1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
সমান অধিকারবাংলাদেশ

‘বাংলাদেশের বাঙালিরা কি কোনোদিন পাহাড়িদের বুঝতে পারবেন?'

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক পার্বতী রায়৷ সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের পর ডিডাব্লিউকে নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানিয়েছেন৷

https://p.dw.com/p/4lAST
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় বেশ কিছু বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন দেয়া হয়
সম্প্রতি রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে জাতিগত সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছেছবি: Tapan Das

পার্বতী বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত তিনিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষ এবং তার আদিবাসী ভাইবোন যারা বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে আছেন তারা ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন৷ বর্তমানে দেশের বাইরে থাকলেও অনেকের মতোই তার মন পড়ে আছে পাহাড়ে, যেই পাহাড়ের কোলে তিনি বেড়ে উঠেছেন৷

তিনি জানান, পাহাড়ের ছায়াতলে তার বাঙালি বন্ধুদের সাথে একসাথে পড়ালেখা করেছেন, খেলাধুলা করেছেন, টিফিন ছুটিতে বা স্কুল ছুটির পরে যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন তখন একসাথে বউচি, বরফ-পানি আর ক্রিকেট খেলেছেন স্কুল মাঠে৷ স্কুলের আর শিশু একাডেমির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে একসাথে কোরাস গান করেছেন, গানের রিহারসেল করেছেন! আবার ঈদ বা পূজার সময় বাঙালি বন্ধুদের বাসায় গেছেন, আবার ওরাও বিঝুতে তাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে৷

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা আর রাঙামাটিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে তার কিছু বাঙালি বন্ধুদের সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক পোস্ট এবং ভিডিও দেখে ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন পার্বতী৷

তিনি বলেন, ‘‘জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও স্বৈরাচারী সরকার পতনের দাবিতে আমরা আদিবাসীরা আমাদের বাঙালি বন্ধুদের সাথে এগিয়ে এসে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করলাম যে যেভাবে পারি৷ চুপ করে বসে থাকতে পারিনি এতগুলো তরুণ প্রাণ আর শত শত মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখে৷ কতো যে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি আবু সাঈদ এবং আরও কতো তরুণ তাজা প্রাণের ঝরে যাওয়া দেখে! এই অনাচার-অবিচারগুলো মেনে নিতে পারিনি বলেই দেশের বাইরে থেকেও প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছি৷ তখন কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য আমি ভাবিনি যে ওরা বাঙালি, আমি আদিবাসী, বা ও অমুক দল করে, সে সমুক দল করে, বা বাঙালিরা মরে যাচ্ছে তাতে আমার কি! তারপরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আদিবাসীদের শুনতে হয় ‘এরা নড়েও না চড়েও না', ëহাড্ডি কখনো গোশত হয় না, উপজাতি কখনো দোস্ত হয় না', - এরকম নানান রকম ট্রোলের শিকার হতে হয় যেগুলো বর্ণবাদী আ সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় দেয়৷''

পার্বতী জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালাতে যে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা হলো কেবল তার পরিচিত দুইজন বাঙালি বন্ধু বাদে কেউ খোঁজ নেয়নি৷ অথচ যখনই কোনো বাঙালি বন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘোরার পরিকল্পনা করে তখনি তাকে জানায় বা ব্যক্তিগত বার্তা পাঠায় সামাজিক মাধ্যমে- ëতোদের রাঙামাটি ঘুরতে আসবো', ëরাঙামাটির লেকে বোটিং করব' বা ‘বাঁশকরল কবে খাওয়াবি?'- এইসব৷

তিনি বলেন, ‘‘এখন তো দেশের গণমাধ্যম অনেক স্বাধীন, এখন বলা হচ্ছে আমরা সবাই বাংলাদেশ ২.০ তে আছি৷ কিন্তু দুঃখজনকভাবে জাতীয় গণমাধ্যম আদিবাসীদের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সংবাদ ও আদিবাসীদের দুর্ভোগকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করে না, ফলে সেটা গুরুত্ব হারায়৷ এছাড়া আমাদের ব্যাপারে অনেক সময় ভুল বা অতিরঞ্জিত তথ্য প্রকাশ করা হয়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংবাদ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয় শুধু বিজুর উৎসব যখন হয় তখন বা নীলগিরিতে পর্যটন বা আদিবাসী নারীরা কেন এত সুন্দর, বা তাদের ত্বক রং কেন এত উজ্জ্বল হয়, এইসব নিয়ে৷এই ধরনের সংবাদ প্রতিবেদন পাহাড় নিয়ে এবং আদিবাসীদেরকে নিয়ে একধরনের বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ৷''

পার্বতী রায় জানান গত ২০ সেপ্টেম্বর অনিক চাকমাকে রাঙামাটিতে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারার অমানবিক দৃশ্য দেখার পর তিনি নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যখন আবু সাঈদ শহিদ হন তখন দেশের মানুষ সামাজিক গণমাধ্যমে তার ছবি পোস্ট করল, সাথে আমিসহ আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকেই যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দলনে শহিদ হলেন, তাদের ছবি সমব্যথী হয়ে নিজেদের ফেসবিক পেজে পোস্ট করি৷ কিন্তু অনিক চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা, ধনরঞ্জন চাকমা, ও জুনান চাকমার বিনা বিচারে হত্যার ঘটনায় আমার পরিচিত কয়েকজন ছাড়া আর কোনো বাঙালি শিক্ষক, বন্ধু, ছাত্রছাত্রীদের কাউকে দেখালাম না সমব্যথী হয়ে খবরটা শেয়ার করতে! অনিক চাকমার মতো এই রকম অসংখ্য তরুণ তাজা প্রাণ দেশে অকালে ঝরেছে সেই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন এবং গত সপ্তাহের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পর্যন্ত৷''

তার দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে নিহতদের বিচারের দায়িত্ব যদি নেয়, তাহলে অনিক চাকমার হত্যাকারীসহ যারা বৌদ্ধ বিহারে হামলা করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে ও আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে ও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে ব্যাপারেও দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এছাড়া কয়েক মাস আগে বম নারীদের কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সন্দেহে সন্ত্রাসী হিসেবে নির্বিচারে গ্রেপ্তার বন্ধ এবং কল্পনা চাকমাসহ অনেক আদিবাসী পাহাড় ও সমতলে যারা এখনও বিচার পায়নি তাদের বিচারে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানান তিনি৷

পার্বতী রায়, খণ্ডকালীন শিক্ষক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
পার্বতী রায়, খণ্ডকালীন শিক্ষক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: privat

নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে পার্বতী বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যেতে হলে আর্মি চেকপোস্টের সামনে সবসময় থামা, বা কোথায় যাচ্ছি বা জাতীয় পরিচয়পত্র যখনি আর্মি বলবে তখই দেখাতে হবে এইসব দেখে দেখে বড় হয়েছি৷ এখন যেহেতু প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে সেই সাথে সাথে এখন আবার ডিজিটাল ক্যামেরায় যাত্রীদের অনুমতি ছাড়াও বাস থামিয়ে ভিডিও করা হয়৷ আবার অনেক আদিবাসীদের গ্রামে কোনো উৎসব হলে- সেটা বিয়ের অনুষ্ঠান হোক বা নবান্ন উৎসব হোক, সেনাবাহিনীকে জানাতে হয় যে এত বেশি চাল বা মুরগি কেন কেনা হচ্ছে, বা গ্রামে অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের লিস্ট জমা দিতে হয় তাদের কাছে৷ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আদিবাসিদের কোনো স্বাধীনতা নেই৷ পার্বত্য চট্টগ্রাম কি বাংলাদেশের বাইরে? আমাদেরকে বার বার সন্ত্রাসী তকমা দেওয়া হয়, দেশদ্রোহী বানান হয়৷ আমরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নই, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে৷''

সাম্প্রতিক সময়ে দুই পার্বত্য জেলার সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বীজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান পার্বতী৷ বলেন, এসব প্ল্যাটফর্মে আদিবাসী নারীদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছড়িয়ে দিয়েছেন কয়েকজন বাঙালি ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী৷ সেখানে যে ধরনের কথা বলা হয়েছে তার কয়েকটির উল্লেখ করেন তিনি৷ যেমন: ‘আদিবাসী মেয়েদের পক্ষে আছি, আর ছেলেদের বিষয়টি আর্মি ভাইয়েরা দেখেন যা ভাল মনে করেন৷' অথবা ‘প্রত্যেকটা পাহাড়ি মেয়ের গর্ভে একটা করে বাঙালি সন্তান দরকার এখন, আমার বাঙালি ভাইদের বলব প্রত্যেকটা পাহাড়ি মেয়েকে ধরে ধরে ধর্ষণ করে ওদেরকে গর্ভবতী করে দাও৷'

তিনি বলেন, এই ধরনের মন্তব্য কেবল আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়, আদিবাসীদের নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকেও উসকে দেয়৷

বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে এখন ঢালাওভাবে অনেকেই, বাঙালিরা আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে বা নাকি আদিবাসীরা এসেছে, তার ভিত্তিতে কারা আদিবাসী এই সংজ্ঞা নির্ধারণ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন বলে জানান তিনি৷ পার্বতীর মতে, আমাদের দেশে বা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে আদিবাসী কারা সেইটা আসলে কে আগে কে পরে এসেছে, তার ভিত্তিতে নির্ধারণ করাটা যৌক্তিক নয়৷ আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রগুলোতে আদিবাসী কারা সেই পরিমাপকগুলো ছাড়াও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে যে, ঐতিহাসিকভাবে পুরো এশিয়াজুড়ে অনেক ধর্মীয় এবং জাতিগোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে এবং অনেক ধর্মীয় এবং জাতিগোষ্ঠীরা প্রান্তিকতার শিকার৷ আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপাল বা ভারতে আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি৷ তার মতে, উপজাতি বা আদিবাসী এইগুলো তাদের মাতৃভাষার শব্দ নয়, কিন্তু ‘আদিবাসী' শব্দটাই তাদের সমষ্টিগত পরিচয়, অধিকার ও সার্বভৌমত্বকে বহন করে৷

সামাজিকমাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত অনেকেই ‘আদিবাসীরা আদিবাসী নয়, বাংলাদেশে সবাই বাঙ্গালি' এই ধরনের মন্তব্য করেছেন বলে জানান পার্বতী৷ তিনি বলেন, এধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে আবার সেই চলমান ৫৩ বছরের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিবাসীদেরকে দেখা হচ্ছে৷

আন্দোলনকারী বা সমন্বয়কদের কাছে তার প্রশ্ন: তারা আসলে বৈষম্যবিরোধী এই ব্যাপারটা বলতে কি বোঝেন? এটা কি শুধু রাজনৈতিক দলগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে নাকি সকল প্রকার আর্থসামাজিক বৈষম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে?

অনুলিখন: অমৃতা পারভেজ

ডয়চে ভেলের সাংবাদিক অমৃতা পারভেজ৷
অমৃতা পারভেজ ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক৷