1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ডাক্তার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী: সহমত ও দ্বিমত

৭ এপ্রিল ২০২০

করোনা সংক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না বিশ্বের কোনো দেশই৷ ফলে ইউরোপ বা আফ্রিকা, ধনী বা গরীব, সব দেশেরই স্বাস্থ্য খাত সেই ধাক্কা সামলাতে টালমাটাল৷ কিন্তু আমার জানা মতে কোনো দেশেই চিকিৎসকেরা আত্মসমর্পণ করেননি৷

https://p.dw.com/p/3aaTZ
যেসব চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন না তারা ভবিষ্যতে চাকরি পাবেন কিনা, ভাবতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীছবি: DW

অথচ বাংলাদেশে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে পড়ছে৷ একের পর এক চিকিৎসা না পেয়ে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যু সংবাদ আসছে৷ প্রধানমন্ত্রীও শেষ পর্যন্ত সে ক্ষোভ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন৷ যেসব চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন না, ভবিষ্যতে তারা চাকরি করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে ভাবার কথাও বলেছেন তিনি৷

প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত, কিছু বক্তব্যের সঙ্গে না৷ প্রথমে একমত হওয়া বিষয় নিয়েই বলি৷

জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা অন্য অনেক দেশ তো বটেই, আশেপাশের ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক ভালো বলে বিবেচনা করা হয়৷ কিন্তু এখানেও ডয়চে ভেলেই কদিন আগে সংবাদ প্রকাশ করেছে, নার্সরা কেবল হাততালি পান, পর্যাপ্ত বেতন না৷ এদিকে লাখের ওপর করোনা রোগী সামলাতে হচ্ছে তাদের, টান পড়েছে পিপিই, গ্লাভস, মাস্কেও৷  সংকট এতোটাই তীব্র হয়েছে যে জার্মানির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক মাস্ক কিভাবে একাধিকবার ব্যবহার করা যায় সে নির্দেশনাও দিতে বাধ্য হয়েছে৷

কিন্তু কখনও শুনিনি এক মুহূর্তের জন্য একজন ডাক্তার বা নার্স কোনো রোগীকে চিকিৎসা দিবেন না বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ বরং ফ্রান্স ও ইটালি থেকে জার্মানিতে রোগী এনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ এদের কেউ কেউ রয়েছেন আমার শহর বনেও৷ একবারের জন্যও কেউ বলেননি, আমরা চিকিৎসা দিবো না৷ উল্লেখ্য এরই মধ্যে আড়াই হাজারের বেশি স্বাস্থকর্মী নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাস সংক্রমণে৷

ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে ৬৫ হাজারের বেশি অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্সকে চিঠি দেয়া হয়েছে৷ অনুরোধ জানানো হয়েছে আবার কাজে যোগ দেয়ার৷ দলে দলে ডাক্তার ও নার্স সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আবার কাজে যোগ দিচ্ছেন৷

বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সেই দেশে নিয়মিত বিক্ষোভ করছেন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ ‘আমাদের পিপিই কোথায়?' লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রাস্তায় নামছেন, আবার বিক্ষোভ শেষ করে চোখের জল মুছে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামছেন৷

মার্কিন অবরোধে বিপর্যস্ত ছোট্ট দেশ কিউবা হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ডাক্তারদের একটি দল পাঠিয়েছে ইটালিকে সহায়তা করার জন্য৷ বিশ্বব্যাপী ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এই আত্মত্যাগ ও পরার্থপরতার গল্প ছোট লেখায় জায়গা করার মতো না৷

কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেনো হবে? শুরুতে পিপিই ছিল না, সে নিয়ে আমরাও যথেষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি, ক্ষুব্ধ হয়েছি৷ কিন্তু এখন আপনারা হবেন আমাদের আশার আলো, আপনারা দিবেন নেতৃত্ব, আপনারা হবেন যুদ্ধের সেনাপতি-সৈনিক৷ অথচ আপনারা অনেকে আত্মসমর্পণ করে ময়দানে আমাদের ফেলে পালাচ্ছেন৷ এভাবে চলবে? আপনারা হাসপাতাল বন্ধ করে দিবেন, রোগীদের ফিরিয়ে দিবেন, এমন দুধের মাছি চিকিৎসক দিয়ে আমরা কী করবো?

প্রশ্ন উঠতে পারে এমন সেনাবাহিনী দিয়ে আমরা কী করবো, যার অস্ত্র নাই, ট্যাংক-বিমান নাই, ইউনিফর্ম নাই৷ আমি জানি এবং মানি৷ এই বিষয়েই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার দ্বিমত৷

প্রয়োজনে বিদেশ থেকে চিকিৎসক, নার্স নিয়ে আসার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ এটা হয়তো ক্ষোভের কথা, বাস্তবে তা সম্ভব না৷ এই সংকট কেবল করোনাকালীন নয়, চিরকালের৷ আমাদের বার্ষিক বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ থাকে নিতান্তই অপ্রতুল৷ মন্ত্রী এমপিরা সুযোগ পেলেই চিকিৎসা করাতে দৌড়ান বিদেশে৷ সাধারণ মানুষেরও আস্থা উঠে গেছে ধীরে ধীরে, হাজার হাজার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষও এখন ভারতে যান চিকিৎসা করাতে৷

এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি৷ বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যনীতি কী, স্বাস্থ্যবিমা কী মানুষ জানেন না৷

HA Asien | Anupam Deb Kanunjna
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

সেই জানুয়ারিতে চীনের উহানে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকে আমরা শুনে আসছি আপনারা প্রস্তুত৷ এই আপনাদের প্রস্তুতি­? বিমানবন্দর থেকে কিভাবে করোনা আক্রান্ত মানুষ ছাড় পেল? প্রবাসীদের ঘরে রাখার কোন সঠিক ব্যবস্থা কেন রাখতে পারলেন না? গার্মেন্টস কারখানায় নৈরাজ্য চলছে কেন? চিকিৎসকদের কেন শুরুতেই মাস্ক-পিপিইর সংকটে পড়তে হলো? রোগীদের কেন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে? মানুষ আসলে আদৌ সামনে কী করবে, তা জানে না কেন? এখন এসে কেন চিকিৎসকদের উদ্দেশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হচ্ছে? তিন মাস প্রস্তুতি নিয়ে আপনারা যে সার্কাস দেখাচ্ছেন, প্রস্তুতি না নিলে কী হতো ভাবতেই নিজেকে করোনা আক্রান্ত মনে হচ্ছে৷

কিছুসংখ্যক চিকিৎসক নিজের জীবন, নিজের পরিবারের কথা না ভেবে জানবাজি লড়ছেন, আর কিছু চিকিৎসক রোগীদের মনে করেন টাকার মেশিন৷ আজ বিপদে পড়ে আমরা ডাক্তারদের কথা ভাবছি, ডাক্তারদের গালমন্দ করছি৷ কিন্তু বিপদ একদিন চলে যাবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে? আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলে, যেই লাউ সেই কদু৷ গোড়ার গলদ পারলে ঠিক করে ফেলুন৷

পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসককেই মাঠে নামার আগে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী একটি শপথ করতে হয়- ‘আমি মানবতার সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ করলাম', ‘আমার রোগীর স্বাস্থ্য হবে আমার প্রথম বিবেচনা'৷ তবে আমার বিবেচনায় এ শপথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘রোগীর প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই বয়স, রোগ বা অক্ষমতা, ধর্মবিশ্বাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, লিঙ্গ, জাতীয়তা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বর্ণ, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনো কিছু বিবেচনায় আনবো না৷'

প্রিয় চিকিৎসকেরা৷ আপনারা বিশ্বজুড়ে যা করে দেখাচ্ছেন, আমি অনেক আগেই আপনাদের স্যালুট দিয়ে রেখেছি৷ এবার দয়া করে শপথ পালন করুন৷