শম্ভু মিত্র ১০০
১ সেপ্টেম্বর ২০১৪১৯৯৭ সালের ১৯শে মে শম্ভু মিত্রের মারা যাওয়ার খবর তাঁর শহর পেয়েছিল পরের দিন সকালে, মরদেহ সৎকার হয়ে যাওয়ার পর৷ কারণ তিনি ঠিক সেরকমটাই চেয়েছিলেন৷ নিজের শেষ ইচ্ছাপত্রে ঘনিষ্ঠজনেদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, অত্যন্ত সাধারণভাবে এবং অবশ্যই লোকচক্ষুর আড়ালে যেন তাঁর অন্ত্যেষ্টি হয়৷ বাঙালিদের মধ্যে মৃত্যু নিয়ে যে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ কাজ করে, বিখ্যাত মানুষরা মারা যাওয়ার পর তাঁদের দেহ সর্বজনের শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্য যেমন প্রকাশ্যে প্রদর্শিত হয়, তেমন কিছু হোক শম্ভু মিত্র চাননি৷ যার দরুণ শোককে একান্তই ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রেখে নীরবে, নিভৃতে শেষকৃত্য করা হয়েছিল বাংলা থিয়েটারের সম্ভবত বিখ্যাততম, প্রবাদপ্রতিম মানুষটির৷
শম্ভু মিত্রের জন্মশতবর্ষে এই ঘটনার উল্লেখ এই কারণেই জরুরি যে, এর থেকে মানুষটি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়৷ মাত্র দু-দশকের নাট্য-জীবন অসময়েই শেষ করে কেন তিনি অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন, সেটা বুঝতেও সম্ভবত কিছুটা সুবিধে হয়৷ যদিও শম্ভু মিত্রের সম্পর্কে অনুজ নাট্যকর্মীদের একটা বড় অনুযোগ হলো, তাঁর নাটক দেখা, সেই দেখা থেকে জীবনদর্শনের পাঠ নেওয়া, নতুন কিছু শেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম৷ ধরা যাক উৎপল দত্ত বা বাদল সরকার যেভাবে নাট্যমঞ্চে সক্রিয় থেকেছেন, দল পরিচালনা করেছেন, নাট্য-নির্দেশনা এবং অভিনয়ে বাংলা থিয়েটারকে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ করে গিয়েছেন, শম্ভু মিত্রের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি৷ এতে শুধু পরবর্তী নাট্যকর্মীরাই নন, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শম্ভু মিত্রের সমসাময়িক নাট্যব্যক্তিত্ত্বদেরও যথেষ্ট খেদ থেকে গিয়েছে৷
তবে ঘটনা পরম্পরা এত সহজ এবং সরলরৈখিক সম্ভবত ছিল না৷ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নানাজনের স্মৃতিচারণে বরং এক অচেনা শম্ভু মিত্রেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, বাংলা থিয়েটারের উন্নতিকল্পে তহবিল গড়ার জন্য তাঁকে ব্যবহার করতে৷ তাঁর অভিনয়ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ধারাবাহিক নাট্য প্রযোজনার মধ্য দিয়ে অর্থসংগ্রহ করতে৷ এ খবর দিচ্ছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত৷
নাট্যজীবনের শুরুতে বামপন্থিদের আইপিটিএ নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শম্ভু মিত্র৷ পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে আইপিটিএ-র সঙ্গে শম্ভু মিত্র গিয়েছেন মুম্বই৷ সেখানে বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দি' নাটকটি হিন্দিতে ‘অন্তিম অভিলাষ' নামে অভিনীত হচ্ছে৷ মানুষ নাটক দেখে দুহাত ভরে দান করছেন৷ এই সময়েই অভিনেতা-নির্দেশক রাজ কাপুরের সঙ্গে শম্ভু মিত্রের পরিচয় হয়৷ কথিত আছে, ‘জাগতে রহো' ছবিটির চিত্রনাট্য রাজ-নার্গিসকে শুনিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র৷ শুনে রাজ কাপুরের এত ভালো লেগেছিল যে সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব দেন, তিনি নিজে নির্দেশক থাকবেন, শম্ভু মিত্র ছবিটিতে অভিনয় করুন৷ শম্ভু মিত্র জবাবে বলেছিলেন, বরং উল্টোটা হোক৷ তাঁর নির্দেশনায় ‘জাগতে রহো' ছবিতে অভিনয় রাজ কাপুরের জীবনের অন্যতম মাইলফলক হয়ে উঠেছিল৷
চলচ্চিত্র পরিচালনায় সাফল্য এবং সেই সময়ে মুম্বইয়ের হিন্দি ছবিতে সবথেকে বেশি প্রবাবশালী কাপুর পরিবারের গুণমুগ্ধতা ও পৃষ্ঠপোষকতা – অন্য যে কোনো অভিনেতা হলে হয়তো বাকি অভিনয়-জীবন মুম্বইতেই কাটিয়ে দিতেন৷ কিন্তু শম্ভু মিত্র থাকেননি৷ বলেছিলেন, বিজন ভট্টাচার্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নাটক লিখেছেন, যার প্রযোজনার জন্য তাঁকে বাংলায় ফিরতে হবে৷ সেই নাটকটির নাম ‘নবান্ন'৷ আর ১৯৬৪ সালে সদ্যোজাত যে নাটকের দলটি সেটি অভিনয় করল, সেই দলের নাম ‘বহুরূপী'৷
শম্ভু মিত্রের নাটক বা তাঁর নাট্যদর্শন সম্পর্কে এই জন্মশতবর্ষে নিঃসন্দেহে আরও বিস্তৃত মূল্যায়ণ হবে৷ প্রশংসা এবং সমালোচনা, দুই-ই তাঁর নাট্যভাবনাকে বুঝতে সাহায্য করবে৷ এবং তখন একটা কথা নিশ্চয় বার বার বলা হবে৷ আইপিটিএ নাট্য আন্দোলন বা নির্দিষ্ট কোনো ধারার নাটকে আটকে না থেকে শম্ভু মিত্রই বার বার দুর্জয় সাহস দেখিয়েছেন নিত্য নতুন নাট্য বিষয় ও আঙ্গিকের সঙ্গে বাংলা নাগরিক থিয়েটারে আগ্রহী দর্শকদের পরিচয় করানোর৷ কিন্তু কখনই তিনি এই ভেবে বিরত থাকেননি বা পিছিয়ে যাননি যে দর্শকের কেমন লাগবে৷ বরং তিনি নতুন বাংলা নাটকের দর্শক তৈরি করে নিতে প্রয়াসী হয়েছেন৷ যে তাগিদ থেকে একদিকে তিনি যখন গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিসের নাটক মঞ্চস্থ করছেন, অন্যদিকে তেমন রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে কাজ করছেন৷ আবার তিনিই ইবসেনের নাটক করছেন৷ মঞ্চসজ্জা থেকে অভিনয়রীতি, নাটকের আঙ্গিক থেকে প্রকরণ, সবকিছু তিনি বারে বারে বদলে দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন৷ বাংলা নাটকের নয়া ইতিহাস লিখে গিয়েছেন শম্ভু মিত্র৷