পোশাক শিল্পে অস্থিরতা : কারখানা বন্ধের হিড়িক, সংঘর্ষ, আগুন
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪হঠাৎ করে পরিস্থিতি এমন হলো কেন? কেনই বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না? গার্মেন্টস শ্রমিক, মালিক ও অন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতদিন ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, সেটার নিয়ন্ত্রণ এখন নিতে চান বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এছাড়া শ্রমিকদেরও কিছু দাবি আছে। এছাড়া কেউ কেউ ষড়যন্ত্রের তত্ত্বও খুঁজছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা দেশগুলোর ইন্ধনের কথা উঠে আসছে কারো কারো বক্তব্যে৷
তবে শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব না খুঁজে তাদের দাবি পূরণের দিকে মালিকদের মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি জলি তালুকদার। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "শ্রমিকদের অনেকগুলো দাবি তো যৌক্তিক। সেগুলো মালিকরা মেনে নিলে সমস্যা কোথায়? আমরা মঙ্গলবারও আশুলিয়ায় সমাবেশ করে শ্রমিকদের কাজে ফেরার কথা বলেছি। আমরা মনে করি, অস্থিরতা বেশিদিন চললে বায়াররা অন্য কোথাও চলে যেতে পারেন। ফলে সব পক্ষকেই বিষয়টি বুঝতে হবে।”
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভবানীপুর এলাকার বিগ বস নামের একটি বড় তৈরি পোশাক কারখানায় বুধবার দুপুর ১২টার দিকে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগুনে কোম্পানির গোডাউন, স্টক কাপড়ের গোডাউন পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে যেতে চাইলে পথে শ্রমিকরা ভাঙচুর করে। ফলে বিকেল পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তবে কারখানা শ্রমিকরা নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আজও (বুধবার) আমরা মন্ত্রণালয়ে সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করেছি। শ্রমিকদের দাবিগুলো নোর্টিশে নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামীকালের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শুক্রবার ছুটি, অর্থাৎ শনিবার থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হবে। যেসব ফ্যাক্টরিতে সমস্যা হয়েছে সেগুলোর সমাধান হয়ে যাবে।”
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বুধবার ১১৪টি কারখানা বন্ধ ছিল। বিজিএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১৪৪টি। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে ১১১টি সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায়। আর গাজীপুরে ৩টি কারাখানা বন্ধ আছে। ১ হাজার ৩০৯টি কারখানা ইতিমধ্যে আগস্ট মাসের বেতন দিয়েছে। ৮৩৫টি কারাখানা এখনও আগস্ট মাসের বেতন দিতে পারেনি। বিজিএমইএর তথ্য বলছে, শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে মূলত গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকায়।
কেন এই অসন্তোষ?
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঝুট ব্যবসায়ও হাতবদল হচ্ছে। কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করে নিজেদের নতুন প্রভাব বলয় তৈরি করছেন কেউ কেউ। গত দুই সপ্তাহে ঝুট ব্যবসা নিয়ে একাধিক গ্রুপের মধ্যে আশুলিয়ায় সংঘর্ষ হয়েছে। কিছুদিন ধরেই আশুলিয়ায় কারখানায় ভাংচুর, হামলা, লুট ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কয়েকটি কারখানায় হাজিরা দিয়েই শ্রমিকরা বের হয়ে যাচ্ছেন। কোনো কাজ করছেন না।
গত রবিবার আশুলিয়ায় ‘আলিফ ভিলেজ' নামের এক কারখানায় ব্যাপক ভাংচুর ও লুট হয়। মেডিকেল সেন্টার, সাব-স্টেশন রুম ও ফায়ার কন্ট্রোল রুম ভাঙচুর করা হয়েছে। আলিফ ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, "আমাদের এখানে দু'দফা হামলা হয়েছে। ভয়ে আমরা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। এখনো আমরা আতঙ্কিত। হামলা করার অনেক পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসেন, যারা কারখানায় হামলা করেছে, তারা কেউ আমাদের শ্রমিক না।”
কারখানার একজন কর্মকর্তা বলেন, "যারা কারখানায় হামলা করছে, তাদের অনেকেই শিশু-কিশোর। আবার এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে। অনেক রিকশা ও ভ্যানচালক হামলায় জড়াচ্ছে। এসব চালকের দুরভিসন্ধি না থাকলে কেন তারা এ ধরনের হামলায় জড়াবে? তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিকদের উস্কে দিতে চাইছে। কারখানায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সঙ্গে রিকশা-ভ্যানচালকদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?”
এর মধ্যে আবার সাভারের পুরাতন ইপিজেড এলাকায় ন্যানি ফ্যাশন নামে একটি কারখানার কয়েক হাজার সাবেক শ্রমিক একত্রিত হয়ে মানববন্ধন করেছেন। ওই কারখানা বছর চারেক আগে বন্ধ হয়। এক মাসের পাওনা বেতনের দাবিতে এত বছর পর একত্রিত হয়ে মানববন্ধনের বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে করছেন কেউ কেউ।
এছাড়া আশুলিয়ায় অস্থিরতার পেছনে ঝুট ব্যবসা-কেন্দ্রিক বিরোধেরও ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী অধিকাংশ কারখানায় ঝুটের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সরকার পতনের পর তাদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ‘পলাতক' থাকা অবস্থায় কেউ কেউ ব্যবসার নাটাই ছাড়তে চান না। তবে এখন বিএনপি নেতা-কর্মীরা ঝুটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। এরই মধ্যে এ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইপিজেডে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আশুলিয়া থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন নেতাকে বুধবারও নেতা-কর্মীকে নিয়ে এলাকায় অবস্থান করতে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে জানিয়েছেন।
শ্রমিকদের দাবি
আশুলিয়ার একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন, সেখানে সমন্বিত কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগের যে কোনো শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় নির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া ছিল। এবার সুনির্দিষ্ট দাবির বদলে ‘অযৌক্তিক' দাবির দিকে ঝুঁকে একটি পক্ষ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছে। আবার কিছু দাবি রয়েছে অভিন্ন। অনেক দাবি আবার মালিকরা মেনে নিয়েছেন।
আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় মেডলার কারখানায় কাজ করেন কোহিনূর বেগম। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমাদের দাবির মধ্যে আছে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১ তারিখের মধ্যে পে-স্লিপ ও ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দিতে হবে। মাসে হাজিরা বোনাস সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা দিতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ সমান হতে হবে। দুই ঈদে মূল বেতনের (বেসিক) ১০০ শতাংশ বোনাস দিতে হবে। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেলে তার লাশ কোম্পানি নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছাবে। অন্তঃসত্ত্বার ক্ষেত্রে ছুটি চার মাস হবে। এ ছাড়া ছুটির টাকা অগ্রিম দিতে হবে। ছুটি পাস হওয়ার সময় হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না। ঈদের ছুটি হবে সর্বনিম্ন ১২ দিন। চাকরির বয়স ৫ বছর হলে কোনো কারণে তাকে ছাঁটাই করলে সার্ভিস বেনিফিট দিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে। শ্রমিক-কর্মচারী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার খরচ কোম্পানি বহন করবে। আন্দোলনকারী কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।”
এবার সব প্রতিষ্ঠানে দাবি এক রকম নয়। অন্য কিছু কারখানার শ্রমিকরা নানা দাবি-দাওয়া সামনে আনছে। আল-মুসলিম গার্মেন্টের শ্রমিক রওশন ফারুক বলেন, "আশপাশের বেশ কিছু কারখানায় টিফিন বিল নগদ দেওয়া হয়। আমাদের কারখানা রুটি-কলা সরবরাহ করে। হাজিরা বোনাস মাসে ৩০০ টাকা। এটা বাড়ানোর দাবি আমাদের। এর আগে কখনোই আল-মুসলিমে সমস্যা হয়নি। কিছু যৌক্তিক দাবি মানা হলে বর্তমান সমস্যাও কেটে যাবে।”
ডেকো ডিজাইন লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানার শ্রমিকদের ১৭ দফা দাবির মধ্যে আছে, অযৌক্তিকভাবে প্রোডাকশন বাড়ানোর চাপ না দেওয়া, বছরে ১৮ দিনের ছুটির টাকা পরিশোধ। টিফিন বিল সন্ধ্যা ৭টার পর ৬০ টাকা ও নাইট বিল ১০০ টাকা করতে হবে। হাজিরা বোনাস দিতে হবে এক হাজার টাকা।
নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা
টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকায় নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুই দিন আগে সবার সঙ্গে বৈঠকে শ্রমিকদেরচারটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। টিফিন বিল ও হাজিরা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য রাখা হবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। আর কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করলে তার ব্যাপারে রেস্ট্রিকশন থাকবে না, যাতে সে অন্যত্র সহজে চাকরি পেতে পারে। এই খবর সব শ্রমিকের কাছে আমার মনে হয় পৌঁছেনি। আমি মনে করি, বিশৃঙ্খলা বন্ধ না হলে বায়ারদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে।”
হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এক বছর আগেই শ্রমিকদের পে কমিশন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। নতুন এই সরকারের সময়ে একটা গ্রুপ সুযোগ নিতে চাচ্ছে। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোন কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মদতপুষ্ট বিজিএমইএর নেতারা এই বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কার্যকর ভুমিকা নিতে পারছে না। অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠনগুলো বাইরের পয়সা নিয়ে শ্রমিকদের উষ্কে দিচ্ছেন। এতে যে আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সেটা তারা একবারও চিন্তা করছেন না। আমরা অর্ডার না পেলে শ্রমিকদের কি চাকরি থাকবে? এই অবস্থা চলতে থাকলে বায়ররা তো অন্য কোথাও শিফট হয়ে যেতে পারেন।”
বিজিএমইএর আরেক সাবেক সহ-সভাপতি মশিউল আযম সজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ড. ইউনূসের মতো একজন মানুষ আমাদের দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তাকে বেকায়দায় ফেলতে বহু মানুষ চেষ্টা করছেন। আমাদের বছরে ৪৪ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্ট করতে হয়। এতে মাসে গড়ে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এক্সপোর্টের প্রয়োজন হয়। সেই হিসেবে আমরা ইতিমধ্যে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে এক্সপোর্ট করতে পারিনি। তাহলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে কিভাবে? আমাদের এমন অস্থিরতা চলতে থাকলে আশপাশের দেশগুলো কি বসে থাকবে? এক্ষেত্রে যে তাদের ইন্ধন নেই সেটাও বা বলবেন কিভাবে? আমরা যদি আমাদের নিজেদের ভালো বুঝতে না পারি, তাহলে কে আমাদের বোঝাবে?”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা কিন্তু শ্রমিকদের বোঝাচ্ছি যে, তোমরা তোমাদের আবেগটা একটু কন্ট্রোল করো। এখন এই দাবি আর আবেগ যদি কন্ট্রোল না হয় সেক্ষেত্রে আমরা যদি কাজ না করি তাহলে ব্যবসা তো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এখানে অস্থিরতা দেখিয়ে বাজার অন্যদিকে নেওয়ার যে প্রোপাগান্ড চলছে সেটা তো কোন কোন বায়ার বিশ্বাসও করতে পারেন। এতে তো আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। আমার মনে হচ্ছে, এটাতে কারো কন্ট্রোল নেই। অনেকটা মব জাস্টিসের মতো হয়ে যাচ্ছে। শুধু যদি দাবির কথা বলেন, সেখানে আহামরি কিছু নেই যে বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রত্যেকটা গার্মেন্টস পৃথকভাবে দাবি মানছে, সেটা না করে যদি তারা সমন্বিতভাবে ঘোষণা দেন সেটা আরও অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে আমার মনে হয়।”