সেদিন ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ঐ দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন৷ এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছিলেন৷
আর এবার প্রাণ হারিয়েছেন নটর ডেম কলেজে তিনি উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাঈম হাসান৷ বুধবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারান ১৭ বছরের এই তরুণ৷ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ময়লার ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী৷ চালক নাকি গাড়িটি তাকে দিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিলেন৷ চালকের সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
নাঈম হাসানের মৃত্যুর প্রতিবাদে তার প্রতিষ্ঠান নটর ডেম ছাড়াও ঢাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন৷ তারা বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবি জানিয়েছেন৷
২০১৮ সালে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পরও নিরাপদ সড়কের দাবি জানানো হয়েছিল৷ ঐ দাবি মেনে ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাস করা হয়েছিল৷ সেখানে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু দুর্ঘটনা কমেনি৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের এক গ্রামে ছবির শুটিং স্পট দেখে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের প্রধান নিবার্হী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন৷ এ দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ ও শিল্পী ঢালী আল-মামুনসহ চারজন আহতও হয়েছিলেন৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
ক্ষতিপূরণ
দুর্ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বাস মালিক, চালক ও বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দু'টি মামলা দায়ের করেন৷ সেই মামলার একটির চূড়ান্ত রায়ে গত ডিসেম্বরে তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ আগামী তিন মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ করার নির্দেশ দেয়া হলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
মোজাম্মেল হোসেন মন্টু
দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন৷ ১৯৮৯ সালে মতিঝিলের আনন্দ কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন তিনি৷ এরপর তাঁর স্ত্রী রওশন আরা ১৯৯১ সালে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ ২০১৪ সালের ২০ জুলাই সাংবাদিক মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ৷ তবে তা এখনও পাননি মন্টুর পরিবার৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
জাহানারা কাঞ্চন
তিনি চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী ছিলেন৷ ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর স্বামীর শ্যুটিং দেখতে যাওয়ার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি৷ সে বছরই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং সড়ক চলাচল সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য ও দাবি নিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন ইলিয়াস কাঞ্চন৷ সমাজসেবায় ২০১৮ সালের একুশে পদক পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অভিনেতা৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
রাজীব হোসেন
৩ এপ্রিল ঢাকার কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে মধ্যে পড়ে প্রথমে হাত হারিয়েছিলেন তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন৷ মাথায়ও আঘাত পান তিনি৷ এরপর দুই সপ্তাহ চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ তবে তাঁকে বাঁচানো যায়নি৷ পরে রাজীবের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ দুর্ঘটনার পর দুই বাসের মাঝে এক হাত ঝুলে থাকার ছবি প্রকাশিত হলে সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
মানজারুল ইসলাম রানা
২০০৭ সালের ১৬ মার্চ খুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন জাতীয় দলের এই ক্রিকেটার৷ ২৩ বছর বয়সি রানা জাতীয় দলের হয়ে ছয়টি টেস্ট ও ২৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
জগলুল আহমেদ চৌধুরী
২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বাসস-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জগলুল আহমেদ চৌধুরী কারওয়ানবাজার এলাকায় বাস থেকে নামতে গিয়ে সেই বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন৷
-
আলোচিত যত সড়ক দুর্ঘটনা
নাজিম উদ্দিন
ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের একজন সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ছিলেন৷ ১৭ মে শনির আখড়া থেকে মোটর সাইকেলে গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলেন৷ এই সময় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুই বাসের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে একটি বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন তিনি৷ ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়৷ নাজিম উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে কেন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে সম্প্রতি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট৷
লেখক: জাহিদুল হক
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২০ সালে সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৬৮৬ জন৷ এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ৭০৬ জন, শিক্ষক নিহত হয়েছেন ১০৪ জন৷ আর পুলিশের দেয়া তথ্য উল্লেখ করে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চার হাজার ৩৫৮ জন৷
নীচের টাইমলাইনটি পড়লে সড়ক দুর্ঘটনা না কমার কারণগুলো স্পষ্ট হতে পারে:
- ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮: সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাস
- ৮ অক্টোবর, ২০১৮: গেজেট জারি
- ফেব্রুয়ারি, ২০১৯: আইন পাসের পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও সেটি কার্যকর করা যায়নি৷ কারণ আইনটিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা৷ এ লক্ষ্যে তারা ধর্মঘটও করেছেন৷ তাই আইনটি কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রেলমন্ত্রীর সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷
- ১ নভেম্বর, ২০১৯: আইন পাসের এক বছরেরও বেশি সময় পর আইনটি কার্যকর হয়৷ তবে আইনের কিছু ধারা শিথিল করার কথা ট্রাফিক পুলিশকে জানানো হয়৷
- ১৩ মে, ২০২১: পরিবহন শ্রমিকদের চাপের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়৷ সংশোধিত আইনের খসড়া তৈরি করে সেটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ওয়েবাইটে দেয়া হয়৷ ঐ খসড়ার উপর মতামত দেয়ার শেষ সময় ছিল ১৩ মে৷
- ২৫ নভেম্বের, ২০২১: খসড়াটি মন্ত্রিসভায় তোলা হবে৷ এরপর সংসদে পাঠানো হবে৷
জাহিদুল হক, ডয়চে ভেলে
টাইমলাইন থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর দাবি মেনে আইন করা হলেও সেটি পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি৷ বরং সেটিকে দুর্বল করার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে৷ কারণ পরিবহন শ্রমিকরা আইনের ১২৬টি ধারার মধ্যে ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন৷ এর মধ্যে কমপক্ষে ২৯টি ধারা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷
বর্তমানে সড়ক পরিবহন আইনের সবচেয়ে কঠোর ধারা তিনটি - ৮৪, ৯৮ ও ১০৫৷ এগুলো অজামিনযোগ্য অপরাধ৷
- ৮৪ ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে৷
- ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে৷
- ১০৫ নম্বর ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে৷
সংশোধনী খসড়ায় যা বলা হয়েছে:
- ৮৪ ও ৯৮ ধারাকে জামিনযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচনার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এছাড়া ৯৮ ধারাকে আপোষযোগ্য বলা হয়েছে৷
- ১০৫ ধারায় জরিমানা তিন লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ তবে পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিষয়টি রাখা হয়েছে৷ খসড়ায় বলা হয়েছে, ভুক্তভোগীর পরিবারকে জরিমানার টাকা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিশোধের জন্য আদালত আদেশ দিতে পারবে৷
আইন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ করা হয়ত সম্ভব নয়৷ তবে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা গেলে দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
ফুটওভার ব্রিজে অনীহা
সড়ক পারাপারে ঝুঁকি আছে জেনেও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছেন না শিক্ষার্থীরা৷ ফলে ঢাকার রাস্তায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার
রাজধানীর ব্যস্ত সড়কগুলোর মধ্যে একটি মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর৷ ব্যস্ত এই সড়কে প্রায়ই ঝুঁকি নিয়ে পার হতে দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের৷ ঢাকার অন্য সড়কের চিত্রও একই৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
অভিভাবকরাও দায়ী
ফুটওভার ব্রিজে না উঠে বা সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা না করে ঝুঁকি নিয়ে সন্তানদের রাস্তা পার করান অভিভাবকরা৷ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে এক বছর আগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সায় জানিয়েছিলেন এই অভিভাবকরা৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
তবুও নেই ভয়
দ্রুত গতির গাড়ির সামনে পা বাড়াতে দ্বিধা করেন না কেউ কেউ৷ ঢাকার সড়কে জেব্রাক্রসিং থাকলেও সেখানে গাড়ি থামে না৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
নিয়মই অনিয়ম
নিরাপদে সড়ক পার হতে ফুটওভার ব্রিজের পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিং রাখা হলেও সেখানে কারও পা পড়ে না৷ ঢাকার রাস্তায় অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
ভোঁ দৌড়
মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন কয়েক জন শিক্ষার্থী৷ ঢাকার রাস্তায় এমন দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে৷
-
ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক পার
চাই সচেতনতা
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শুধু চালকদের দায়ী করা হলেও সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷