1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিবাহবিচ্ছেদ কেন বাড়ছে?

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা১৯ অক্টোবর ২০১৪

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়ছে৷ আর এই বিবাহবিচ্ছেদে নারীরাই এখন এগিয়ে আছেন৷ বিচ্ছেদ কেন বাড়ছে? আর কেনইবা নারীরা এগিয়ে আছেন তা নিয়ে নানা কথা রয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে এটা সচেতনতার ফল না কথিত আধুনিকতার প্রভাব৷

https://p.dw.com/p/1DYDX
Symbolbild Scheidung Ehescheidung
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/dpa

ঢাকায় সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া এক নারীর সঙ্গে কথা বলছিলাম গত সপ্তাহেই৷ আগে থেকে জানাশোনার কারণে তিনি অনেকটা খোলামেলা কথাই বলেন৷ তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম বিচ্ছেদটা তিনি নিজেও চাননি৷ কারণ পূর্বরাগের কারণেই এক মেধাবী তরুণকে তিনি বিয়ে করেন৷ তাঁর মতে, বিয়ের আগের সেই পুরুষটি বিয়ের পরে অন্যরকম হয়ে যান৷ সারাক্ষণ সন্দেহ, আগের বন্ধুদের সহ্য না করা এসব নিয়ে সমস্যাতো আছেই এমনকি গায়ে হাত তুলতেও নাকি পিছপা হন না৷ তাই বিয়েটি এক বছরের বেশি টেকানো যায়নি৷

আমার পরিচিত নারীর সাফ কথা ‘‘সংসার নামের টর্চার সেলে থাকার চেয়ে বিচ্ছেদ অনেক ভাল৷'' তিনি বলেন, ‘‘সন্তান আসার আগেই বিচ্ছেদ হওয়ায় ভালো হয়েছে৷ সন্তান থাকলে তাদের উপর বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়তো৷ এখন যা হবার তা আমার নিজের হলো৷''

তবে একই রকম বিচ্ছেদের কাহিনী পুরুষের দিক থেকেও আছে৷ আর এসবে পরস্পরকে দোষারোপ অবধারিত৷ তবে কথা বললেই বোঝা যায় কোন পক্ষই এখন আর মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করতে চায় না৷ চায় না সারাজীবন অস্বস্তি আর ভালবাসাহীন সংসার ধর্ম পালন করতে৷

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনের কারণ কি? ব্যক্তির সচেতনতা বেড়েছে নাকি সামাজিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে? না কি প্রভাব পড়ছে নানা টিভি সিরিয়ালের? এসব দেখার আগে আমরা একটু পরিসংখ্যানটা দেখে নিই৷

পুরুষ ৩০ শতাংশ, নারী ৭০ শতাংশ

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দু'টি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় ২৩০৯টি, যার মধ্যে ১৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি৷ ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তালাকের সংখ্যা ৩৫৮৯টি৷ এর মধ্যে ২৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১২০৮টি৷ এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয়া পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ৷

একাধিক পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে মাত্র তিন বছরে ঢাকা শহরে তালাকের পরিমান বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ৷ মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের নারীদের আইনী সহায়তা কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, যত অভিযোগ নারীরা তাদের কাছে নিয়ে আসেন তার মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি সন্তানকে নিজের কাছে রাখার দাবি৷

কী কারণে তালাক হয়

জাতীয় মহিলা পরিষদ নারীদের তালাকের ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছে৷এগুলো হলো: যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি৷ পুরুষরা কেন স্ত্রীকে তালাক দেয় তা নিয়ে এরকম কোন আলাদা গবেষণার কথা আমার জানা নেই৷ তবে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এমন কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে কথা বলা জানা যায় তারা প্রধানত স্ত্রীর ‘চরিত্র দোষকেই' দায়ী করতে চান৷ আর এথেকে একটি বিষয় এখন স্পষ্ট যে ‘পরনারী' বা ‘পরপুরুষে' আসক্তির অভিযোগ বাড়ছে৷ এজন্য কেউ কেউ পাশের একটি দেশের হিন্দি এবং বাংলা টেলিভিশন সিরিয়ালকে দায়ী করতে চাইছেন৷ তাদের কথা হল এইসব সিরিয়ালের প্রধান উপজীব্যই হল ‘পরকীয়া প্রেম৷'

Ein Paar in Dhaka
নিজেদের মধ্যে শুরু থেকেই বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবেছবি: picture-alliance/dpa/A.Abdullah

তবে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের সচেতনতাও বাড়ছে৷ বাড়ছে স্বনির্ভরতা৷ তাই তারা এখন আর সব অত্যাচার এবং অনাচার মুখ বুজে সহ্য করতে চাইছেন না৷ তারা প্রতিবাদী হন৷ তাতেও প্রতিকার না হলে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্যের চেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদকেই শ্রেয় মনে করেন৷ আর সামাজে প্রচলিত ‘স্বামী বাইরে কী করল তা তার স্ত্রীর দেখার বিষয় নয়' - এই ধারণা এখন আর স্ত্রীরা মানতে নারাজ৷

এছাড়া নানা কারণে কিছু নারী-পুরষ উভয়ই বিয়ের পর বিবাহ বহির্ভূত রোমান্সেও জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা৷ আর তাও বিচ্ছেদ ডেকে আনছে৷ তবে সবচেয়ে বড় কারণ হল বিশ্বাসহীনতা ৷ নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে৷ এখন দু'জনই কাজ করছেন, বাইরে যাচ্ছেন৷ তাদের সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতি জনের সঙ্গে মিশছেন কথা বলছেন৷ আর এটা যে বাইরেই তা নয়৷ মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই যোগাযোগ সার্বক্ষণিক যোগযোগে পরিণত হয়৷

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচিতি এবং সম্পর্কের বহুমুখী ধারা তৈরি করেছে৷ আর এখানে স্বচ্ছতা না থাকলেই বিপর্যয়৷

Symbolbild Krise in der Familie
বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের উপরছবি: goodluz - Fotolia

আসল ক্ষতি হয় নারীর

নারীদের কাছ থেকে এখন বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসলেও বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের জন্য বাংলাদেশে আবার নারীদেরই ক্ষতির মুখে পড়তে হয় বেশি৷ বিবাহবিচ্ছেদের কারণে নারীকে সমাজের কাছে হেনস্তা হতে হয় নানাভাবে৷ বলা হয় ‘চরিত্রদোষের' কথা৷ আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে গিয়েও পড়তে হয় নানা প্রশ্নের মুখে৷

বিবাহবিচ্ছেদের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মত ঘটনাও কম নয়৷ মনোচিকিত্‍সকদের মতে এ ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাই বেশি৷ এর প্রধাণ কারণ আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি৷ এ দেশে বিবাহ বিচ্ছেদকে সাধারণ ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করা হয় না৷ আর বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় নারীকেই প্রধানত ‘দোষী' বলে গণ্য করা হয়৷ অনেক নারীই এই চাপ সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন৷

তবে বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান শিকার হন সন্তানরা৷ তারা বেড়ে ওঠে ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির' সন্তান হিসেবে৷ যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে৷ তারা এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে' ভোগে৷ মনোচিকিত্‍সকরা মনে করেন, ‘‘সন্তানরা যদি বাবামায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ এবং ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক৷ তারা সমাজকে, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে৷তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয়৷ যা ভয়াবহ৷''

তাহলে? এর জবাব কঠিন৷ কারণ বিবাহবিচ্ছেদ কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে উঠতেই পারে৷ তবে স্বামী বা স্ত্রীর মনে রাখা উচিত্‍ তাদের বিচ্ছেদ যেন অন্যের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে৷ আর নিজেদের মধ্যে শুরু থেকেই বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলতে হবে৷ থাকতে হবে স্বচ্ছতা৷ থাকতে হবে সহনশীলতা এবং সমঝোতার মানসিকতা৷ সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুস্থির হয়ে৷ অস্থির সময়ে নয়৷ রাগ বা অস্থিরতার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলে তা আসলে অনেক সময়ই সঠিক হয় না৷