1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে দুষ্কর্ম, অস্বীকার ও প্রশ্রয়ের রাজনীতি

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১২ এপ্রিল ২০২৪

বগটুই থেকে হাঁসখালি, সন্দেশখালি থেকে ভূপতিনগর। নানা অপরাধের ঘটনায় বারবার সরগরম হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরাধ আড়াল এবং অস্বীকারের রাজনীতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয়ই দিয়েছে অপরাধীদের৷

https://p.dw.com/p/4ehwq
ভারতের এনআইএ গ্রেফতার করছে এক সন্দেহভাজন দুষ্কৃতিকারীকে
সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা গোটা দেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছেছবি: Satyajit Shaw/DW

সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা গোটা দেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল বীরভূমের বগটুইয়ে

২০২২ সালের ২১ মার্চ ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল শিশু ও নারীদের।

তদন্তে উঠে আসে, ঘটনার পিছনে রয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দুই গোষ্ঠীর লড়াই। স্থানীয়  তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ খুনের পর  অন্য গোষ্ঠীর নেতাদের বাড়িতে আক্রমণ করা হয়েছিল।

তার আগে- পরেও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ আগের ঘটনারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছিল আনিস হত্যাকাণ্ড৷ আর বগটুইয়ের পরের ঘটনাগুলোর মধ্যে দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির ঘটনা। শাসক দলের দাপুটে নেতা শাহজাহান শেখের বিরুদ্ধে রেশন কেলেঙ্কারির অভিযোগ। সেখানে তদন্তে গিয়ে আক্রান্ত হয় কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি। এরপর শাসক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সন্দেশখালিতে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। বেরিয়ে আসে শাহজাহান শেখ গংদের নানান কুকীর্তি৷

গ্রামবাসীর দাবি, তাদের জমি দখল করে ভেড়ি বানানো হয়েছে। বকেয়া টাকা দেয়া হয়নি। প্রতিবাদ করলে জুটেছে মারধর। পার্টির সভার কথা বলে নারীদের ডেকে নিয়ে গিয়ে রাতভর চালানো হয়েছে যৌন নিপীড়ন৷ প্রবল বিক্ষোভের মুখে বাধ্য হয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার৷ নেয়া হয়েছে জমি ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ৷

নারীদের প্রশ্ন

সন্দেশখালি আন্দোলনের সামনের সারিতে রয়েছেন নারীরা। তারা অভিযোগ তোলেন, তৃণমূলের নেতাদের হাতে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে। পুলিশে অভিযোগ জানিয়ে লাভ হয়নি।

যে সরকার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রীর মতো নারীকেন্দ্রিক প্রকল্প রূপায়িত করেছে, যাদের পক্ষে রাজ্যের অধিকাংশ নারী ভোটারের সমর্থন দেখা গিয়েছে বিগত নির্বাচনগুলিতে, তারাই বারবার পড়েছে সমালোচনার মুখে।

নদিয়ার হাঁসখালিতে এক নাবালিকাকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা এখনো রাজ্যবাসীর স্মৃতিতে অম্লান৷ ঘটনার মূল অভিযুক্ত স্থানীয় তৃণমূল নেতার ছেলে। পুলিশ তাকে পাকড়াও করলেও মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক হয়। তিনি অভিযুক্তের সঙ্গে মৃত কিশোরীর প্রেমের সম্পর্কের কথা বলেন। ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা ছিল- এমনও ইঙ্গিত দেন বর্তমানে দেশের একমাত্র নারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বিস্ফোরণ ও পুলিশ

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বারবার দেশি বোমা উদ্ধারের খবর সামনে এসেছে। বোমায় হতাহত হয়েছেন অনেকে। এখন যে ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা, সেই ভূপতিনগরে  তৃণমূল নেতার বাড়িতে জোরালো বিস্ফোরণ হয়। তাতে তিনজন মারা যান।

গত বছরের ১৬ মে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার খাদিকুল গ্রামে আরো ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ হয়েছিল। তৃণমূল নেতা ভানু বাগের বাড়িতে সেই বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু হয় নয় জনের।

এছাড়াও বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে মালদহের ইংরেজবাজার ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে। প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের নজর এড়িয়ে কীভাবে বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির ব্যবসা চলছিল?

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বোমা, গুলির ব্যাপক ব্যবহার দেখা গিয়েছে। সহিংসতায় ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

শাসকের ভূমিকা

সংবিধান অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলা যেহেতু রাজ্যের হাতে, তাই প্রতিটি ক্ষেত্রেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সমালোচিত হচ্ছে।

অভিযোগ উঠছে, পুলিশ শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সন্দেশখালির শাহজাহানের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে যতগুলো মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগে চার্জশিট হলেও কোনো মামলাতেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ৷ এমনকি সাম্প্রতিকতম ঘটনায় শাহজাহান প্রধান অভিযুক্ত হলেও দীর্ঘদিন তিনি জেলের বাইরে ছিলেন। সাত সপ্তাহ পর তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তার কারাগারে প্রবেশের দৃশ্যও ছিল ব্যতিক্রমী৷ শাহজাহান প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে হেঁটে যান, তার পেছন পেছন হেঁটে যেতে দেখা যায় পুলিশ কর্মীদের৷

এত কিছুর পরও অবশ্য রাজ্যসরকার ও শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়- আদালতের নির্দেশ থাকায় তারা অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। হাইকোর্ট এই বক্তব্য পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন, শাহজাহানকে টার্গেট করে ইডি এলাকায় গিয়েছিল। পরে দেখা গিয়েছে, শাহজাহান যাতে সিবিআইয়ের হাতে না পড়েন, সেজন্য আইনি লড়াই চালিয়েছে রাজ্য সরকার।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই পুলিশমন্ত্রী। বিরোধীদের দাবি, নজরের আড়ালে থাকা অসংখ্য অভিযোগের ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তার করে না।

যদিও শাসক শিবির বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি অন্য রাজ্য বা অতীতের শাসকদের কিছু ঘটনা নিজস্ব ব্যাখ্যায় তুলে ধরে৷ মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার একাধিকবার দাবি করেছেন, "আমরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। কোনো রং দেখি না। কিন্তু তৃণমূল বলেই আমাদের টার্গেট করা হচ্ছে ইডি, সিবিআই দিয়ে।"

শাসকের ভূমিকা নিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, "জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে দুষ্কৃতীরা রয়েছে। শাসক দলের এখনকার কয়েকজন বড় নেতাও দুষ্কৃতী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ছিল কংগ্রেস আমলে। পরে তারা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এর ফলে আজকের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।"

জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে দুষ্কৃতীরা রয়েছে: রঞ্জিত

আক্রান্ত পুলিশ

সন্দেশখালির মতো ওই জেলারই বনগাঁয় সাবেক পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেপ্তার করার সময়ও আক্রান্ত হয় কেন্দ্রীয় সংস্থা। সম্প্রতি ভূপতিনগরে আক্রমণের মুখে পড়েছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ।

শুধু কেন্দ্রীয় সংস্থা নয়, শাসক দলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশও। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে সন্দেশখালি শীতুলিয়া পুলিশ শিবিরে কয়েকজন দুষ্কৃতী ঢুকে কনস্টেবল সন্দীপ সাহার উপরে হামলা চালায়। তার মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় এখনো তিনি কলকাতায় চিকিৎসাধীন।

এই ঘটনায় তিনজন স্থানীয় তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী শাসক দলের পতাকা, ফেস্টুন খোলা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তৃণমূল কর্মীদের বচসা হয়। তার সঙ্গে এই হামলার যোগ থাকতে পারে।

বিরোধীদের অভিযোগ, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে রাজনৈতিক কারণে অপরাধীদের প্রতি ‘নরম' মনোভাব থাকায় তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে।

নারী আন্দোলনের কর্মী, অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, "দুষ্কৃতীরা সুযোগ পেয়ে যায়। রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে যায়। তাদের পোয়াবারো। কিন্তু সমাজের উপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। এক শ্রেণির মানুষের পুলিশ, প্রশাসনের উপর আস্থা হারিয়ে যায়।"

প্রশাসনের উপর আস্থা থাকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। বলেন, "প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা দায় অস্বীকার করলে মানুষ আইন নিজের হাতে নিতে চায়। পুলিশ বা এনআইএকে পেটানোর জন্য উস্কানি দেয়া খুব সহজ হয়ে যায়।"

অপরাধীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়ার পরম্পরা নতুন নয়। সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "প্রশাসনের নিয়ম অপরাধীর চরিত্র না দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। আমাদের দেশ এবং রাজ্যের দুর্ভাগ্য যে এটা হয় না। পশ্চিমবঙ্গে এটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, সিপিএমের আমল থেকে। রাজ্যের শাসক দল অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয়টাকেই গুরুত্ব দিয়েছে।"

এর ফল হচ্ছে ভয়াবহ। সুমন বলেন, "শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে প্রশাসন উদ্যোগী হয়নি। একবার শাস্তি না পেলে সবাই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের সে ব্যাপারটাই দেখা যাচ্ছে। অপরাধীরা প্রথম বারে যেহেতু সংযত হয়নি, তাদের বেপরোয়া ভাব বেড়ে যাচ্ছে।"

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান