বাংলাদেশ রেলওয়ে বদলে যাবে ‘আন্তরিক নজরে'
৪ অক্টোবর ২০১৯৬০টি ওয়াগনের মালবাহী ট্টেন এক গ্যালন জ্বালানি তেলে এক কিলোমিটার চলতে পারে৷ একই ওজনের পণ্য পরিবহণে লাগে ২১০টি ট্টাক৷ ট্টাকগুলোয় এক কিলোমিটার পথ চলাচলে লাগে ২১ গ্যালন জ্বালানি৷ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রীপিছু জ্বালানি খরচ পড়ে ০.৯৫ থেকে ১.০৬ লিটার৷ একই পথে বাসে একজন যাত্রী পরিবহণে ৪.০০ থেকে ৬.২২ লিটার জ্বালানি লাগে৷ তার মানে, রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে খরচ কম৷ কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে বিষের মাত্রা বাড়ে৷ বাংলাদেশে বাতাসে নির্গত ২০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহণ থেকে আসে৷ সড়কযান থেকেই নির্গত হয় ৯০ শতাংশ৷ ট্টেনে জ্বালানি খরচ যেমন কম, তেমনি পরিবেশ দূষণষও কম৷ ট্টেনের চেয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে ৮.৩ গুণ ও ট্টাকে ৩০ গুণ বেশি দূষণ হয়৷ সড়কে বছরে যেখানে গড়ে ১২ হাজার দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানে রেলপথে তা অনেক কম৷ ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি অংশে ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে৷ দেড়শ বছরে রেলপথ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৯০০ কি.মি.৷ তবে ৬৪টি জেলার মধ্যে ২০টিতে রেল যোগাযোগ নেই৷ এখনো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের কিছু জেলা রেল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন৷ তাই বাংলাদেশ রেলওয়েকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক কাজ বাকি৷ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল-সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্তও রেলপথ হবে৷ স্বাধীনতার পর অবহেলিত বাংলাদেশ রেলপথে অবকাঠামো উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে৷ এখন বছরে প্রায় ১০ কোটি যাত্রী পরিবহণের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে৷ নিরাপদ যাতায়াতের জন্য যাত্রীরা রেলের দিকেই ঝুঁকছে৷ কারণ, সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলায় প্রাণহানি বাড়ছে৷ দিনে গড়ে অন্তত ১০ ব্যক্তির প্রানহানি ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনায়৷
তবে বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিপুল বিনিয়োগে হলেও সে তুলনায় যাত্রীসেবা কম৷ যাত্রীসেবা কাঙ্খিত মাত্রায় উন্নীত না হলে রেলপথ বাড়িয়ে, ট্টেন বাড়িয়ে কোনো সুফল মিলবে না৷
রেলপথ ও রেলসেতু নির্মাণ ছাড়াও যাত্রীসেবা বাড়িয়ে রেলকে বদলে দিতে হবে, কারণ, রেল বদলে গেলে দেশের অর্থনীতি আরো ইতিবাচকভাবে বদলে যাবে৷ গত ১০ বছরে ৮১টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল৷ এখন সোয়া লাখ কোটি টাকার ৪৮টি প্রকল্পের কাজ চলছে৷ বিপুল বিনিয়োগ হলেও গতি আসেনি ট্রেনে৷ কারণ, ঢাকায় ব্রডগেজ ও মিটার গেজের ৩৫ কি.মি. রেলপথে ট্টেন চলে গড়ে ২০ কি.মি. গতিতে৷ কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার পেরোতেই লাগে প্রায় আধ ঘণ্টা৷
সরকার দেশের সব রেলপথ ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন করার নীতি গ্রহন করেছে৷ তবে তাতেও গতি বাড়ছে না৷
তার ওপর এখন ৬৮ শতাংশ রেল ইঞ্জিনের আয়ুও নেই৷ ট্টেন চলার সময় লাইন থেকে পড়ে যায় ইঞ্জিন৷ ইঞ্জিন বিকল হয়ে বা রেলপথে ত্রুটির ফলে ট্টেনের চাকা পড়ে যায়৷ ৭৩ শতাংশ ট্টেন দুর্ঘটনার বড় কারণ লাইন থেকে চাকা পড়ে যাওয়া৷ রেলসেবা বাড়াতে হলে ট্টেন বাড়াতে হবে৷ তবে তা বাড়ানোর আগে খতিয়ে দেখতে হবে তা লাভজনক হবে কিনা৷ বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহণ বন্ধ করতে হবে৷ ঢাকা থেকে পঞ্চগড় রুটে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস চালুর পর তাতে লাভ হচ্ছে না৷ ঢাকা-রাজশাহী রুটের নতুন ট্রেন চালুর পরও তাতে লাভ হচ্ছে না৷ আবার ঢাকা কুড়িগ্রাম রেলপথে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর প্রস্ততি চলছে৷ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ ট্টেন চালুর আগে কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি৷ ঢাকা-সিলেট রুটে যাত্রী বেশি থাকলেও ট্টেন বাড়ানো হচ্ছে না৷ বিরতিহীন ট্টেনও এ রুটে নেই৷ সিলেট থেকে ঢাকার কমলাপুরে ঢোকার আগে পারাবত ট্রেন রাতে প্রায়ই আটকে থাকে টঙ্গীতে৷ রেলপথে বিরতিহীন ছাড়া অন্য সব ট্রেনের বিরতি স্থান বেশি৷ রাজনৈতিক কারণেও বিরতির স্থান বাড়াতে হচ্ছে বিভিন্ন রেলপথে৷ ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ট্রেনের গতি বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা বাড়ানো যাচ্ছে না৷ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে৷ এজন্য দরকার রেলে সুশাসন ও জবাবদিহিতা৷ ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত দুটো বাড়তি লাইন নির্মানের কাজ সাত বছর পর শুরু হয়েছে৷ রেলমন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন দিন কয়েক আগে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে বলেছেন, কাজ কোনো প্রক্রিয়ার অজুহাতে ফেলে রাখা যাবে না৷ তাঁর এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার জন্য যুথবদ্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারী রেলে কম৷ এজন্য তদারকি জোরদার করতে হবে৷
জাপান ও ভারতসহ বিশ্বের ৫৫টি দেশের দেড়শ' নগরীর যোগাযোগব্যবস্থা রেলনির্ভর৷ বিশ্বব্যাপী রেলের রূপালি যুগ চলছে৷ চাহিদা থাকায় বাংলাদেশে রেল সম্ভাবনা উজ্জ্বল৷ বাংলাদেশ রেলে সোনালি যুগের সূচনা করার সময় বয়ে চলেছে৷ দেশের ভেতরে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে রেল৷ এছাড়া ভারত, নেপাল, মিয়ানমারের সঙ্গে আঞ্চলিক সংযোগ, এমনকি ইরান পর্যন্ত সংযোগ তৈরিরও সুযোগ রয়েছে৷ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে ভারত সেবা কিনে নিতে পারে৷ তা সামনে রেখে আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে ১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়্ হয়েছে৷
রেল নিয়ে নতুন মন্ত্রণালয় হয়েছে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর৷ আগামী সাত বছরে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে রেলের অবকাঠামো উপযোগী হয়ে উঠতে পারে৷
আমলাতন্ত্রের বৃত্ত থেকে বের হয়ে রেলওয়ে কর্মকর্তাদেরই মূল ক্ষমতা দিয়ে প্রশাসনিক সংস্কারও দরকার৷ সড়ক পরিবহনের মালিকদের চাপ শক্ত হাতে দমন করে রেলসেবার বিস্তৃতি বাড়াতে হবে৷
ঢাকায় রেলনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা যানজট নিরসন করতে পারে৷ ৮০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের জন্য অবশ্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ এটি হবে বৃত্তাকার রেলপথ৷
ভারতের রেল বোর্ডের মতো বাংলাদেশেও রেলওয়ের আলাদা বোর্ড হতে পারে৷ রেলের মহাপরিচালক থাকবেন সিদ্ধন্ত গ্রহণের মূল ব্যক্তি৷ তাতে আমলাতন্ত্রের দাপট কমবে৷ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসংখ্য রেল সংযোগ আগে সচল ছিল৷ এগুলোও চালু করা দরকার৷
বাংলাদেশে ট্টেন চলাচলের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার৷ ভারত ২০২০ সালের মধ্যে তাদের ট্টেন চলাচলের গতি ৩৫০ কিলোমিটারে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে৷ বাংলাদেশে গতি ১৫০ কিলোমিটারে উন্নীত করা সম্ভব৷ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অধিকাংশ অংশ ডাবল লাইন করার পরও গতি বড়েনি৷ অবৈধ দখলবাজি ও কারিগরি দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারনে গতিশীলতা অর্জন করতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে৷
সৈয়দপুর ও পাহাড়তলী রেল কারখানায় আছেন দক্ষ কারিগররা৷ তাঁরা বানাতে পারেন ট্রেনের বগি৷ একটি বগি মেরামতে বেসরকারি খাতে খরচ হয় ২৯ লাখ টাকা৷ কিন্তু দেশের কারখানায় বগি তৈরিতে এই খরচ ১৪ লাখ টাকা৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ে আমদানিনির্ভরতা কমাতে পারে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷