বিমল জেঠুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বছরকয়েক আগে৷ অধুনা নব্বই পেরনো বিমল জেঠু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ষাটের দশকে পাড়ি দিয়েছিলেন অ্যামেরিকা৷ নব্বইয়ের দশকেও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে একটি কথা খুব প্রচলিত ছিল, কথাটা হলো ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’৷ পড়াশোনা করে অ্যামেরিকা চলে যাওয়াই তখন ছিল একমাত্র স্বপ্ন৷ উনিশ শতকে ঠিক যেমন ছিল বিলেতের স্বপ্ন৷ যুক্তরাজ্যে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ে আসতে পারলে ভবিষ্যৎ ঝকঝকে৷
মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে বিমল জেঠু আর কখনো দেশে ফেরেননি৷ আশি বছর বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন এক পঁচাত্তরের মার্কিনিকে৷ তাঁকে নিয়ে দেশে এসে খুব অবাক হয়েই অধমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘অ্যামেরিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখো না? সে কী কথা? কোয়ালিটি লাইফ নিয়ে তোমাদের প্রজন্মের কোনো ভাবনা নেই?’’
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
‘পাঁচ লাখ টাকা লস দিয়েও ফেরত যাবো’
সিলেট থেকে বসনিয়া আসা সাইফুর রহমানের এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ ওমান-দুবাই সাগর পাড়ি দিয়ে আসার পর আর ফেরত যাওয়ার চিন্তা করা সম্ভব না বলেও জানান তিনি৷ তবে যেভাবে কষ্ট করে জঙ্গলে থাকতে হচ্ছে, নির্যাতন সহ্য করে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে, তাতে এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তিনি৷ এখন কেউ যদি কেউ ১০ লাখ টাকাও তাকে দিতে চায়, তাহলে পাঁচ লাখ টাকা লস দিয়েও দেশে ফেরত যেতে চান তিনি৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
ওমানে ছয় মাস বেতন মেলেনি
ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এখন বসনিয়ার জঙ্গলে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন মাদারিপুরের ইয়াসিন খান৷ ওমানে ফ্লাইবোর্ডের কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি৷ কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে বেতন পাননি ছয় মাস৷ ফলে ইউরোপে স্থায়ী হওয়ার স্বপ্নে ওমান থেকে ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া হয়ে বসনিয়া আসেন তিনি৷ এই রাস্তা অতিক্রম করতে তার লেগেছে দুই বছর৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
বিজনেস ভিসায় তুরস্ক, তারপর বসনিয়া
মেরাজ শেখের বাড়ি গোপালগঞ্জ৷ বিজনেস ভিসায় তুরস্ক এসে সেখান থেকে অবৈধভাবে গ্রিসে আসেন তিনি৷ বসনিয়ার জঙ্গলে অতি কষ্টে থাকলেও এখনও বাঙালি খাবারের মায়া ছাড়তে পারেননি৷ কষ্ট করে জল, চাল ও লাকড়ি সংগ্রহ করে জঙ্গলেই চলছে ভাত রান্নার আয়োজন৷ এরই মধ্যে বসনিয়ায় তার এক বছর হয়ে গেছে৷ তিনবার সীমান্ত পাড়ির চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি৷ খরচ হয়ে গেছে ১৩ লাখ টাকা, আরো অন্তত চার লাখ টাকা লাগবে বলে মনে করছেন মিরাজ৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
বড় পরিবার চালাতে নিরুপায় হয়ে...
একদিন আগেই ‘গেমে’ গিয়ে স্লোভেনিয়ার পুলিশের হাতে আটকা পড়েন মৌলভীবাজারের শেখ লাকী৷ বসনিয়ায় ফেরত পাঠানোর আগে সীমান্তে তাকে ক্রোয়েশিয়া পুলিশ মারধরও করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি৷ ওমানে পাঁচ বছর কাটিয়েও দেশে পরিবারকে তেমন একটা আর্থিক সাহায্য করতে পারেননি তিনি৷ ফলে পরিবারের কথা চিন্তা করেই ফ্রান্সে যাওয়ার লক্ষ্যে রওয়ানা হয়েছেন লাকী৷ খরচ হয়ে গেছে ১৭ লাখ টাকা৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
সাগরে মৃত্যুর ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেকেই সাগর পথে ইরান, তুরস্ক বা গ্রিস আসেন৷ এ পথে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান রেহান আহমেদ৷ এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করেছেন তিনি৷ প্রতিবারই ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
ক্রোয়েশিয়া পুলিশের অত্যাচার
ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় পুলিশের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ডয়চে ভেলেকে দেখাচ্ছেন সুনামগঞ্জের নিখিল৷ জাতিসংঘের অভিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএম তাকে সীমান্ত থেকে নিয়ে এসেছে৷ এখন মিরাল ক্যাম্পে স্থান পেয়েছেন তিনি৷ নিখিলের সারা গায়ে পুলিশের লাঠির বাড়ির দাগ৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
রাজনৈতিক কারণে বিদেশ পাড়ি
সিলেটে রাজনৈতিক আক্রোশের শিকার হয়ে এখন বসনিয়ার মিরাল ক্যাম্পে আছেন বলে দাবি শায়েল আহমেদের৷ গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হলেও সেখান থেকে অন্য দেশে যাওয়া বেশ কষ্টকর৷ এজন্য বাধ্য হয়ে এখন বসনিয়ায় এসে সেখান থেকে ইটালি বা ফ্রান্স যাওয়ার চেষ্টা করছেন শায়েল৷
-
‘টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছি’
কুকুরের কামড়, ১৪ সেলাই
ডান হাতে ১৪টি সেলাই, একটি রগ কেটে গেছে একেবারেই৷ হাতে এখন আর শক্তিও পান না সিলেটের শফিক মিয়া৷ তার অভিযোগ, পুলিশের কুকুর কামড়ে তার এই অবস্থা করেছে৷ এখন চার মাস ধরে মিরাল ক্যাম্পে আছেন শফিক৷ তবে এরই মধ্যে তার কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে৷ ফলে দেশে ফেরার সুযোগও আর দেখছেন না তিনি৷ সুস্থ হয়ে উঠলেই আবার সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন শফিক৷
লেখক: অনুপম দেব কানুনজ্ঞ (বসনিয়া থেকে ফিরে)
বিশ শতকের শেষ অর্ধে জন্ম আমাদের প্রজন্মের৷ একুশ শতকের গোড়ার ভারতকে আমরা চিনি৷ নব্বইয়ের দশকে ভারতের অর্থনীতি মনমোহন সিংয়ের হাত ধরে ‘উদার’ হয়ে যাওয়ার পর মধ্যবিত্ত ভারতীয় দেশেই বিদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে৷ বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা ভারতে বাজার তৈরি করেছে৷ দেশে বসেই বিদেশি বেতনের চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ তাতে দেশের আদৌ উন্নতি হয়েছে কিনা, গরিব মানুষের সংস্থান হয়েছে কিনা, সেসব পণ্ডিতের আলোচনার বিষয়৷ বিতর্কেরও৷ মধ্যবিত্ত ভারতীয় বুঝে গিয়েছে, দেশে বসেই এখন কোয়ালিটি লাইফ বাড়িয়ে ফেলা যায়৷ বিদেশে গিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার চেয়ে দেশে রসে-বসে থাকা অনেক বেশি সম্মানের৷ বিদেশ হলো বেড়াতে যাওয়ার জায়গা, অথবা অফ শোর প্রজেক্টে৷ কয়েক মাস, অথবা কয়েক বছর৷ দু'হাতে টাকা নিয়ে দেশে ফিরে বড়লোকীপনা করা যায়৷
একুশ শতকের প্রথম দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বহু বন্ধু বিদেশ গিয়েছে৷ পড়াশোনা করতে৷ নব্বইয়ের দশকে আমার দিদি যখন অ্যামেরিকায় পড়তে গেল, তখনো তা ছিল একটা ব্যাপার৷ পাড়ায় বেশ খবর হয়েছিল৷ একুশ শতকের গোড়ায় আমাদের প্রজন্ম যখন বিদেশ যাচ্ছে, তখন তা সকলের কাছে জল-ভাত৷ যারা গেল, তাদের অধিকাংশই কিন্তু পড়া শেষ করে ফিরে এসেছে দেশে৷ দেশের বিবিধ বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিদেশি সংস্থায় মোটা মাইনের চাকরিতে ঢুকে পড়েছে৷ যারা থেকে গিয়েছে, তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনো সময় দেশে ফিরে আসার পরিকল্পনা করে রেখেছে৷ কেউ কেউ অবশ্য সুযোগ মতো পাসপোর্ট বদলে ফেলেছে, ভিসার সুবিধার্থে৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
জঙ্গলে বসবাস
এটি বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর ভেলিকা ক্লাদুসার একটি জঙ্গল৷ সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশো বাংলাদেশি৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন তারা৷ লক্ষ্য ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করা৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
পলিথিনের তাঁবু
সেখানে কোন স্থাপনা নেই৷ স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে পলিথিন কিনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাত কাটানোর সাময়িক ব্যবস্থা করেছেন তারা৷ এক একটি তাঁবুতে ১০ থেকে ১২ জন থাকেন৷ সোমবার সকালে সেখানে তাপমাত্রা ছিল দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ ঠাণ্ডা বা বৃষ্টি কোনটি থেকেই রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই এই আচ্ছাদনে৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
‘পুলিশ সবকিছু কেড়ে নেয়’
ইয়াসিন নামে একজন জানান, ওমান থেকে স্পিড বোটে করে তিনি ইরান থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে আসেন৷ তারপর গ্রিস থেকে আসেন বসনিয়াতে৷ ‘‘সর্বশেষ গত তিনদিন আগে ক্রোয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করি৷ সে সময় কিছুটা (ক্রোয়েশিয়ার) ভিতরে ঢুকেছিলাম৷ কিন্তু পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাই৷ পুলিশ আমার সবকিছু কেড়ে নেয়৷ শুধু আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায় আমাকে এখানে ফেরত পাঠায়৷’’
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
লাখ টাকা খরচ
মোটা অংকের টাকা খরচ করে দালালদের মাধ্যম ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন তারা৷ ‘‘১৮ থেকে ২০ লাখ খরচ করে এখানে এসেছি৷ বিভিন্ন দেশে দালালদের এ টাকা দিতে হয়েছে আমাদের৷ এ মুহূর্তে দেশে গেলে নিঃস্ব হয়ে যাব আমরা,’’ জানালেন একজন৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
গোসলের সুযোগ
আশেপাশে নেই বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা৷ বৃষ্টিতে নীচু জমিতে পানি জমেছে, যা গোসল আর কাপড় ধোয়ার সুযোগ করে দিয়েছে অভিবাসন প্রতাশীদের৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
মিরাল ক্যাম্প
কাছেই আছে জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা’ আইওএম পরিচালিত মিরাল ক্যাম্প৷ ক্যাম্পে মোট সাতশ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে৷ এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ পাকিস্তানি অভিবাসনপ্রত্যাশী৷ বাংলাদেশিদের হার ২৮ শতাংশ৷ এছাড়া মরক্কো, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আলজেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও আছেন সেখানে৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
ক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা
ক্যাম্পের ব্যবস্থাপক আইওএম কর্মকর্তা মিতে চিলকোভস্কি জানান, ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দিনে তিন বেলা খাবার দেয়া হয়৷ পাশাপাশি তাদের অন্য সামগ্রীও দেয়া হয়৷ এছাড়া স্থানীয় ডাক্তারদের দিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে থাকা আহত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের চিকিৎসা দেয়া হয়৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
নির্যাতন
বসনিয়া সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ক্রোয়েশিয়ার পুলিশের বাধা ও তাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন ক্যাম্পে বাস করা বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীরা৷ যেমন সিলেট থেকে আসা শফিক মিয়া তার ডানহাতে থাকা কুকুরের কামড়ের ক্ষত দেখিয়েছেন৷ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ কুকুর ছেড়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি৷ ছবিতে নির্যাতনের চিহ্ন দেখাচ্ছেন মিরাল ক্যাম্পে থাকা আরেক বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
পরিত্যাক্ত কারখানা
বেশিরভাগেরই ঠাই মেলেনি মিরাল ক্যাম্পে৷ তাদের বড় একটি অংশই আশ্রয় নিয়েছেন জঙ্গলে৷ সেখানেও এখন থাকার জায়গা নেই৷ বাকিরা তাই বেছে নিয়েছেন পাশের একটি পরিত্যাঙ্ক কারখানা ভবন৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
শতাধিক
এই কারখানা ভবনেও শতাধিক বাংলাদেশির দেখা পেয়েছেন ডয়চে ভেলের দুই সংবাদকর্মী৷ বাংলাদেশির পাশাপাশি আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে আসা শরণার্থীরাও আছেন সেখানে৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
দেয়াল, ছাদবিহীন ভবন
কারখানা ভবনটির চারপাশের একটি বড় অংশেই দেয়াল নেই৷ এমনকি ছাদের অনেকটা অংশই ফাঁকা৷ যার কারণে অনায়াসে বৃষ্টির পানি ঢুকছে সেখানে৷ আছে শীতের প্রকোপও৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
পুলিশের তাড়া
অভিবাসীদের অভিযোগ কারখানাতে অনেক সময় পুলিশ আসে৷ সেসময় তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যেতে হয় সেখান থেকে৷ পরে আবারো এসে আশ্রয় নেন তারা৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ভবনটির মেঝেতে জমে আছে পানি৷ পাশেই ময়লার স্তূপ৷ এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলো৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
এক জায়গায় সব
অস্বাস্থ্যকর সেই পরিবেশে রান্না, খাওয়া আর থাকার ব্যবস্থা৷ খাবার কিনতে হয় স্থানীয় সুপার মার্কেট থেকে৷ তবে সেজন্যেও বহু কাঠখড় পোহাতে হয়৷ অনেকের কাছে নেই পর্যাপ্ত টাকাও৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
ছিনতাইয়ের ভয়
মানবেতর এই পরিস্থিতিতে আরেক বিপদ ছিনতাই৷ রাতের বেলা বাইরে বের হয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
স্থানীয়দের সহযোগিতা
তবে অনেক সময় স্থানীয়দের কেউ কেউ সহযোগিতাও করেন৷ ছবির ব্যক্তির সামনে রাখা চুলাটি সেভাবেই মিলেছে৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
অবশেষে সহায়তার দেখা
গত কয়েক মাসে ক্যাম্পের বাইরে থাকা এই শরণার্থীরা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থা থেকে মানবিক সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ৷ তবে ১৯ অক্টোবর আইওএম এর একটি দল সেখানে উপস্থিত হন৷ ছয়শো জনকে তারা কিছু খাবার আর স্লিপিং ব্যাগ দিয়েছেন৷ প্রথমবারের মতো এমন সহায়তা মিলেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশিরা৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
প্রাথমিক চিকিৎসা
সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন৷ আবার ক্রোয়েশিয়া পুলিশের নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ৷ তেমনই একজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন রেডক্রসের কর্মীরা৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
‘গেম মারা’
আটকা পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীরা দালালের মাধ্যমে দল বেঁধে চেষ্টা করেন সীমান্ত অতিক্রমের৷ এটিকে তারা বলে থাকেন ‘গেম মারা’৷ তবে বেশিরভাগই ব্যর্থ হোন৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আবার ফিরে আসেন জঙ্গলেই৷
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
ইউরোপ কত দূর
এই বাংলাদেশিদের কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে ঢুকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দুই-তিন বছর ধরে৷ এর মধ্যে দালালকে দিয়েছেন ১৫-২০ লাখ টাকা করে৷ তবুও দেখা মেলে না প্রত্যাশিত গন্তব্য ফ্রান্স বা ইটালির৷ একজন বলেছেন, ‘‘ওমান, দুবাইর সাগর পাড়ি দেয়ার পর পেছনে যাওয়ার উপায় নাই৷ ইটালি ম্যাপে দেখতে অনেক ছোট লাগে, কিন্তু যেতে অনেক সময় লাগে৷ অনেক কষ্ট৷’’
-
ইউরোপের স্বপ্ন বন্দি বসনিয়ার জঙ্গলে
আর যেন কেউ না আসে
বেশিরভাগই জানিয়েছেন তারা এভাবে এসে ভুল করেছেন৷ টাকা দিয়ে বিপদ কিনেছেন৷ এতটা অবর্ণনীয় কষ্টে পড়তে হবে কেউ ভাবেননি৷ তাদের মতো কেউ যেন আর অবৈধপথে পাড়ি না জমায় সেই অনুরোধ জানান৷
লেখক: আরাফাতুল ইসলাম, অনুপম দেব কানুনজ্ঞ
তেমনই এক থেকে যাওয়া বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম অস্ট্রিয়ায়৷ বছর দশেক আগে৷ কার্যত পোশাকহীন অস্ট্রিয়া সে বছর জমিয়ে গরম উপভোগ করছে৷ মনে আছে, ভিয়েনার সিটি সেন্টারে মোৎসার্ট থিয়েটারের টিকিট কাটতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল এক বাঙালির সঙ্গে৷ বলতে দ্বিধা নেই, মধ্যবিত্ত পরিশীলতা ছিল না তাঁর মধ্যে৷ পেশায় রেস্তোরাঁকর্মী ওই বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার এক হদ্য গ্রামের বাসিন্দা৷ কিভাবে অস্ট্রিয়ায় পৌঁছে গেলেন, তা বলতে ঘণ্টাখানেক সময় নিয়েছিলেন৷ দশ ক্লাসের পর পড়াশোনা ছেড়ে বাবার জমিতে চাষ, এই ছিল তাঁর ভবিতব্য৷ সেখান থেকে অস্ট্রিয়া পৌঁছানোর গল্প অনেকটা রূপকথার মতোই৷ আজ যেই অভিবাসীরা বসনিয়া সীমান্তে আটকে পড়েছেন এবং খবর হচ্ছেন, ভাগ্য সহায় না হলে ওই ভদ্রলোকও তেমন খবর হতে পারতেন৷ প্রায় বছরখানেকের চেষ্টায় এ দেশ ও দেশে পালিয়ে বেরিয়ে অবৈধ ভাবে অস্ট্রিয়ায় পৌঁছান তিনি৷ বিয়েও করেন এক অস্ট্রিয়ার নারীকে৷ অর্থের বিনিময়ে৷ তাতে নাকি বৈধ নথি পেতে সুবিধা হয়৷ সেই থেকে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় কাজ করতে শুরু করেছেন ওই বাঙালি৷ এখন শেফের সহযোগীর প্রোমোশন পেয়েছেন৷
যে ভদ্রলোকের কথা বললাম, তিনি মধ্যবিত্ত ছিলেন না৷ কিন্তু বিদেশের স্বপ্ন বা মোহ ছিল তাঁর৷ তিনি জানতেন, বিদেশ চলে যেতে পারলে জীবন বদলে যায়৷ ঠিক যেমন এক সময় মধ্যবিত্ত বিমল জেঠুরা ভাবতেন৷ শিক্ষিত বিমল জেঠুরা বৈধ পদ্ধতিতে বিদেশ গিয়েছিলেন৷ 'অশিক্ষিত' ওই রাঁধুনি অন্য রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন৷ বিদেশ, তা মধ্যপ্রাচ্যও হতে পারে, অ্যামেরিকাও হতে পারে, অথবা ইউরোপ৷ দালাল যেখানে পৌঁছে দেবে৷ বলার কথা এই যে, উনিশ-বিশ শতকে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত ভারতীয় যে স্বপ্ন দেখতেন, একুশ শতকে সেই স্বপ্ন দেখছেন নিম্নবিত্ত মানুষ৷ এখন উচ্চ ও মধ্যবিত্তের বিদেশে গিয়ে থেকে যাওয়ার চাহিদা কম, নিম্নবিত্তের বেশি৷
তথ্য দিয়ে এ লেখা ভারাক্রান্ত করার ইচ্ছে নেই৷ তবু সামান্য নথি তুলে ধরা যাক৷ হিসেব বলছে, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শুধুমাত্র অ্যামেরিকায় ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে ৩৬ শতাংশ৷ ২০১৭ সালে অ্যামেরিকায় অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা ছি্ল পাঁচ লাখ ২৫ হাজার৷ ২০১০ সালে সেই সংখ্যাটাই ছিল চার লাখ৷ তার দশ বছর আগে সংখ্যাটা ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার৷ এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট দালাল ধরে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে৷ নিম্নবিত্ত মানুষ সে পথ নিচ্ছেন৷ তুলনায় মধ্যবিত্ত বৈধ পথে থাকার জন্য কম যাচ্ছেন৷
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে
অর্থাৎ, যত দিন যাচ্ছে, ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় অবৈধ ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বাড়ছে৷ দেশের গরিব মানুষ এখন অ্যামেরিকান ড্রিমে মগ্ন৷ পাঞ্জাব থেকে কী ভাবে অবৈধ পথে ক্যানাডা এবং অ্যামেরিকায় নাগরিকদের নিয়ে যাওয়া হয়, তা নিয়ে বছর দুয়েক আগে এক চমৎকার ছবি বানিয়েছিলেন এক পরিচালক৷ উল্লেখ্য, এক সময় তিনিও ওই পথেই ক্যানাডায় গিয়েছিলেন৷ জড়িয়ে পড়েছিলেন অপরাধমূলক কাজে৷ থাকতে পারেননি৷ ফিরে এসেছেন দেশে৷ আবার এ-ও সত্য, যাঁরা বিদেশ যাচ্ছেন অবৈধ পথে, তাঁদের অনেকেই দেশে অবৈধ কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন৷
চাকরি সূত্রে আমার স্ত্রী থাকেন গুজরাতে৷ ওর বাড়িওয়ালা গল্প শুনিয়েছিলেন, কিভাবে গুজরাত ফাঁকা করে হাজার হাজার মানুষ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন অবৈধ ভাবে৷ প্রথমে নিজে যাচ্ছেন, তারপর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাচ্ছেন সুযোগ মতো৷ আবার বিদেশ যেতে গিয়ে বন্দি হয়েছেন, এমন গল্পও আছে৷ এমন পরিবারের সঙ্গেও কথা হয়েছে, যাঁদের পরিবারের কোনো এক সদস্যের সঙ্গে দশকের পর দশক কোনো যোগাযোগ নেই৷ শেষ খবর মিলেছিল, অভিবাসন দফতর আটক করে জেলে পুড়ে দিয়েছে৷
বসনিয়ায় যে বাংলাদেশি মানুষদের ছবি তুলে ধরেছেন সহকর্মী অনুপম এবং আরাফাতুল ভাই৷ তাঁদের সঙ্গে ভারতের বহু মানুষের চেহারার কোনো তফাত নেই৷ তাঁরা যা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুজরাত-- একই কথা শুনেছি বিভিন্ন মানুষের মুখে৷ তাঁদের স্বপ্ন, অর্থনৈতিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা-- সবই কেমন একরকম৷ সমস্যাটা আসলে কোয়ালিটি লাইফের৷ ভালো খারাপের নিক্তিতে যার বিচার হয় না৷ বৈধ, অবৈধ এ সব কথারও আসলে কোনো অর্থ হয় না৷ মানুষ যখন মরিয়া হয়ে স্বপ্নের পিছনে ছোটে, ইতিহাস তাকে দুই ভাবে মনে রাখে-- অপরাধী অথবা হিরো৷