প্রশ্ন আছে৷ কিন্তু সেগুলো ভিন্ন আলোচনা৷
রাষ্ট্রপতির পদটাকে কী আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়?
এটা করার তো দরকার নেই৷ এটা করলেই বা কী হবে? তাতে রাষ্ট্রপতি একরকম সিদ্ধান্ত দিলেন, প্রধানমন্ত্রী আরেক রকম সিদ্ধান্ত দিলেন, দু'টো পাওয়ার সেন্টার আলাদা করলে দেশে নতুন আরেক ধরনের বিশৃঙ্খলা হবে৷ আমাদের সেন্টার অব পাওয়ার একটাই থাকা উচিৎ৷ সেটা জবাবদিহিতামূলক এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকতে হবে৷ পাওয়ারকে ডিসেন্ট্রালাইজ করে একেবারে নিচ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে৷ কোন গ্রামে স্কুল কমিটিতে কে থাকবে, কালভার্ট কোথায় হবে সেটা সংসদ সদস্যদের একেবারে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে৷ এগুলো লোকাল বডিগুলো দেখবে৷ তারা শুধু আইন প্রণয়ন ও কেন্দ্রীয় সরকারের কার্য তদারক করবে৷ এখন তো একেকজন একেকটা এলাকার জমিদার হয়ে গেছেন৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন, ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ, সকল স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন কমিশনের দায়িত্ব৷ কমিশন স্বাধীন এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
ভারতের নির্বাচন কমিশন
ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচটি স্বায়ত্ত্বশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একটি৷ মূলত লোক সভা, রাজ্য সভা, রাজ্যের বিধানসভা, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করার দায়িত্ব কমিশনের৷ এছাড়া কোনো বিশেষ সময়ে যখন বিদ্যমান আইনে সুরাহা হচ্ছে না, তখন নির্বাচন কমিশনের সেখানে ‘যথাযথ উপায়ে’ ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা আছে৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ কোনো সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবার পর বা কোনো কারণে সংসদ বিলুপ্তির পর এই সরকার দায়িত্ব নেয়৷ তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে৷ তবে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷ কমিশন জাতীয়, প্রাদেশিক ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করে৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশন
এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো গণতন্ত্র হলো শ্রীলঙ্কা৷ সেখানেও রাষ্ট্রপতি, সংসদ, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন
মালদ্বীপে আলাদা নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে মাত্র এক দশক আগে৷ ২০০৮ সালের আগষ্টে এই স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয় নির্বাচন আয়োজন করত৷ পরে এই অফিসটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অধীনে চলে যায়৷ রাষ্ট্রপতিই কমিশনার নিয়োগ দিতেন৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
নেপালের নির্বাচন কমিশন
১৯৫০ সালের নেপাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নেপালের নির্বাচন কমিশনের জন্ম৷ এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান৷ শুধু জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয়, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নিবন্ধন করার দায়িত্ব রয়েছে দেশটির নির্বাচন কমিশনের কাঁধে৷ ছয় জন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত কমিশন ছয় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
ভূটানের নির্বাচন কমিশন
ভূটানে রাজতন্ত্র আছে৷ তবে সংসদও আছে৷ সংসদের নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন৷ প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, সংসদের স্পিকার, জাতীয় কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের প্রধানের দেয়া তালিকা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও দুইজন কমিশনারকে নিয়োগ দেন রাজা৷ কমিশনের ক্ষমতাও অনেক৷ নির্বাচন ছাড়াও বিধি তৈরি, নির্বাচন পদ্ধতি রিভিউ করাসহ যে কাউকে তলব, তদন্ত ও কিছু অ্যাডজান্কটিভ ক্ষমতা রয়েছে৷
-
দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচন কমিশনগুলো
আফগানিস্তানের নির্বাচন কমিশন
যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সহিংসতার কারণে আফগানিস্তানে ক্ষমতা বারবার পরিবর্তিত হয়েছে৷ সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাতেও তার প্রভাব পড়েছে৷ তবে সংবিধান অনুযায়ী, রেফারেন্ডাম, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সুষ্ঠু ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের৷
লেখক: যুবায়ের আহমেদ
অতীতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের চা চক্রের আয়োজন হতো, এই চা চক্র থেকেই অনেক সমস্যার সমাধান হতো৷ এখন এই ধরনের আয়োজন কেন এখন হয় না?
এটা আইয়ুব খান বা জিয়াউর রহমান বা এরশাদের সময়ের কথা হবে৷ কারণ তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ছিল৷ তখন তো রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই আলোচনা হবে৷ রাজনৈতিক আলোচনা করতে হলে যার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তার সঙ্গেই তো আলোচনা হওয়া উচিৎ৷ সেটা আরও ঘন ঘন হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি৷ এতবড় করোনা হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকলেন না৷ আমি নিজেই তো প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সবার সঙ্গে কথা বলেন৷ কয়েক লাখ স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করে সাত দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেন৷ কিন্তু উনি তো পদক্ষেপ নিলেন না৷
রাষ্ট্রপতি যে কাউকে ক্ষমা করতে পারেন, সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে৷ কিন্তু রাষ্ট্রপতি যাদের সাধারণ ক্ষমা করছেন, তাদের মধ্যে চরম বিতর্কিত মানুষও থাকেন৷ যা সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রত্যাশা করেন না৷ তারপরও কেন রাষ্ট্রপতিকে এটা করতেই হয়?
রাষ্ট্রপতি তো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এটা করেন না বা করতে পারেন না৷ তাকে তো প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হয় এবং সেই পরামর্শ অনুযায়ী করা বা না করাটা নির্ধারিত হয়৷ এটা আমাদের সংবিধানের চরিত্র৷ এটা তো সমস্যা না, সমস্যাটা হচ্ছে যিনি সিদ্ধান্তটা নিচ্ছেন তিনি জবাবদিহি করতে বাধ্য কিনা? গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিনা৷ আপনি একাদশ নির্বাচনের আগের নির্বাচনটা খেয়াল করেন, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪জন নির্বাচিত হয়ে গেলেন৷ অথচ সরকার গঠনের জন্য ১৫০টি আসন দরকার৷ এখন এরা তো বলতে পারত, অন্য আসনে ভোট হোক আর না হোক আমরা সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট৷ তার মানে কী, একটা লোকও ভোট দিল না, কিন্তু সরকার হয়ে গেল৷ ভোটাধিকার হরণ নানাভাবে হয়, আইয়ুব খানও করেছিল মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে, জিয়াউর রহমান হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে৷ সেখানে তারা দেখিয়ে দিল ৯৮ পারসেন্ট ভোট পড়েছে৷ আর এরশাদ এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন৷ এখন আরেকভাবে হচ্ছে৷ গণতন্ত্রের কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
এখন তো আইন করা সম্ভব না? তাহলে কীভাবে একটা ভালো নির্বাচন কমিশন হতে পারে?
আমি তো মনে করি, আইন করা সম্ভব৷ কে বলল সম্ভব না৷ পঞ্চম সংশোধনীতে কয়দিন লেগেছিল? সাত দিনে সম্ভব৷ এরশাদ চলে যাওয়ার পর সাহাবুদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হল তখন তো সংশোধনী করা হল৷ সেটা কী? এই ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রম হবে প্রধান বিচারপতি পাবলিক অফিসে দায়িত্ব পালন করার পরও তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আবার ফেরত যেতে পারবেন৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এম ইদ্রিস৷ ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি ৷ ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে এই কমিশন৷ সে সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। নির্বাচনে ২৯৩ আসন জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। জাসদ ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি করে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাঁচটি আসন পায়।
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
নুরুল ইসলাম কমিশন
বিচারপতি একেএম নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সিইসি৷ ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই যখন দায়িত্ব নেন, তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ প্রায় আট বছর দায়িত্ব পালনের পর অব্যাহতি নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি৷ ৷ ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয় তার তত্ত্বাবধানে। বিএনপি পায় ২০৭ আসন, আবদুল মালেক উকিলের আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
তিন রাষ্ট্রপতির কমিশন
পরপর দুই সামরিক শাসকের অধীনে সিইসির দায়িত্ব পালন করেছেন নুরুল ইসলাম৷ ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ‘সামরিক অভ্যুত্থানে’ ক্ষমতায় আসেন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। পরবর্তীতে এরশাদের সরকারে আইনমন্ত্রী ও পরে উপ রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন নুরুল ইসলাম৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
মসউদ কমিশন
বিচারপতি চৌধুরী এটিএম মসউদ দায়িত্ব নেন ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি৷ তিনি পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করেন ১৯৯০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি৷ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে দুটো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এই কমিশনের অধীনে৷ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আট দলীয় জোট গেলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সাত দলীয় জোট তা বর্জন করে। চতুর্থ জাতীয় নির্বাচন দুই জোটই বর্জন করে৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
সুলতান কমিশন
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ তবে মাত্র ১০ মাস দায়িত্বে থেকে কোনো জাতীয় নির্বাচন না করেই ২৪ ডিসেম্বর সরে যেতে বাধ্য হন এরশাদের নিয়োগ পাওয়া এই সিইসি৷ গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হলে প্রধান দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতৈক্যে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ৷ এরপর তিনি ইসি পুনর্গঠন করেন৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
রউফ কমিশন
পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রথম তিন সদস্যের ইসি পায় বাংলাদেশ। বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ সিইসি হিসেবে নিযু্ক্ত হন৷ ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে তার কমিশন৷ তিনি ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন৷ রউফ কমিশন নির্বাচনি আইনে ব্যাপক সংস্কার আনে, জারি করা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত হন সিইসি রউফ।
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
সাদেক কমিশন
বিচারপতি একেএম সাদেক সিইসি পদে নিযুক্ত হন ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল৷ ১৯৯৬ সালে এই কমিশনের অধীনেই হয় বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো ভোট বর্জন করে। বিএনপি পায় ২৭৮ আসন৷ দেড় মাস মেয়াদী সংসদের একমাত্র অধিবেশনে ত্রয়োদশ সংশোধনে সংবিধানে যুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ এই ইসিই নির্বাচনি আচরণবিধি চালু করে৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
হেনা কমিশন
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতার মধ্যে সাবেক আমলা মোহাম্মদ আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ এই প্রথম কোনো আমলা এই পদে নিয়োগ পান৷ তার অধীনে ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইল (সখিপুর-বাসাইল) উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির জন্য সমালোচিত হয় তার কমিশন৷ নির্বাচনের গেজেট না করেই ২০০০ সালের ৮ মে দায়িত্ব ছাড়েন আবু হেনা৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
সাঈদ কমিশন
রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদপূর্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই দায়িত্বে আনে একানব্বইয়ের নির্বচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা শাহাবুদ্দিন আহমেদকে। আবু হেনা সরে যাওয়ার পর সিইসি হন সাবেক আমলা এম এ সাঈদ৷ বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাঈদ কমিশনের অধীনেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন হয়।
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
আজিজ কমিশন
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত কমিশনগুলোর একটি আজিজ কমিশন৷ বিচারপতি এমএ আজিজ ২০০৫ সালের ২২ মে সিইসি’র দায়িত্ব নেন৷ ব্যাপক রাজনৈতিক টানাপড়েনের সময় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন৷ পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদ তফসিল বাতিল করেন৷ ২১ জানুয়ারি কোনো জাতীয় নির্বাচন আয়োজন না করেই পদত্যাগ করেন এম এ আজিজ৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
শামসুল হুদা কমিশন
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এমএ আজিজের উত্তরসূরী হন এটিএম শামসুল হুদা৷ তার কমিশন ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে৷ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন হয় ওই কমিশনের সময়েই। সংলাপ করে নির্বাচনি আইন সংস্কার করা হয়। চালু হয় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম ও ইভিএম। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০, বিএনপি ৩০ ও জাতীয় পার্টি ২৭ আসন পায়।
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
রকিবুদ্দিন কমিশন
ইসি পুনর্গঠনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের পর সার্চ কমিটি গঠন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। ২০১২ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেন সাবেক আমলা কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ৷ সংসদে বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা৷ ক্ষমতাসীন দলের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়৷ বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের বর্জন করা নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
নুরুল হুদা কমিশন
এবারও সংলাপ আয়োজন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবুল হামিদ৷ সিইসি করা হয় সাবেক আমলা কে এম নুরুল হুদাকে৷ দ্বাদশ ইসির যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নতুন কার্যালয় নির্বাচন ভবনে। তার অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ পাওয়ায় যায়৷ বর্তমান কমিশনের মেয়াদ রয়েছে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
-
এক নজরে সব নির্বাচন কমিশন
এরপর কে?
সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন করার কথা থাকলেও তা এবারও করা হয়নি৷ ফলে আবারও রাষ্ট্রপতি মো. আবুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ নিয়ে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন৷ তবে এই সংলাপের আহ্বানকে ‘অর্থহীন’ উল্লেখ করে তাতে যোগ না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি, বাসদ, সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি দল৷