1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

বিচারপতিদের লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপকারীদের শাস্তি দাবি

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৮ নভেম্বর ২০২৪

এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি৷ তবে ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা বলছেন, শুধু প্রধান বিচারপতির বিবৃতি যথেষ্ট নয়৷

https://p.dw.com/p/4nXVi
Bangladesch Gerichtshof in Dhaka
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার ঘটনা শুধু একজন বিচারকের উপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের উপর আঘাত।''

এক বিবৃতিতে তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে এ ঘটনা।''

২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে করা মন্তব্যের জেরে বুধবার বিচার কাজ চলার সময় বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চে একজন আইনজীবী বিচারকদের উদ্দেশ্যে ডিম নিক্ষেপ করেন। এ ঘটনার এক পর্যায়ে বিচারকরা এজলাস ছেড়ে যান। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর মনে করছেন নিজেকে। যে ঘটনাটি ঘটে গেল, যারা এটা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। এটা তো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকলো। ভবিষ্যতে এই ঘটনা কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। একটা কোর্টে এটা হওয়া মানে পুরো জুডিশিয়ারিতেই হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ আদালতের একটা বেঞ্চে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো যেনতেন ব্যাপার নয়। আমরা আশা করেছিলাম, শুধু বিবৃতি নয়, কোনো একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন প্রধান বিচারপতি। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিচার করতে গিয়ে তিনি কোনো রায়ে কী লিখেছেন সে কারণে যদি অপদস্থ হতে হয়, তাহলে কোনো বিচারকই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বা মন্তব্য লিখতে পারবেন না।”

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না: অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ

প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে  সুপ্রিম কোর্টের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদবলেন,  ‘‘ডিম নিক্ষেপের ঘটনা শুধু একজন বিচারকের উপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের উপর আঘাত। শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে এ ঘটনা।'' সুপ্রিম কোর্টের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিবৃতির কথা জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বুধবার সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে নজিরবিহীন, অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে এবং সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের বিভিন্ন জেলা আদালতে যেসব অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেসব বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেছেন, দেশের আদালতগুলো যাতে বিচারপ্রার্থীদের নির্বিঘ্নে সেবা দিতে পারে, সে লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সামগ্রিক বিষয়াবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রধান বিচারপতি দেশের আদালতগুলোতে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

সেদিন যা ঘটেছিল

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন আইনজীবী জানান, বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে ওই বেঞ্চে বিচারকাজ চলছিল। কার্যতালিকার ১২ নম্বর আইটেম শুনানির সময় কয়েকজন আইনজীবী দলবেঁধে এজলাস কক্ষে ঢুকে সরাসরি ডায়াসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের একজন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘একজন বিচারপতি হয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে রায়ে রাজনৈতিক ভাষায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আপনি এমনটা করেছেন। ফলে আপনার শপথ ভঙ্গ হয়েছে। বিচারকাজ পরিচালনা করার অধিকার হারিয়েছেন আপনি। আপনি এখনও যদি একই চিন্তা-ভাবনা পোষণ করেন, তাহলে আপনার বিচারকাজ পরিচালনার অধিকার নাই।'' এসময় আরেকজন আইনজীবী বিচারপতি আশরাফুল কামালকে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। তখন পেছন থেকে একজন ডিম ছুঁড়ে মারেন, তবে সেই ডিম বিচারপতির গায়ে লাগেনি। এরপর হট্টগোল শুরু হলে দুই বিচারপতি এজলাস ত্যাগ করেন।

বৈঠকে পরিকল্পনা করে ডিম ছোঁড়ার অভিযোগ

সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আগে থেকে পরিকল্পনা করে এভাবে আদালতের প্রতি অবমাননা করা বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা চাই, এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আগেও কিন্তু আদালত অবমাননার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বুধবারের ঘটনায় আমরা কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এমনকি আইন উপদেষ্টাও কোনো কথা বলেননি। তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।” 

সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা জেনেছি, সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের জুনিয়ররা এই কাণ্ড করেছেন। এর আগে তারা বৈঠক করেছেন। পরিকল্পিতভাবে এই ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগের উপর চরম আঘাত। এক সময় আমরা থাকবো না, কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটা ধ্বংস হলে দেশের ক্ষতি হবে। বুধবার একই সঙ্গে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মুন্সী মশিয়ার রহমানের কক্ষের সামনের নামফলক খুলে ফেলে সেখানে ‘শেখ হাসিনার দোসর' লিখে ঝুলিয়ে দেয়। আমাদের বুঝতে হবে তিনি একজন জজ পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। এটাও তো আদালতের প্রতি অবমাননা।”

জড়িতদের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে

বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার সঙ্গে জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর এমন তথ্য জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা সাক্ষাৎ করেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। আদালত চলাকালীন কিছু আইনজীবী, মুখোশ পরা, ডিম ছুঁড়ে মারছিল। আমরা মনে করি, চট্টগ্রামের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতায় এটা সুপ্রিম কোর্ট ও বিচার বিভাগে আতঙ্ক সৃষ্টি করার প্রয়াস। এই দুর্ঘটনা শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি একটা হুমকি। প্রধান বিচারপতি তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।''

আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘‘এটা কঠিনভাবে দেখা হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমরা সবাই একমত হয়েছি। এজন্য আমরা (সুপ্রিম কোর্ট বার) একটা তদন্ত কমিটি করবো। সিসিটিভি ফুটেজ আছে। কোর্টে আইনজীবীও ছিল। সেটার বেসিসে রিপোর্ট দিবে। যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর মধ্যে তাদের মেম্বারশিপ বাতিল হতে পারে। এমনকি বার কাউন্সিলের সনদ বাতিল হতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এ ধরনের ঘটনা বরদাশত করে না। যে দলেরই হোক না কেন, এরকম পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের সুনাম ক্ষুন্নের পাশাপাশি পলাতক স্বৈরাচারের ইন্ধন থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।‘‘

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট দেশের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান না। দেশের মধ্যে যে অবস্থা চলে, এখানে তার প্রতিফলন ঘটে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না। প্রধান বিচারপতি দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছে বলে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষা পেয়েছে। এটা না হলে বিচার বিভাগ অধঃপতনে যেতো। মর্যাদা থাকতো না। মর্যাদা ধ্বংসের কাজ তো এবারই প্রথম না। আগেও আমরা দেখেছি প্রধান বিচারপতিকে কিভাবে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তখন থেকেই এই বিষয়গুলো চলছে। প্রধান বিচারপতির বিবৃতি প্রমান করে, আমরা আগের অবস্থা থেকে বের হতে পারিনি। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

নিম্ন আদালতের পরিস্থিতি

মানহানির অভিযোগে করা মামলায় আত্মসমর্পণ করে সাময়িক বরখাস্ত সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) তাপসী তাবাসসুম উর্মি জামিন পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইমরান আহম্মেদের আদালত শুনানি শেষে এ জামিন মঞ্জুর করেন। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একই আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। উর্মি আদালতে গেলেও সেখানে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। এতদিন ভিন্ন মতাদর্শের কেউ আদালতে গেলে, তাদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এবার দেখা গেল ভিন্ন পরিস্থিতি।

গত ৮ অক্টোবর তাপসী তাবাসসুম উর্মিকে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসেনের আদালত ২৮ নভেম্বর আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ২৮ নভেম্বর তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির হতে সমন জারি করেন বিচারক। এর আগে গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ বাদী হয়ে একই আদালতে তাপসীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম উর্মির বিরুদ্ধে মানহানির এ মামলার আবেদন হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে আবু হানিফ বাদী হয়ে এ আবেদন করেন। বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড শেষে এ বিষয়ে আদেশ হবে বলে জানান আদালত। বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. খাদেমুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।