পরিচালক-ফেডারেশনের দ্বন্দ্বে অচল টলিউড
৩০ জুলাই ২০২৪পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের একটি শুটিংকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে কলকাতার টলিপাড়া। টেকনিশিয়ানদের অভিযোগ, স্টুডিওপাড়ার নিয়ম লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে গিয়ে শুটিং করেছেন রাহুল। সেখানে কলকাতার কোনো টেকনিশিয়ানকে তিনি নেননি। টলিপাড়ায় এর নাম 'গুপি শুটিং'। আর এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই উত্তাল হয়ে উঠেছে টলিউড ইন্ডাস্ট্রি। পরিচালকেরা পাশে দাঁড়িয়েছেন রাহুলের। অন্য়দিকে গিল্ড এবং টেকনিশিয়ানদের ফেডারেশন জানিয়ে দিয়েছে, রাহুলের মতো পরিচালকদের সঙ্গে তারা কাজ করবেন না। এর হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে।
মূল ঘটনা
বাংলাদেশের একটি প্ল্য়াটফর্মের জন্য় ছবি বানাচ্ছেন রাহুল। ভারত এবং বাংলাদেশের অভিনেতারা কাজ করছেন সেখানে। আছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতাও। ছবির শুটিং কলকাতাতেও হওয়ার কথা ছিল। চারদিন শুটিং হয়েছেও। কিন্তু পরিচালক এবং প্রযোজক সংস্থার দাবি, বাংলাদেশের ছবি অর্থাৎ বিদেশি ছবি বলে টেকনিশিয়ানরা অনেক বেশি টাকা দাবি করে। এটাই টলিপাড়ার রীতি। প্রযোজক সেই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় কলকাতার শুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রযোজক শুটিং করেন বাংলাদেশে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার কোনো টেকনিশিয়ানকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আর এতেই রুষ্ট হয় ফেডারেশন তথা টেকনিশিয়ানেরা।
তাদের বক্তব্য, লুকিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে শুটিং করেছেন রাহুল। প্রতিবাদে রাহুলকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিচালক সংস্থা রাহুলকে দুইমাস কাজ করতে না পারার শাস্তিও দেয়। আর তারপরেই রাহুলের পাশে এসে দাঁড়ান টলিউডের প্রথম সারির পরিচালক এবং অভিনেতারা। মিটিং করে তারা জানান, রাহুলের শাস্তি তারা মানছেন না। পরিচালকদের অ্য়াসোসিয়েশন রাহুলের শাস্তি তুলে নেয়। আর তাতেই চটে যায় গিল্ড এবং ফেডারেশন। তারা জানায়, রাহুলের শাস্তি না হলে তারা কাজ করবেন না। শুরু হয় অচলাবস্থা।
বর্তমান পরিস্থিতি
ফেডারেশন এবং পরিচালকদের এই দ্বন্দ্ব সোমবার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছায়। সোমবার দুপুরে অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে মিলিত হন পরিচালকেরা। সশরীরে হাজির হতে না পারলেও ভিডিও কলে বৈঠকে যোগ দেন অভিনেতা তথা ঘাটালের সাংসদ দেব। বৈঠকের পর পরিচালকেরা জানান, তারা চান এই অচলাবস্থা কাটুক। দুইপক্ষের মধ্য়ে আলোচনা হোক। প্রয়োজনে মুখ্য়মন্ত্রী গোটা বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করুন।
ডয়চে ভেলেকে পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেছেন, ''মুখ্য়মন্ত্রী বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্বমানের করতে চান। এর জন্য় বিভিন্ন সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। আমরা চাই, এই ঘটনাতেও তিনি হস্তক্ষেপ করুন।''
অভিনেতা ঋদ্ধি সেন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''গুপি শুটিংয়ের অর্থ কী? অভিধান ঘেটেও তো এর কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। যে শব্দের কোনো অর্থই হয় না, তা নিয়ে এত লাফালাফি হচ্ছে কেন? কে বানিয়েছে এই নিয়ম?'' বস্তুত, ঠিক এই একই প্রশ্ন তুলেছিলেন অভিনেতা এবং পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্য়ায়। কোন আইনে ফেডারেশন এই সমস্ত নিয়ম তৈরি করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।
সোমবার পরিচালকদের বৈঠকের পর দেব জানান, তিনি চান দুইপক্ষ একসঙ্গে বসে একটি সমাধানসূত্র খুঁজুক। অচলাবস্থার জন্য় সার্বিকভাবে টলিউডেরই ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ফেডারেশনের বক্তব্য়
পরিচালকেরা সমঝোতার রাস্তা খুঁজলেও টেকনিশিয়ানরা সে রাস্তায় হাঁটতে রাজি হননি। এদিন বিকেলে ফেডারেশন একটি বৈঠক করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরূপ বিশ্বাস। তৃণমূল নেতা অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরেই টলিপাড়ায় দাপুটে নাম। তিনি ফেডারেশনের সভাপতি। তার নেতৃত্বে ফেডারেশনের সভায় ঠিক হয়, কোনোভাবেই গুপি শুটিং বরদাস্ত করা হবে না। সভা থেকে স্লোগান ওঠে, ''রাহুলকে পরিচালক হিসেবে মানছি না।'' বস্তুত, এদিন একটি ভোটাভুটির ব্য়বস্থা করা হয়েছিল। টেকনিশিয়ানদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, কারা রাহুলের সঙ্গে কাজ করতে চান। প্রায় সকলেই জানান, তারা চান না।
ফেডারেশনের এই সভার পর অচলাবস্থা কাটার কোনো দরজাই খুলল না বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। মঙ্গলবার ছবির পাশাপাশি সিরিয়ালের শুটিংও বন্ধ ছিল। কেবলমাত্র সেকেন্ড ইউনিটের কিছু কিছু শুটিং হয়েছে। বুধবারও অচলাবস্থা কাটার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
পিছনের রাজনীতি
বাম আমলে লোডশেডিংয়ের কারণে একবার অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল টলিপাড়ায়। সেই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং সত্য়জিৎ রায়। উত্তম কুমার, সত্য়জিৎ রায়েরা বৈঠক করেছিলেন তৎকালীন মুখ্য়মন্ত্রী জ্য়োতি বসুর সঙ্গে। সমস্যার সমাধান হয়েছিল। এরপর এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটল।
অভিযোগ, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্রমশ টলিপাড়ার বেতাজ বাদশাহ হয়ে উঠেছেন অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ। ছবি বা শিল্পের সঙ্গে যার দূরতম কোনো সম্পর্ক ছিল না। অথচ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ক্রমশ টলিপাড়ায় স্বরূপের প্রতিপত্তি বাড়ে। যা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন নেতা।
অভিযোগ, ফেডারেশনের কার্ড করতে হলেও স্বরূপের কৃপাদৃষ্টির প্রয়োজন হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার পর টেকনিশিয়ানদের অনেকেই সমাজ-মাধ্য়মে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ফেডারেশন তাদের কার্ড দেয়নি। ফলে তারা যোগ্য় ব্য়ক্তি হয়েও ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সুযোগ পাননি। অবজারভার হয়ে তাদের কাজ করতে হয়েছে। অবজারভর হয়ে কাজ করলে পুরো টাকা পাওয়া যায় না। ফলে আর্থিক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। শুধু তা-ই নয়, অর্থের বিনিময়ে ফেডারেশনের কার্ড করাতে হয়েছে এমন অভিযোগও উঠে আসছে সামনে। সব মিলিয়ে টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের দুর্নীতি বাইরে বেরিয়ে আসছে।