টেস্ট সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪‘বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে' সুকুমার রায়ের কবিতা ডিজে গান হয়ে বাজছিল রাওয়ালপিন্ডির গ্যালারিতে৷ ওভারের বিরতিতে কখনও ভেসে আসছিল ‘শাবাশ বাংলাদেশ' গানের সুর৷
বিদেশের মাটিতে এভাবে টেস্টের ফাঁকে বাংলা গান অপ্রত্যাশিত রীতিমতো৷ তেমনি অপ্রত্যাশিত ছিল পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করা পারফর্ম্যান্স৷ কারণ, এই সিরিজের আগে পাকিস্তানে খেলা ২০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ৷ আর পাকিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজের আগে টেস্টের ফল ছিল ০-১২!
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর টেস্টেও বিপ্লব হলো রীতিমতো৷ রাওয়ালপিন্ডিতে প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ৷ সেই জয়টা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না৷ একই ভেন্যুতে বৃষ্টিতে চার দিনে নেমে আসা ম্যাচে আজ (মঙ্গলবার) দ্বিতীয় টেস্টেও দাপটে ৬ উইকেটে জিতে সেটা প্রমাণ করল নাজমুল হোসেনের দল৷
বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান হোয়াইটওয়াশ হলো ২-০তে৷ ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে প্রথমবার ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল পাকিস্তান৷ দেশের মাটিতে সেবারই প্রথম হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল তারা৷ দুই বছর না যেতে বাংলাদেশ সেই লজ্জা দিল দ্বিতীয়বার৷
নিজেদের ২৪ বছরের টেস্ট ইতিহাসে বাংলাদেশ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুইবার ও জিম্বাবুয়েকে একবার হোয়াইটওয়াশ করেছে৷ এই তালিকায় এবার যোগ হলো পাকিস্তানের নাম৷ ২০০৯ সালে জয়টা ছিল দ্বিতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে আর এবারের সাফল্য সময়ের অন্যতম সেরা দলের সঙ্গে৷
বাংলাদেশের দাপট এতটাই ছিল যে পেসার মির হামজা, খুররম শেহজাদরা নন বেশি ভয় ছিল বৃষ্টি আর কালো মেঘ নিয়ে৷ অথচ একটা সময় টেস্ট বাঁচাতে বৃষ্টির প্রার্থনাই করতেন বাংলাদেশি সমর্থকরা! রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ দিন সকালে বজ্রসহ বৃষ্টির শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সূর্য হেসেছে সকাল থেকে৷ সেই হাসি ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশিদের ব্যাটেও৷
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং গড় ছিল ৩২.৫৫, যা এই সময়ে যেকোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ তাই জয়ের পাল্লাটা ঝুঁকে ছিল বাংলাদেশের দিকেই৷ পাকিস্তানি বোলাররা পারেননি অঙ্কটা বদলে দিতে৷
চতুর্থ দিন শেষে দুই ওপেনার জাকির হাসান ও সাদমান ইসলাম অপরাজিত ছিলেন ৪২ রানে৷ শেষ দিন দরকার ছিল ১৪৩ রান৷ মঙ্গলবার দিনের শুরুতেই ভারতীয় তারকা স্পিনার রবীচন্দ্রন অশ্বিন ‘এক্স’-এ লিখেন, ‘‘বাংলাদেশ এগিয়ে আছে তবে পাকিস্তানও নিজেদের দিকে আনতে পারে ম্যাচটা৷’’ সেটা আর হয়নি শেষ পর্যন্ত৷
দশম ওভারে মোহাম্মদ আলীর বলে জাকির হাসানের ব্যাটের নিচের অংশ ছুঁয়ে গিয়েছিল উইকেটরক্ষক সরফরাজ আহমেদের গ্লাভসে৷ বিস্ময়করভাবে পাকিস্তান আউটের আপিলই করেনি, আম্পায়ারও আউট দেননি৷
‘জীবন’ কাজে লাগিয়ে ইনিংসটা বড় করতে পারেননি জাকির৷ ৩৯ বলে ৪০ রান করা জাকিরকে বোল্ড করেন মির হামজা৷ গুড লেংথে পড়ে হালকা মুভমেন্টে বেরিয়ে যাওয়া বলটির লাইন মিস করে বোল্ড হন বাংলাদেশের এই ওপেনার৷
স্লিপে অপর ওপেনার সাদমান ইসলামের ক্যাচ ছেড়েছিলেন সালমান আগা৷ সাদমানও জীবন কাজে লাগাতে পারেননি৷ খুররম শেহজাদের করা পরের ওভারেই ফোর্থ স্টাম্পের হাফভলিতে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দেন শান মাসুদকে (২৪ রান)৷
সিরিজ জুড়ে বিবর্ণ থাকা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন এরপর মুমিনুল হকের সঙ্গে জুটি গড়ে জয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান বাংলাদেশকে৷ লাঞ্চ পর্যন্ত তৃতীয় উইকেটে দুজন গড়েন ৫২ রানের জুটি, বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ১২২৷ জয়ের জন্য বাকি তখন ৬৩ রান৷
লক্ষ্য অল্প হলেও এই টেস্ট যেভাবে বারবার রং বদলেছে তাতে নিশ্চিত ছিল না কিছুই৷ প্রথম ইনিংসে ১ উইকেটে ১০৭ থেকে পাকিস্তান অলআউট হয়ে গিয়েছিল ২৭৪ রানে৷ মেহেদী হাসান মিরাজ নিয়েছিলেন ৫ উইকেট৷ জবাবে বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে৷
সেখান থেকে ফিনিক্স পাখির মতোই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায় লিটন দাস ও মেহেদী হাসান মিরাজের সপ্তম উইকেটে ১৬৫ রানের জুটিতে৷ ৩০ রানের কমে ৬ উইকেট হারানোর পর টেস্ট ইতিহাসেই সপ্তম উইকেটে এই জুটিটা সর্বোচ্চ৷ লিটন দাস ১৩৮ আর মেহেদী হাসান খেলেন ৭৮ রানের ইনিংস৷ দলের স্কোর পঞ্চাশের কম থাকার সময় ব্যাটিং অর্ডারে পাঁচের নিচে নেমে লিটন করেছেন ক্যারিয়ারে তৃতীয় সেঞ্চুরি, টেস্ট ইতিহাসেই এমন কীর্তি গড়া প্রথম ব্যাটার তিনি৷
শোয়েব আখতারের শহর রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় ইনিংসে দাপট দেখান বাংলাদেশের পেসারা৷ ১০ উইকেটই নেন তিন পেসার হাসান মাহমুদ (৫ উইকেট), নাহিদ রানা (৪ উইকেট) ও তাসকিন আহমেদ (১ উইকেট)৷ টেস্টে এবারই প্রথম কোনো ইনিংসে ১০ উইকেটই নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা৷ নাহিদ রানা চতুর্থ দিন ঘণ্টায় একটি বল করেছিলেন ১৫২ কিলোমিটার গতিতে, যা বাংলাদেশি পেসারদের মধ্যে টেস্ট ইতিহাসেই সর্বোচ্চ৷
পেসারদের এমন দাপটের পর দায়িত্ব নিতে হতো ব্যাটসম্যানদের৷ দুই ওপেনারের বিদায়ের পর সেই দায়িত্বটা নেন তারা৷ নাজমুল হোসেন ও মুমিনুল হক তৃতীয় উইকেটে গড়েন ৫৭ রানের জুটি৷ লাঞ্চের পরই পার্টটাইম স্পিনার সালমান আগার বলে ৩৮ রানে ফেরেন নাজমুল হোসেন৷ একটু আগে শট খেলে শর্ট লেগে আব্দুল্লাহ শফিককে ক্যাচ দেন বাংলাদেশি অধিনায়ক৷
চতুর্থ দিন বাংলাদেশের হয়ে ফিল্ডিংয়ে নামেননি মুশফিকুর রহিম৷ তাঁর জায়গায় ফিল্ডিং করেছিলেন নাঈম হাসান৷ দ্বিতীয় দিনে কাঁধে আঘাত পাওয়া মুশফিক স্বাচ্ছন্দ্যই ছিলেন ব্যাট হাতে৷ আবরার আহমেদ টানা দুই বলে দুটি রিভিউ নিলেও দুবারই বল ব্যাটে লেগেছিল মুশফিকের৷
মুমিনুল হককে নিয়ে বাকি পথটা পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন মুশফিক৷ কিন্তু জুটিটা ভাঙে ২৬ রানে৷ আবিরার আহমেদের বল মিড অনে থাকা ফিল্ডারের মাথার ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে ৩৪ রান করা মুমিনুল ক্যাচ দেন সাইম আইয়ুবকে৷
বাকি পথটুকু সাকিব আল হাসানকে নিয়ে পাড়ি দেন মুশফিক৷ সাকিব ২১ ও মুশফিক অপরাজিত থাকেন ২২ রানে৷ আবরার আহমেদের বল কাভার দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে জয় নিশ্চিত করেন সাকিব৷ তাতে বাংলাদেশ পায় পাকিস্তানের মাটিতে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়৷
সংক্ষিপ্ত স্কোর
পাকিস্তান : ২৭৪ ও দ্বিতীয় ইনিংস ৪৬.৪ ওভারে ১৭২/১০ (সালমান ৪৭, রিজওয়ান ৪৩, মাসুদ ২৮; হাসান ৫/৪৩, নাহিদ ৪/৪৪)৷
বাংলাদেশ : ২৬২ ও দ্বিতীয় ইনিংস ৫৬ ওভারে ১৮৫/৪ (জাকির ৪০, নাজমুল ৩৮, মুমিনুল ৩৪; আবরার ১/৪০, হামজা ১/৪৬)৷
ফল : বাংলাদেশ ৬ উইকেটে জয়ী
সিরিজ : বাংলাদেশ ২-০তে জয়ী
ম্যান অফ দ্য ম্যাচ: লিটন দাস
ম্যান অফ দ্য সিরিজ: মেহেদী হাসান মিরাজ