বিহার নির্বাচনে খারাপ ফলের পর ফ্লাডগেট খুলে গেছে। গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে কংগ্রেসের একের পর এক প্রবীণ নেতা সামিল হচ্ছেন। শুরু করেছিলেন কপিল সিবাল। তারপর চিদাম্বরমও তাতে আংশিক সুর মিলিয়েছিলেন। জবাব দিয়েছিলেন অধীর চৌধুরি। এ বার তাতে সামিল হলেন গুলাম নবি আজাদ। কাশ্মীরের এই নেতা একদা গান্ধী পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন। কিন্তু এখন তিনিই প্রবীণ নেতাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
গুলাম নবি বলেছেন, ''পাঁচ তারা সংস্কৃতিই কংগ্রেসের পতনের কারণ। নেতারা দায়িত্ব পেলেই পাঁচ তারা হোটেলে থাকেন। সেখানেও ডিলাক্স ঘর নেন। এসি গাড়ি ছাড়া তাঁরা চড়েন না। কাঁচা রাস্তা থাকলে তাঁরা সেখানে যান না। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগ নেই। তাই দলের এই অবস্থা।'' তাঁর বক্তব্য, ''দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হোক। পছন্দের নেতাদের দায়িত্ব দেয়ার প্রথা বন্ধ হোক।''
গুলাম নবি বলেছেন, ''পাঁচ তারা হোটেলে বসে নির্বাচন জেতা যায় না। এই সংস্কৃতির বদল না হলে কংগ্রেস আর ভোটে জিততে পারবে না।'' তিনি মনে করেন, ''কংগ্রেসে প্যারাসুট করে বাইরের নেতাদের রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁরা মাটির সঙ্গে যুক্ত নেতাদের আমল দেন না। দায়িত্ব পেলেই নেতারা নিজের প্যাড ছাপান, ভিজিটিং কার্ড তৈরি করেন। তাতেই দায়িত্ব শেষ বলে তাঁরা মনে করেন। ব্লকের নেতা, জেলার নেতাদের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগই রাখেন না।''
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
দুই বউ দুই দলে
কংগ্রেসের রাশ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নেহরু-গান্ধী পরিবারের হাতে৷ জওহরলাল, ইন্দিরা, রাজীবের পর ভার গেছে রাজীব-পত্নী সোনিয়ার কাছে৷ কিন্তু ইন্দিরার আরেক পুত্র সঞ্জয়ের অকাল প্রয়াণে রাজনৈতিক আলোয় এসে পড়েন তাঁর স্ত্রী মানেকা৷ শ্বশুরবাড়ির মানুষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় মানেকা প্রতিষ্ঠা করেন ‘সঞ্জয় বিচার মঞ্চ’ নামের একটি কংগ্রেস-বিরোধী দল৷ বর্তমানে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য এবং নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
দুই ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ
সোনিয়া, মানেকা গান্ধী পরিবারের দুই বউ৷ তাঁরা দুজনেই দুজনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী৷ উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে সোনিয়া-পুত্র রাহুল বর্তমানে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ৷ মানেকা-পুত্র বরুণ গান্ধীও ভারতীয় জনতা পার্টি, অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ৷ ছবিতে বরুণ, তাঁর মা মানেকা ও স্ত্রী যামিনী৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
মহারাষ্ট্রেও একই চিত্র
মারাঠি জাতীয়তাবাদী আদর্শে গঠিত শিব সেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরে৷ তাঁর পর কে পাবেন দলের দায়িত্ব, এই নিয়ে যখন পুত্র উদ্ধব ও ভাইপো রাজের মধ্যে বচসা বাধে, দলের ভার পান উদ্ধব ঠাকরে৷ রাজ ঠাকরে শিব সেনা ছেড়ে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আরেকটি সম-আদর্শের দল ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’৷ দুই দলের মধ্যে আদর্শিক কোনো দ্বন্দ্ব সেভাবে না থাকলেও, মহারাষ্ট্রের নেতৃত্ব নিয়ে রাজ-উদ্ধব দ্বন্দ্ব আলোচিত৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
রাজপরিবারের ভেতরেও দ্বন্দ্ব
গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের মধ্যে রয়েছে রাজনীতিতে আসার ঝোঁক৷ কিন্তু সদস্যদের মধ্যে নেই মতের মিল৷ কংগ্রেস-সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাধবরাও-এর মা বিজয়রাজে সিন্দিয়া ছিলেন গোয়ালিয়রের শেষ রাজা জিবাজিরাও-এর স্ত্রী৷ প্রথম দিকে বিজয়রাজে সিন্দিয়া কংগ্রেস-বিরোধী স্বতন্ত্র পার্টিতে যোগ দিলেও পরে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন৷ ওপরের ছবিতে মাধবরাও-এর বোন বসুন্ধরা, যিনি মায়ের মতোই কংগ্রেস-বিরোধী৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
নতুন প্রজন্মও দুই দলে বিভক্ত
মাধবরাও সিন্দিয়ার পথ ধরে তাঁর পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্দিয়াও কংগ্রেসে যোগদান করেন৷ বর্তমানে তিনি দলের অন্যতম জনপ্রিয় যুবনেতা৷ অন্যদিকে তাঁর বাবার দুই বোন, যশোধারা ও বসুন্ধরা যথাক্রমে মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদ৷ শুধু তাই নয়, পিসি-ভাইপো’র মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদের জের এসে পড়েছে পারিবারিক সম্পর্কেও৷ সংসদেও একে অন্যের বিপক্ষে লড়তে দেখা যায় বসুন্ধরা ও জ্যোতিরাদিত্যকে৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
বাবার বিরোধী ছেলে
বাবা মুকুল রায় ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য যখন ২০১৭ সালের নভেম্বরে দল বদলে বিজেপি’তে যোগদান করেন, প্রশ্ন ওঠে, কী হবে তৃণমূল সাংসদ মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু’র রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ? অবশেষে ২০১৯ সালের মে মাসে এসে তিনিও যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে৷
-
ভারতে পরিবারের ভেতর রাজনৈতিক লড়াই!
বলিউড পরিবারেও হলো যা...
বিখ্যাত অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা সম্প্রতি ভারতীয় জনতা পার্টির সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করে যোগ দেন কংগ্রেসে৷ তাঁর স্ত্রী পুনম সিনহা যখন এ বছর রাজনীতির ময়দানে আসার ঘোষণা দেন, সবার মনেই ছিল প্রশ্ন– কোন দলে যাবেন তিনি? বিজেপি বা কংগ্রেস, দুই দলে না গিয়েই পুনম যোগ দিলেন সমাজবাদী পার্টিতে৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই দলের হয়েই তিনি লড়বেন বিজেপি’র রাজনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে৷
এতসব বলার পরে তিনি সোনিয়া গান্ধীর প্রশংসা করে বলেছেন, তিনি ভুল পথে চলছেন না। তাঁর নেতৃত্বেই দল সাম্প্রতিক সময়ে চার পাঁচটি রাজ্যে ভোটে জিতেছে। আসলে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের বিদ্রোহ রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে।
বিদ্রোহী নেতাদের সমালোচনা করেছেন, অধীর চৌধুরি, সলমন খুরশিদরা। অধীর চাঁচাছোলাভাবে বলেছেন, ''এই নেতাদের না পোষালে দল ছেড়ে দিন। নিজে দল গঠন করুন অথবা অন্য দলে যোগ দিন। কিন্তু দলের ভিতর থেকে এই ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। নিজে কিছু না করে আত্মবিশ্লেষণের কোনো অর্থ হয় না। বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গুজরাটের ভোটে তাঁদের প্রচারে দেখা যায়নি।'' সলমন খুরশিদের দাবি, ''সোনিয়া ও রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সংকট নেই। দলের সকলেই তাঁদের চান। তাঁরা সকলের কথা শোনেন। সকলকে সুযোগ দেন। যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরাও ঢালাও সুযোগ পেয়েছেন।'' পশ্চিমবঙ্গের নেতা শুভঙ্কর সরকার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এই নেতারা অতীতে প্রচুর সুযোগ পেয়েছেন। এখন দলের খারাপ অবস্থায় তাঁদের কাজ করে দেখানো উচিত।''
কিছুদিন আগে প্রবীণ নেতারা সোনিয়াকে চিঠি দিয়ে নেতৃত্বের সমালোচনা করেছিলেন। তারপর ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁরা প্রবলভাবে সমাচোলিত হন। এখন বিহারের নির্বাচনে খারাপ ফলের পর তাঁরা আবার সোনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছেন। কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও চরমে উঠেছে। বিজেপি-র সঙ্গে লড়াইয়ের আগে সোনিয়া ও রাহুলকে এই ঘরোয়া লড়াই বন্ধ করে দলের উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
জিএইচ/এসজি(পিটিআই)