1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বিশ্বকাপ জেতার মতো সবই আছে আমাদের’

নোমান মোহাম্মদ
৩১ জানুয়ারি ২০১৯

রেডিসন ব্লু হোটেলে দেওয়া সাক্ষাত্‍কারটি বিশ্বকাপ স্বপ্ন-সম্ভাবনা-প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয়ে ছড়িয়েছে আরো অনেক দিকে৷ মাশরাফির অধিনায়কত্ব, মাশরাফির বোলিং, মাশরাফির ইনজুরি, মাশরাফির রাজনীতি– আরো কত কী!

https://p.dw.com/p/3CTpi
ছবি: DW/N. Mohammad

ডয়চে ভেলে: ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে৷ ২০১৯ বিশ্বকাপে পরের ধাপে যাবার ব্যাপারে অধিনায়ক হিসেবে আপনি কতটা আশাবাদী?

মাশরাফি বিন মোর্তজা: এবার তো কোয়ার্টার ফাইনাল নেই; একেবারে সেমিফাইনাল৷ বাকি ৯ দলের সবার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে হবে৷ আমি অবশ্যই আশাবাদী৷ খুব কঠিন কাজ, তবে আশাবাদী৷ আমাদের দলটি ভালো৷ আশা না করার তাই কোনো কারণ নেই৷

কতটা আশাবাদী? বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে পারে?

অবশ্যই পারে, পারবে না কেন? বিশ্বকাপ জেতার জন্য যে মানসিক শক্তি প্রয়োজন, তা এ দলের একটু কম আছে৷ কয়েকটি ফাইনালের হার দেখলে হয়তো তা বুঝবেন৷ ওই মানসিক শক্তিটা খুব দরকার৷ সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের একটা টুর্নামেন্ট যদি আমরা জিততে পারতাম, তাহলে আরো সাহসের সঙ্গে বিশ্বকাপ জয়ের কথা বলতে পারতাম৷

‘বিশ্বকাপে তরুণদের ওপরও ভরসা করছি’

তাহলে কি বলতে চাইছেন, ক্রিকেটীয় দক্ষতার দিক থেকে বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য এখনকার বাংলাদেশ দলের রয়েছে?

আমি অবশ্যই তা মনে করি৷

আপনার এত আত্মবিশ্বাসের কারণ কী?

কারণ, আমাদের দলে কী নেই! বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আমাদের দলে৷ ওয়ানডের বিশ্বসেরা একাদশে সম্প্রতি মুস্তাফিজ সুযোগ পেয়েছে৷ ইনজুরিতে না পড়লে তামিম ২০১৮ সালে এক হাজার রান করতে পারত৷ মুশফিক টেকনিক্যালি বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান৷ ফিনিশিংয়ে রিয়াদ আছে৷ বোলিংয়ে আমার অনেক বছর খেলার অভিজ্ঞতা; রুবেলও ১০ বছর ধরে খেলছে৷ আমাদের নেই– এমন কিছু নেই৷ যেটির অনুপস্থিতি, তা হলো ওই মানসিক শক্তি৷

গত বছর বাংলাদেশ যে দুটি ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছে, সেই ত্রিদেশীয় সিরিজ ও এশিয়া কাপের মধ্যে কোনোটির শিরোপা জিতলে কি আপনার বিশ্বাস অনেক বেশি থাকত না?

শুধু আমার না, শুধু সব ক্রিকেটার না, সব সমর্থকও এটি বিশ্বাস করত যে, এ পর্যায়ের ট্রফি জিততে পারলে বিশ্বকাপও জিততে পারবে বাংলাদেশ৷ ধরুন, ভারতকে যদি এশিয়া কাপের ফাইনালে হারাতাম, তাহলে কী হতো৷ ভারত তো বিশ্বকাপ জিতেছে, এবারও অন্যতম ফেভারিট৷ ওদের সঙ্গে জিততে পারলে সবার আত্মবিশ্বাস থাকত অন্যরকম৷

বিশ্বকাপের ফরম্যাট এবার বদলেছে৷ গ্রুপ পর্ব নেই, বরং ১৯৯২ আসরের মতো সবাই সবার সঙ্গে খেলবে৷ এটি কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হলো ,নাকি আরো কঠিন হলো?

বলা যাচ্ছে না৷ গ্রুপে তিন-চারটি কিংবা গতবার যেমন ছয়টি ম্যাচ খেলেছি, তখন মাথায় রাখতে হয় যে, পা হড়কানো যাবে না৷ এবারের ফরম্যাটে সুবিধা হলো, একটা খারাপ ম্যাচ গেলেও ফিরে আসার সুযোগ থাকবে৷ রানরেটের ব্যাপারও আছে৷ আসলে প্রথম ম্যাচটি গুরুত্বপূর্ণ৷ একইসঙ্গে যেটি বললাম, মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাটা জরুরি৷

‘যাঁরা এক বেলা, দুই বেলা না খেয়ে থাকেন তাঁদের জন্য কিছু করতে পারলে হাজার গালিও কোনো সমস্যা না’

প্রথম লক্ষ্য তো নিশ্চয়ই সেমিফাইনাল খেলা৷ তা পূরণের জন্য ৯ ম্যাচের মধ্যে কয়টি জেতার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বকাপে যাবেন?

হিসেব বলে, পাঁচ ম্যাচ জিতলে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ থাকবে৷ অবশ্যই প্রতিটি ম্যাচ জয়ের জন্য মাঠে নামবো৷ তবে আমার কাছে মনে হয়, সেমিতে যাওয়ার জন্য যে কয়টা ম্যাচ জেতা দরকার, ততটা জিতলেই যথেষ্ট৷

বাংলাদেশ এখন ওয়ানডেতে সব দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে৷ তবু যদি বলেন, কোন পাঁচটি দলকে টার্গেট করছেন?

এভাবে বলা কঠিন৷ আমাদের প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে৷ টার্গেট করতে হবে, আমরা যেন ওদের বিপক্ষে জিততে পারি৷ যদি টার্গেট করে যাই যে, ‘একে-ওকে হারাবো’ তাহলে সে ম্যাচগুলোয় বেশি মনোযোগ থাকবে আর অন্যগুলোয় কোনো সুযোগই থাকবে না৷ এটি বাড়তি চাপ৷ এ কারণেই আমি ম্যাচ ধরে ধরে এগোনোর পক্ষে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ জয়ের লক্ষ্য নিয়েই তাই আমাদের যাওয়া উচিত৷ আর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ জিতলে বাকি সব সহজ হয়ে যাবে৷ কারণ, ক্রিকেটে জয় এমন এক জিনিস, যা আগের-পরের সব বদলে দলকে ভালো এক জায়গায় দাঁড় করায়৷

এটা কি অনেকটা ২০০৭ বিশ্বকাপের মতো? সেবার প্রত্যাশা এবারের মতো বেশি ছিল না, তবে ভারতের বিপক্ষে প্রথম খেলায় জয় পাবার পর পুরো দলের চেহারাই বদলে যায়...

বলতে পারেন৷ এবার আমরা প্রথম ম্যাচ খেলেছি টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা এবং ফেভারিট দলের সঙ্গে৷ নিজেদের সেরা ক্রিকেট খেলতে পারলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো সম্ভব৷ ওই মানসিকতা নিয়েই বিশ্বকাপে যেতে হবে৷ আমার মনে হয়, বাকি আট ম্যাচের লক্ষ্য এখন ঠিক না করে প্রথম ম্যাচে জয়ের লক্ষ্য স্থির করা দরকার, কেননা, অনেক সময়ই প্রথম ম্যাচ পুরো টুর্নামেন্টের ছন্দ ঠিক করে দেয়৷

কিছু দিন পর নিউজিল্যান্ড সফরে যাবে বাংলাদেশ৷ এটি বিশ্বকাপ প্রস্তুতিতে কতটা সাহায্য করবে?

খুব সাহায্য করবে, কেননা, নিউজিল্যান্ডের উইকেট অনেকটা ইংল্যান্ডের মতোই৷ বিপিএলে আমাদের রংপুর রাইডার্সে ইংল্যান্ডের যেসব ক্রিকেটার রয়েছেন, সেই রবি বোপারা, অ্যালেক্স হেলসের কাছ থেকে কিছু তথ্য নিলাম৷ ওরা বলেছে, যদি ভালো অবস্থায় টুর্নামেন্টের পরের অংশে ঢুকতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে, কেননা ওই সময় নাকি ইংল্যান্ডের উইকেটে বল কিছুটা স্পিন ধরা শুরু করবে৷

নিউজিল্যান্ড সফরে আপনার প্রত্যাশা কেমন? সেখানে চারটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে যে ২০টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ, হেরেছে সবগুলোতে৷ ২০১৫ বিশ্বকাপের স্বাগতিকদের বিপক্ষের ম্যাচেও তাই৷ সামনের সফর তাই কতটা কঠিন হবে?

আমরা নিজেদের সামর্থ্যের সেরা জায়গায় আসার পর তো নিউজিল্যান্ডে খুব বেশি খেলিনি৷ সেখানে খেলা চ্যালেঞ্জিং অবশ্যই৷ হয়তো ভারত ছাড়া অন্য সব দলই নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ধোঁকে৷ তবে আমি মনে করি, বিশ্বকাপের আগে ওখানে খেলার চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য ভালো৷

বিশ্বকাপের ১৫ সদস্যের স্কোয়াডের সদস্যই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু যখন কাপ জয়ের লক্ষ্য নিয়ে টুর্নামেন্টে যাচ্ছেন, তখন বিশেষ করে কাদের কাছ থেকে ভালো পারফরম্যান্স চাইবেন?

সবাই তো একবাক্যে আমাদের সিনিয়রদের কথা বলবেন৷ আমি কিন্তু এর উপর নির্ভর করি না৷ আপনি লিটন দাশকে দেখুন৷ এশিয়া কাপ ফাইনালে ও যে ইনিংস খেলেছে, দল জিতলে তা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ইনিংস হয়ে থাকত৷ এখনো তা রয়েছে অবশ্য; জিতলে আলাদা মাত্রা পেতো৷ তো লিটনের এই সামর্থ্য যখন দেখেছি, ওর কাছ থেকে বিশ্বকাপে সেরাটাই আশা করব৷ সৌম্য আছে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওর ইনিংসগুলোর কথা মনে আছে৷ তো আমি কেন ওদের কাছ থেকে এমন কিছু আশা করব না! ২০১৫ সালে আমাদের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পেছনে তরুণ ক্রিকেটারদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি ছিল৷ এ কারণেই সিনিয়রদের চেয়ে আমি এই তরুণ ক্রিকেটারদের গুরুত্ব কোনো অংশে কম দেখি না৷

২০১৫ বিশ্বকাপের আগের সময়টা বাংলাদেশের ভালো যায়নি৷ ঠিক আগের সিরিজে ওয়ানডের অধিনায়ক বদলে আপনাকে নেতৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়৷ তুলনায় এবার দলের অবস্থা ভালো৷ মাঝের চার বছর তো বটেই, গেল বছরটাও বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো কেটেছে৷ এটি ২০১৯ বিশ্বকাপে কতটা সাহায্য করবে?

জয় আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ এটি দলের আত্মবিশ্বাস অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়৷ সামনে আমরা নিউজিল্যান্ড যাবো, এরপর আয়ারল্যান্ডে৷ বিশ্বকাপের আগে এই সফরগুলোয় আমি জয়ের ধারায় থাকতে চাইবো, যেন বিশ্বকাপে ভালো মানসিকতা নিয়ে যেতে পারি৷ তবে না জিতলেও সমস্যা নেই৷ ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচে পাকিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরেছি৷ তখন আমাদের উপর কারো কোনো প্রত্যাশা থাকেনি৷ এরপর আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি৷ তবে সামনের এই দুটো সফরে জেতার মধ্যে থাকলে ভালো৷

দলীয় পারফরম্যান্স থেকে এবার একটু আপনার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জায়গায় আসি৷ বিশ্বকাপের জন্য বোলার হিসেবে প্রস্তুতি কেমন?

এখনো অত দূর ভাবছি না৷ ওভাবে ভেবে আমি পারিও না৷ এখন বিপিএল চলছে৷ তা শেষ হলে নিউজিল্যান্ড সফর নিয়ে চিন্তা করব৷

বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের বদলে যাওয়ায় অধিনায়ক মাশরাফির বড় অবদান৷ সে কৃতিত্ব সবাই আপনাকে দেন৷ কিন্তু তাতে যে বোলার মাশরাফি একটু আড়ালে চলে যায় এ নিয়ে  কি দুঃখ আছে? 

(হেসে) না, একেবারেই না৷ মানুষ যদি কোনো পর্যায়ে এসে মিলিয়ে দেখে, আমি বোলার হিসেবে সেরাদের কাছাকাছি পারফর্ম করেছি, দল জেতার জন্য যা করা দরকার করেছি, তাহলে ভালো লাগবে৷ নিজের কাছেই ভালো লাগবে৷ আর নিজের কাছে ভালো লাগাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শান্তি৷ তা বাদ দিয়ে আমরা অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি যে, আমাকে নিয়ে কী বলছে৷

একটা পরিসংখ্যান জানাই৷ আপনি এ দফা অধিনায়ক হবার পর যতগুলো ওয়ানডেতে খেলেছে বাংলাদেশ, সেখানে সর্বোচ্চ উইকেট আপনার৷ ৬৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৮৪ উইকেট৷ ৫৯ ম্যাচে ৭৬ উইকেট নিয়ে সাকিব আল হাসান দ্বিতীয়তে৷ কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার নেই, কিন্তু এই যে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার, তা ব্যক্তিগতভাবে নিশ্চয়ই তৃপ্তি দেয়?

ব্যক্তিগত তৃপ্তির ব্যাপার কী, অধিনায়ক যদি পারফর্ম করে সেটি দলের জন্য ভালো৷ অবশ্যই এতে আলাদা তৃপ্তি থাকে৷

আপনার ক্যারিয়ারে ইনজুরি হানা দিয়েছে বারবার৷ কিন্তু এ দফা অধিনায়ক হবার পর ইনজুরির কারণে একটি ম্যাচও মিস করেননি...

(হেসে দিয়ে) আল্লাহ মাফ করুক, এ কথা বলবেন না৷ নজর দিয়েন না...

এ সময় বাংলাদেশ ৬৬টি ওয়ানডে খেলেছে, যার মধ্যে তিনটিতেই কেবল আপনি খেলেননি৷ ধীরগতির ওভাররেটে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় ২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, আর অধিনায়ক হিসেবে ওই ধীরগতির ওভাররেটের জন্য শাস্তি পেয়ে ২০১৫ সালে পাকিস্তান এবং ২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচ৷ দুই হাঁটুতে সাতটি অস্ত্রোপচার হওয়া ক্রিকেটারের জন্য চার বছরের বেশি সময় নিজেকে প্রতিটি ম্যাচের জন্য ফিট রাখা কতটা কঠিন?

আমি সবকিছু রুটিন মেনে করার চেষ্টা করেছি৷ সঙ্গে ভাগ্যও পক্ষে ছিল৷ ভাগ্য না থাকলে আসলে এটি সম্ভব না৷ বিপিএল কিংবা ঢাকা লিগের ম্যাচের আগেও আমার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিতে হয়; রিল্যাক্সড হবার কোনো সুযোগ থাকে না৷ যে ম্যাচই খেলি না কেন, শারীরিকভাবে তো অনেক শক্তিক্ষয় হয়৷ সে প্রস্তুতি আমাকে রাখতে হয়৷ ওজন কখনো কমে, কখনো বাড়ে, এটিও একটি জায়গায় রাখার চেষ্টা করি৷ অন্যান্য সব জিনিস আমাকে ঠিক জায়গায় রাখতে হয়৷

অধিনায়কত্ব ক্যারিয়ারে কোন জয়গুলো বেশি আনন্দ দিয়েছে?

সত্যি বলতে কী, প্রতিটি জয় আনন্দ দিয়েছে৷ তবু নির্দিষ্ট করে বললে, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা, সর্বশেষ এশিয়া কাপে সাকিব-তামিম ছাড়া পাকিস্তানকে হারানো, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারানো– এমন কিছু ম্যাচ আছে৷ তবে আমরা যেহেতু নিজের দেশের পতাকার প্রতিনিধিত্ব করি, কোনো জয়ই তাই ফেলনা নয়৷ অনেকে হয়তো বলতে পারেন, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জেতা আর অমন কী! ভাই, হারলে বুঝি যে, কেমন কী! সে কারণেই বললাম, সব জয়ই আমার কাছে ভালো লাগে৷

আর কষ্টের হার? 

অধিনায়ক হবার পর তো?

হ্যাঁ৷

ভারতের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক রানে হারটা খারাপ লেগেছে৷ এবার এশিয়া কাপ ফাইনালের হার খারাপ লেগেছে৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ১২ বলে ১৩ রান প্রয়োজন ছিল– এ অবস্থা থেকে হেরেছি৷ আসলে এমন ক্লোজ ম্যাচগুলোতে হার কষ্ট দেয় বেশি৷ এসব খেলায় জিততে পারলে নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারতাম, দলের জন্য ভালো হতো৷

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের একটি জায়গা মিস করে গিয়েছি৷ বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আপনি দুশ 'ওয়ানডে খেলেছেন, আড়াইশ' উইকেট নিয়েছেন৷ পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব না দেবার কথা সবসময় বলেন, তারপরও যখন ক্যারিয়ার শেষ হবে, তখন এ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কতটা তৃপ্তি পাবেন?

আমি আসলে একটু অন্যরকম৷ এমন পরিসংখ্যান তো ভালো লাগারই কথা৷ ক্যারিয়ার শেষে না, এখনই ভালো লাগার কথা৷ কিন্তু জানি না, আমি তা কেন পরি না৷ হয়তোবা খেলার মধ্যে আছি বলে৷ যখন খেলা ছেড়ে দেবো, তখন হয়তো এ ব্যাপারগুলো মাথার মধ্যে বেশি করে আসবে৷ সত্যি যে, পরিসংখ্যান মাথায় রেখে আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম৷ যখন প্রথম টেস্টে চার উইকেট পাই, তখন স্বপ্ন হয়েছিল টেস্টে তিনশ’ উইকেট নেবোই৷ ওই দিনই দলের সঙ্গে সোনারগাঁ হোটেলে ফিরে ডায়েরিতে তা লিখে রেখেছিলাম, তারিখ-টারিখ দিয়ে৷ ওয়ানডেতে কোনো টার্গেট ছিল না, কিন্তু লক্ষ্য ছিল টেস্টে তিনশ’ উইকেট নেবো৷ তখন আমার বয়স ১৭-১৮ বছর৷ ছোটবেলার স্বপ্ন তৈরি হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে৷ তো ইনজুরির কারণে ওই টেস্টের স্বপ্নে যখন আঘাত লেগেছে, এরপর আর পরিসংখ্যান-টরিসংখ্যান নিয়ে চলি না৷ স্রেফ খেলি, উপভোগ করি আর বাংলাদেশ ক্রিকেটকে প্রতিনিধিত্ব করি৷ এই প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে বড় অর্জন আমার জীবনে আর কিছু নেই৷ এর চেয়ে বড় কিছু আসবে বলেও মনে করি না৷ প্রতি ম্যাচে নামি এই ভেবে যে, খেলার কোনো ক্ষেত্রে আমার যেন একটু অবদান থাকে৷

কিছু দিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে আপনার অবসর নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল৷ বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে জাতীয় দলের আর খেলা নেই বলে বাংলাদেশে সেটিই আপনার সম্ভাব্য শেষ ম্যাচ ধরে নেন অনেকে৷ সিলেটে শেষ ওয়ানডের পর আপনি যদিও স্পষ্ট করে বলেছেন, বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফিরে অবসরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন৷ সিলেটের ওই ম্যাচের পরও তো মাসখানেক পেরিয়ে গেছে৷ এ সময়ে কখনো কি মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে আর হয়তো আপনার খেলা হবে না?

দেখুন, আমার ক্রিকেটীয় শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে যাবে না৷ পায়ে এখন আগের চেয়ে বেশি ব্যাথা করে৷ আগের চেয়ে বেশি জিম করলেও ব্যাথা যায় না৷ ম্যাচ শেষে পা সামলাতে অনেক সময় লাগে৷ আগে এক দিনে সামলে উঠতাম, এখন সময় লাগে আরো বেশি৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং আমার পায়ের সমস্যা মিলিয়ে এগুলো হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে নিজেও পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমি আর বেশি দিন ক্রিকেটে থাকতে পারব না৷ সেটি যদি পারফর্ম করি, তবুও পারব না, কারণ, আমার শরীর সে সমর্থনটা দিচ্ছে না৷ বেশি দিন ক্রিকেটে থাকব না, সেটি তাই নিশ্চিত৷ কিন্তু কত দিন থাকব, তা নিশ্চত না৷ বিশ্বকাপ শেষে পরিস্থিতিই হয়তো ঠিক করবে কী করা উচিত৷ সেটি দলের ফলের উপর নির্ভর করতে পারে; আবার আমার শারীরিক অবস্থার উপরও নির্ভর করতে পারে৷ এগুলো নিয়ে আমি ভাবি না, কেননা, তা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই৷ এখন চেষ্টা করছি, বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলার জন্য যেন ফিট থাকি৷ ক্রিকেট আমার অনেক বড় আবেগের জায়গা৷ এটি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়াটা অত সহজ হবে না৷ কিন্তু আমি হুট করেই সিদ্ধান্ত নেবো৷ এটিই আমার চরিত্রের ধরণ৷

ছোট্ট করে একটু বিপিএলের কথা জানতে চাই৷ এই টুর্নামেন্টের পাঁচ আসরের মধ্যে চারটিতেই আপনি চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক৷ এর রহস্য কী?

আমার কাছে মনে হয়, এক্ষেত্রে আমি অনেক ভাগ্যবান৷ আসলে টুর্নামেন্ট জেতার জন্য ভাগ্য প্রয়োজন৷ পুরো টুর্নামেন্ট ভালো খেলেও ফাইনালের একটি খারাপ দিনে আপনি হয়তো শিরোপা জিতবেন না৷ সে কারণেই বলছি, ভাগ্য গুরুত্বপূর্ণ৷ আর দলকে অত দূর নিয়ে যাবার জন্য বলবো, আমাদের দলের সমন্বয়টা ভালো থাকে৷ এক-দেড় মাস সবাই একসঙ্গে থাকায় সেটি গুরুত্বপূর্ণ৷ এ ধরনের টুর্নামেন্টে আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু করার থাকে না৷

এবার রংপুর রাইডার্সকে নিয়ে প্রত্যাশার জায়গা?

(হেসে) আমরা তো প্রায় বাদই হয়ে গিয়েছিলাম৷ সেখান থেকে তিনটি ম্যাচ জিতে রেসে ফিরে এসেছি৷ এখন তাই একটু ভালো জায়গায়৷ প্লে-অফে যাবার পর তো বাঁচা-মরার লড়াই৷ সেখানে যাওয়াই প্রাথমকিভাবে গুরুত্বপূর্ণ৷

একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে একটু রাজনীতির কথা জানতে চাই৷ এখন তো আপনি বাংলাদেশের একজন মাননীয় সংসদ সদস্য৷ রাজনীতিতে যোগ দেবার কারণটা একটু যদি বলেন...৷ আর সংসদ সদস্য হবার পর দায়িত্বের জায়গায় কতটা পরিবর্তন হয়েছে?

এখনো যেহেতু খেলার মধ্যে আছি, পরিবর্তন ততটা আসেনি৷ আর যোগ দিয়েছিলাম, রাজনীতি করলে সাধারণ মানুষের পাশে থাকা যায়; তাঁদের জন্য কাজ করা যায় বলে৷ মানুষের জন্য এমন কাজ আমি ছোটবেলা থেকেই উপভোগ করি৷ আর সুযোগটা তো অবশ্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন৷ নইলে তো রাজনীতিতে আসার কোনো সুযোগ ছিল না৷ আর পরিবর্তনের কথা বললে, খেলোয়াড়ী জীবন শেষেই হয়তো বড় করে তা আসবে৷ আমার কাছে মনে হয়, যদি সত্‍ভাবে কাজ করা যায়, তাহলে রাজনীতিতে ভালো কিছু করার সুযোগ আছে৷

তার মানে আপনি খেলা ছাড়ার পরই পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হবেন? এখনো আপনার প্রথম অগ্রাধিকার খেলা?

অবশ্যই খেলা৷ তবে খেলার বাইরের সময়টায় এখন মানুষের চাহিদা মেটানোর কথা ভাবি৷ যেহেতু আমি নড়াইল-২ আসনের প্রতিনিধি, ওখানে কোনো সমস্যা থাকলে তা সামলানোর চেষ্টা করি৷ তবে অমন বিরাট পরিবর্তন এখনো আসেনি৷ রাজনীতিতে যোগ দেবার ঘটনা তো মাত্রই ঘটল৷ বড় পরিবর্তন তাই আসেনি৷

অন্য একটি পরিবতন কি এসেছে? আগে ক্রিকেটার হিসেবে আপনি ছিলেন পুরো দেশের৷ এখন একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন৷ অনেকে আছেন, যিনি ক্রিকেটার মাশরাফির ভক্ত কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আপনার সঙ্গে মেলে না, যে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আপনার এ রাজনীতিতে যোগ দেবার অনেক রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

এখানে কিছু করারও তো নেই৷ মতের পার্থক্য তো থাকবেই, খুব স্বাভাবিক৷ সেটি তাঁরা বলছেন৷ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা ব্যক্তিগত আক্রমণ বা পরিবারকে আক্রমণ প্রতিনিয়ত করছি৷ এতে সবাই অভ্যস্ত৷ আমি মনে করি, মানুষকে ভালোর মধ্যে রাখতে হলে তাঁদের নিয়ে ভালো মন্তব্য করা উচিত আর মানুষকে ভালোবাসা উচিত৷ যখন আপনি একজন মানুষকে গালিই দিতে থাকবেন, তখন সে দিনশেষে চিন্তা করতে পারে, ‘‘আমি যত ভালো কাজই করি না কেন, আমার জন্য গালি অপেক্ষা করে আছে৷ আমার জন্য তাই ভালো কিছু করার প্রয়োজন নেই; ভালো কিছু করার কোনো মানেই হয় না৷’’ এ ভুলটা আমরা প্রায়ই করি৷ আপনি যখন কারো কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করবেন, তখন সমালোচনা করলেও গঠনমূলক সমালোচনা করুন৷ তাঁর ভুলগুলো ভুলের মতো তুলে ধরুন৷ একইসঙ্গে তাঁর ভালো জিনিসগুলোও তুলে ধরা উচিত৷ এখন প্রশ্নটি আমার রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে করেছেন, অবশ্যই এখানে মতের পার্থক্য আছে৷ আমি একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করি৷ কিন্তু আমি অন্য দলের কাউকে তো অসম্মান করছি না৷ সেটি করার প্রশ্নই ওঠে না৷ খুব সাধারণভাবে দলের মধ্যে থেকে, সরকারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এলাকার মানুষের পাশে থাকতে চাই৷ সে কারণে কেউ যদি আমাকে যা খুশি বলেন, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার৷ এ বিষয়ে আমার কিছু বলারও নেই, কিছু করারও নেই৷ আর কিছু করার থাকলেও করতে চাই না৷ কারণ, এ প্রতিহিংসার ব্যাপারটি ভালো না; আমি তা পছন্দ করি না৷ আমি স্বাভাবিক আছি, স্বাভাবিকই থাকতে চাই৷ কর্মেই তো মানুষের পরিচয়৷ কর্ম যদি ঠিকমতো করতে পারি, তাহলে হয়তোবা মানুষ ভুল বুঝতে পারবে না৷ এ আশায়ই এখন আমার থাকতে হবে৷

আপনি সংসদ নির্বাচনের আগে খুব অল্প সময় এলাকায় গিয়ে প্রচারণা করেছেন৷ সময়টা কত রোমাঞ্চকর ছিল, যদি ক্রিকেট ম্যাচের সঙ্গে তুলনা করেন?

নড়াইলের মানুষ আমাকে পছন্দ করেন, এটি জানতাম৷ কিন্তু আমার জন্য কী যে আবেগ, অনুভূতি নিয়ে গত ১৮ বছরে তাঁরা ছিলেন, তা আমি এবার দেখতে পেরেছি৷ এটি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে৷ সে আনন্দের পাশে এই চার-পাঁচটি, দশ-পঞ্চাশটি গালি কোনো সমস্যা না৷ যদি সত্যি তাঁদের জন্য কিছু করতে পারি, সেটি আমাকে আনন্দ দেবে৷ এমন কিছু মানুষ দেখেছি, যাঁরা এক বেলা খান, দুই বেলা না খেয়ে থাকেন৷ তাঁদের জন্য কিছু করতে পারলে হাজার গালিও কোনো সমস্যা না৷

একেবারে শেষ প্রশ্ন৷ আপনার ক্রিকেট ক্যারিয়ার প্রায় শেষের দিকে৷ তা শেষেও হয়তো ক্রিকেটের সঙ্গে থাকতে পারতেন৷ অথবা ক্রিকেটের বাইরে গিয়ে নিজের মতো কাজ করতে পারতেন৷ এখন যে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, সে জীবনের তো কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই৷ আপনার কি মনে হয়, ক্রিকেটার মাশরাফির শেষ হতে হতে রাজনীতিবিদ মাশরাফির যে শুরু হলো, তাতে আপনি সবসময়ই প্রাসঙ্গিক থাকবেন বাংলাদেশে?

ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারেন না৷ আর আমি এগুলো সব সময় এড়িয়ে চলি৷ তারপরও বলি, আপাতত পাঁচ বছরের জন্য আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছি৷ আগেই বলেছি যে, এখনো আমার কাছে খেলাটাই অগ্রাধিকার৷ ক্যারিয়ার শেষে পুরোপুরি রাজনীতির দিকে যাবো৷ আপাতত এই পাঁচ বছরকে কেন্দ্র করেই কাজ করার চেষ্টা করব৷ এ সময়ে আমার পক্ষে যা কিছু সম্ভব, সব করবো৷ পাঁচ বছর পর কী হবে, সে জায়গায় নিজেকে এখনই দাঁড় করাতে চাই না৷ অনেক কিছুই তখন বদলে যেতে পারে৷ আপাতত তাই এই পাঁচ বছরের দিকেই সমস্ত মনোযোগ দিচ্ছি৷

ক্রিকেটের মতোই? আপাতত নিউজিল্যান্ড সফর? আপাতত আয়ারল্যান্ড সফর? আপাতত বিশ্বকাপ?

হ্যাঁ৷ যেহেতু আমি খেলোয়াড়, ছোটবেলা থেকেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খেলোয়াড়দের মতো হয়ে গেছে৷ সে জায়গায় তো পরিবর্তনের সুযোগ কম৷