পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখা মানুষটি চলে গেলেন
পশ্চিমবঙ্গের সাবেক ও শেষ বাম মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার মারা গেছেন৷ শুক্রবার তার দেহদান করা হলো৷
১১ বছরের মুখ্যমন্ত্রী
৩৪ বছরের বাম শাসনে জ্যোতি বসুর পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই ছিলেন দ্বিতীয় ও শেষ মুখ্যমন্ত্রী৷ ২০০০ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নেন৷ ২০১১ পর্যন্ত তিনিই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন৷ এই ১১ বছর ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়৷
ছাত্র-যুব রাজনীতি থেকে
সিপিএমের প্রয়াত নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত সাতজন তরুণ নেতাকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে তৈরি করেছিলেন৷ তারমধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন একজন৷ ছাত্র-যুব রাজনীতি থেকে উঠে এসেছিলেন বুদ্ধদেব৷ ফলে দলের শক্তি ও দুর্বলতা দুটোই সমানভাবে জানতেন৷
দুই কামরার ফ্ল্যাটে
জ্যোতি বসু সরকারে প্রথমে মন্ত্রী হয়েছিলেন বুদ্ধদেব৷ তারপর পদত্যাগ করেছিলেন৷ পরে আবার সরকারে ফিরে এসেছিলেন৷ জ্যোতিবাবুর পর মুখ্যমন্ত্রী হন৷ ৫৯ পাম অ্যাভিনিউয়ের দুই কামরার ফ্ল্যাটে কাটিয়ে গেছেন তিনি৷ এখান থেকেই বৃহস্পতিবার তার দেহ নিয়ে যাওয়া হলো পিস ওয়ার্ল্ডে৷ বিমান বসু লিখেছেন, রাজনীতি যে বাড়ি-গাড়ি করার জন্য নয়, বুদ্ধদেব তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন৷
লেখক ও সাহিত্যানুরাগী
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুস্পুত্র৷ তিনি নিজে সুলেখক ছিলেন৷ একাধিক বই লিখেছেন৷ অনুবাদ করেছেন৷ তিনি ছিলেন নিখাদ রবীন্দ্রানুরাগী৷ প্রচুর বই পড়তেন৷ শেষের দিকে চোখের খারাপ অবস্থার জন্য তিনি আর পড়তে পারতেন না৷
ক্রিকেট অনুরাগী
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একসময় ক্রিকেট খেলতেন৷ ক্রিকেটের কোচিংও নিয়েছেন৷ ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে তিনি ভালোবাসতেন৷ ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তার সঙ্গে বুদ্ধদেবের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো৷ দেখা হলেই ক্রিকেট নিয়ে, পঙ্কজ রায়ের ব্যাটিং নিয়ে কথা হতো৷
ভদ্রলোক রাজনীতিক
বুদ্ধদেব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পরিচিত ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক রাজনীতিক৷ বিপক্ষকেও কটু কথা বলতেন না৷ অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন না৷ আলোচনা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা মান রেখে চলতে চাইতেন
শিল্পায়নের স্বপ্ন
তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখা মানুষ৷ তার সরকারের আমলে স্লোগান দেয়া হয়, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ৷ তিনি বুঝেছিলেন, একসময়ে শিল্পে উন্নত পশ্চিমবঙ্গের হাল ফেরাতে গেলে দরকার শিল্প৷ সেজন্যই টাটারা যখন ছোট গাড়ির তৈরির কারখানা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি তাদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসেন৷
‘টাকার রং দেখব না’
পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য তিনি এতটাই মরিয়া ছিলেন যে, মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বলেছিলেন, তিনি বিনিয়োগ চান৷ তিনি টাকার রং দেখবেন না৷ শুধু বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবেন৷ উপরের ছবিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ড্রাইভার ওসমান।
সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম বিতর্ক
সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানার জন্য জমি দিয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার৷ নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব হওয়ার কথা ছিল৷ কৃষকদের কাছ থেকে অত্যন্ত উর্বর জমি শিল্পের জন্য দেয়া নিয়ে প্রবল বিতর্ক দেখা দেয়৷ সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে৷ সেই আন্দোলনের ধাক্কায় সরকার ও বাম দলগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে৷ উপরের ছবিতে দলের দপ্তরে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
বুদ্ধদেবের স্বপ্নভঙ্গ
শিল্পায়নের স্বপ্ন নিয়ে বুদ্ধদেব বলেছিলেন, ‘ডু ইট নাও’৷ সফল হতে পারেননি৷ স্বপ্নপূরণ হয়নি৷ টাটারা সিঙ্গুর ছেড়ে চলে গেছে৷ রাজ্যের শিল্পায়ন থমকে রয়েছে এখনো৷ বড় দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘শিল্প হলে আমার ব্যক্তিগত কি কোনো লাভ হত, নাকি আমার পার্টির ছেলেরা শুধু চাকরি পেত?’’ মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর শিল্পায়ন করতে না পারার কষ্ট তার সঙ্গী ছিল৷
চোখ দান
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার দেহদান করে দিয়ে গেছেন৷ তিনি মারা যাওয়ার পরেই চিকিৎসাকর্মীরা তার চোখ দুটি নিয়ে যান৷ উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসাকর্মীরা তার পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন৷ দেহদান করেছেন বলে তার শেষকৃত্যও হবে না৷ তার দেহ দিয়ে দেয়া হবে হাসপাতালে৷
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ি
এই অ্যাম্বাসেডারই ছিল তার সঙ্গী৷ তার চালকের নাম হলো ওসমান৷ শেষবার এই গাড়িতে চেপেই ব্রিগেডে দিয়েছিলেন৷ কিন্তু ধুলোর জন্য নামতে পারেননি৷ বুদ্ধদেবের মৃত্যুর খবর পেয়ে অসুস্থ ওসমান তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন৷
মুখ্যমন্ত্রীর ছুটি ঘোষণা
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ খবর পেয়ে তিনি পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে যান৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সম্পর্কে লিখেওছেন মমতা৷ বলেছেন, মৃত্যু শূন্যতা সৃষ্টি করে৷ সেই শূন্যতা তিনি অনুভব করছেন৷
বাড়ি থেকে
পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়ি থেকে বের করা হলো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ৷ তার স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য হাতজোড় করে শেষ বিদায় জানালেন৷
পার্টি কার্যালয়ে
শুক্রবার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে নিয়ে যাওয়া হয় বুদ্ধদেবের মরদেহ৷ কাতারে কাতারে মানুষ তখন সেখানে দাঁড়িয়ে৷ শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য৷ রাজনৈতিক জীবনে অনেক বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে তাকে, সমালোচনা হয়েছে, প্রশংসাও পেয়েছেন৷ দেখতে হয়েছে রাজ্যে ৩৪ বছর শাসন করার পর বামেদের নির্মম পতন৷ শেষ বিদায়ের সময় অনেকেরই মনে হয়েছে, স্বপ্নপূরণ না করতে পারার কষ্টটুকু রেখে চলে গেলেন বুদ্ধদেব৷