1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আলোড়ন তুলেছে ‘‌জুলফিকার’

১২ অক্টোবর ২০১৬

বাংলা সিনেমার হালের পরিচালকদের অন্যতম সৃজিত মুখার্জির ছবি ‘‌জুলফিকার'‌ কলকাতার শিক্ষিত মুসলিম সমাজে আলোড়ন ফেলেছে৷ এবং সেটা সঙ্গত কারণেই। খতিয়ে দেখছেন শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়...

https://p.dw.com/p/2R8da
জুলফিকার ছবির পোস্টার
ছবি: S. Bandopadhyay

সিনেমার ‘‌ট্রেলার'‌, আজকের ভাষায় ‘‌প্রোমো'‌ দেখে সবসময় বোঝা যায় না সিনেমাটা আদতে কতটা ‘ভালো' বা ‘খারাপ'৷ তবে ছবির মূল বিষয় সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়৷ কিন্তু সদ্য মুক্তি পাওয়া সৃজিত মুখার্জির নতুন ছবি ‘‌জুলফিকার'‌–এর প্রোমো রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল শহরের শিক্ষিত মুসলিম সমাজে৷ কারণ, তাঁরা মনে করেছিলেন, কলকাতার বন্দর এলাকাকে খারাপ আলোয় দেখানো হয়েছে সৃজিতের ছবিতে৷ সেখানকার মুসলিম বাসিন্দাদের খারাপ রঙে আঁকা হয়েছে৷ ঠিক কী অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার আগে একবার নজর দেওয়া যাক, কী দেখানো হয়েছিল জুলফিকারের সেই বিতর্কিত প্রোমোতে৷

জুলফিকার ছবির পোস্টার
ছবি: S. Bandopadhyay

কলকাতার বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজের ছবি, ঢাক বাজিয়ে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের ছবি দেখানোর পাশাপাশি ঘোষকের কণ্ঠ বলছে, ‘‘এই দেশের মধ্যে আছে আরেকটা দেশ, যেখানে গান গায় বন্দুকের গুলি, যেখানে টাকা ওড়ে৷ কলকাতার মধ্যেই আছে আরেকটা দেশ, যেখানে অপরাধ চলে অবাধে৷ এ দেশে কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকা নেই, নেই জাতীয় পতাকা৷'' এই ভাষ্যের সঙ্গে দেখানো হচ্ছে কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ অঞ্চল, যা শহরের বন্দর এলাকা৷ দেখানো হচ্ছে মহরমের মিছিল, মহরমের পতাকা, নামাজ পড়ার দৃশ্য, মাদ্রাসায় বাচ্চাদের পড়াশোনা করা, আরবি ভাষায় লেখা বই পড়ার ছবি আর তারই পাশাপাশি কসাইয়ের দোকানে চাপাতি দিয়ে মাংস কাটার ছবি৷

প্রথম আপত্তিটা তোলেন ওই বন্দর এলাকার বাসিন্দারাই৷ তাঁদের প্রশ্ন– মুসলিম মহল্লার এই ছবির কোলাজ আর তার সঙ্গে ওই বিতর্কিত ভাষ্যপাঠে কী প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন পরিচালক সৃজিত মুখার্জি?‌ যে বন্দর এলাকা, বা বলা ভালো মুসলিমপ্রধান এলাকা মানেই গুলি, বন্দুক, হিংসা, বেআইনি কাজকর্ম?‌ তীব্র প্রতিবাদ আসে খিদিরপুর মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে৷ সেই প্রতিবাদে বলা হয়, পরিচালকের কি জানা আছে এই বন্দর এলাকায় কতগুলো দুর্গাপুজো আর সরস্বতীপুজো হয়?‌ তিনি কি জানেন, এই অঞ্চলে কতগুলো নামী স্কুল আছে?‌ কতগুলো বেসরকারি সেবা সংস্থা, অর্থাৎ ‘‌এনজিও'‌ এই বন্দর অঞ্চলের গরিব মানুষদের জীবনের মান উন্নত করতে বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছে, তার খবর কি রাখেন পরিচালক?‌ যদি না রাখেন, তা হলেও সেটা মুসলিম মহল্লাকে ‘অপরাধের আখড়া' বলে দাগিয়ে দেওয়ার কোনো অজুহাত হয়ে যায় না৷

স্থানীয় বাসিন্দাদের ওই ক্ষোভ, আপত্তির পাশাপাশি আরো একটা বিষয় উঠে আসে, যা আরও গুরুতর৷ জনপ্রিয় ধারার বাংলা ছবির পরিচালক হিসেবে সৃজিত মুখার্জি আসলে একটা বিপজ্জনক কাজ করছেন৷ সমাজে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে চালু ধারণা, তথাকথিত ‘‌আমরা'‌ আর ‘‌ওরা'‌র যে বিভাজন, ‘‌আমরা'‌ মানে ভালো, আইন মেনে চলা ‘সুসভ্য' নাগরিক, আর ‘‌ওরা' মানেই খারাপ, আইন না মানার দল, সমাজবিরোধী— এই বিষবৃক্ষের গোড়াতেই সার, জল ঢেলেছেন৷ তাতে সস্তা জনপ্রিয়তা এবং মাল্টিপ্লেক্সে জুলফিকারের টিকিট বিক্রির হিসেব, দুইই হয়ত ঊর্ধগামী হবে, কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজ সম্পর্কে নিজের অজ্ঞানতার বোঝাও তিনি দর্শকদের চিন্তা-ভাবনার ওপর চাপিয়ে দেবেন৷ সৃজিতের সিনেমায় একটি চরিত্র বশির ‘‌আল্লাহ হাফেজ'‌ বলে নিজের বন্ধু জুলফিকারকে গুলি করে৷ পরিচালকের সিনেমা–নজরে তা যতই নাটকীয় মনে হোক না কেন, যার সুরক্ষার ভার আল্লার হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাঁকে গুলি করা যায় কী করে?‌ এই সিনেমার একটি গানের শুরুর কথা, ‘‌পুরনো এক মসজিদে, গান ধরেছে মুর্শিদে'‌!‌ কোন মসজিদে গান হয়, পরিচালক সৃজিত সেটা কীভাবে শুনে ফেললেন, সেই প্রশ্নও তোলেন কলকাতার শিক্ষিত, সচেতন মুসলিম সমাজ৷

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সঙ্গত কারণেই মুসলিমদের আপত্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়ার পরও ছবির কিছু দৃশ্য এবং সংলাপ বাদ দিতে কার্যত প্রযোজক, পরিচালককে বাধ্য করেছেন৷ উৎসবের বাজার ধরতে মরিয়া প্রযোজকও আপত্তি করেননি তাতে৷ আর পরিচালকও বিনাপ্রশ্নে কাজটা করে কার্যত প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাঙালি মুসলিম সমাজ সম্পর্কে তিনি যতটা নিরাসক্ত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন, ঠিক ততটাই নিজের চলচ্চিত্র চর্চা সম্পর্কেও৷ চিন্তাভাবনা না করে কিছু বলতে যেমন তাঁর সঙ্কোচ নেই, ধমক খেয়ে সেই কথা গিলে ফেলতেও তিনি সমান নির্লজ্জ৷

প্রতিবেদন: শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা

সম্পাদনা: আশীষ চক্রবর্ত্তী