জল ঢুকে তিন পড়ুয়ার মৃত্যু, দিল্লির ১৩টি কোচিং সেন্টার সিল
২৯ জুলাই ২০২৪তাদের আশা ছিল, আইএএস পরীক্ষায় সফল হয়ে দেশের প্রশাসনের অংশ হবেন। তাই আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু ২৫ বছর বয়সি তানিয়া সোনি ও শ্রেয়া যাদব এবং ২৮ বছর বয়সি নবীন দেলভিনের আইএএস প্রশিক্ষণ সেন্টারে জলে ডুবে মৃত্যু হলো।
দিল্লির ওল্ড রাজেন্দ্র নগরে ছিল এই কোচিং সেন্টার। নাম, রাউস আইএএস স্টাডি সার্কেল। তাদের লাইব্রেরি ছিল বেসমেন্টে। বৃষ্টির পর সেখানেই হু হু করে জল ঢুকতে শুরু করে। বাকি বেশ কিছু পড়ুয়া সেখানে আটকা পড়েছিল। সাতঘণ্টা ধরে চেষ্টার পর তাদের উদ্ধার করা হয়।
কিন্তু তানিয়া, শ্রেয়া, নবীনদের বাঁচানো যায়নি। বিহারের ঔরঙ্গাবাদের বাসিন্দা তানিয়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। দেড় মাস আগে ওই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। শ্রেয়াও মাত্র দুই মাস আগে এই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে বিএসসি পাস করে দিল্লিতে হস্টেলে থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। নবীন কেরালার ছেলে। জেএনইউ-তে গবেষণার পাশাপাশি আইএএস হওয়ার জন্য এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান
দিব্যাংশু এই কোচিং সেন্টারেই প্রশিক্ষণ নিতেন। রিপাবলিক টিভি-কে তিনি বলেছেন, দুর্ঘটনার দিনও তিনি বারোটা পর্যন্ত লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। তারপর বাড়িতে কিছু কাজ থাকায় তিনি বাড়ি চলে যান। দিব্যাংশু জানিয়েছেন, সাতটা নাগাদ তিনি বন্ধুদের ফোন পান, কোচিং সেন্টারে আসার জন্য। কারণ, বেসমেন্ট জলে ভরে গেছে।
দিব্যাংশু জানিয়েছেন, ''আমি গিয়ে দেখি, প্রবল জোরে জল সেখানে যাচ্ছে। বৃষ্টি হলে ওখানে জল জমে যায়। যে বন্ধুরা বেসমেন্ট থেকে উপরে উঠে আসেন তারা বলেছেন, তিরিশ সেকেন্ডে পাঁচ ফুট জল ভরে যায়। ওখানে জল নিচে যাওয়ার পরই লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়।''
দিব্যাংশু বলেছেন, ''১২ দিন আগে আমার এক বন্ধু পুরসভায় অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কিছুই করা হয় না। ঘটনা যখন ঘটে তখন বেসমেন্টে ৩০ থেকে ৩৫জন ছিলেন। স্কুবা ডাইভার্স আসে। তাদের আসার ক্ষেত্রেও সময় লাগে।''
দিব্য়াংশু বলেছেন ''এক লাখ ৭৫ হাজার পাঁচশ টাকা ফি নেয় এই সেন্টার।''
হরেন্দ্র চৌহান দুর্ঘটনার সময় বেসমেন্টে ছিলেন। তিনি রিপাবলিক টিভি-তে বলেছেন, ''বৃষ্টি শুরু হওয়ার ছয়টা ৪০ মিনিট নাগাদ গার্ড বলতে থাকেন, দ্রুত বাইরে যাও। প্রচুর জল আসছে। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চারা বেরোতে শুরু করে। উপরে উঠে যায়। প্রবল জোরে জল ভিতরে ঢুকতে থাকে। অনেকে যারা কোণায় বসেছিল, তারা উঠতে পারেননি। পাঁচ মিনিটে পুরো বেসমেন্ট জলে ভরে যায়।''
কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
পুলিশ ইতিমধ্যে ওই কোচিং সেন্টারের মালিক-সহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুরসভা ওল্ড রাজেন্দ্র নগরে আরো ১৩টি কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে। পুরসভার তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই কোচিং সেন্টারগুলি বেআইনিভাবে বেসমেন্টে চলছিল।
এমসিডির মেয়র সাইলি ওবেরয় জানিয়েছেন, ''এই কোচিং সেন্টারগুলি আইন না মেনে বেসমেন্টে তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালাচ্ছিল। তাই ওই কোচিং সেন্টারগুলি সিল করে দেয়া হয়েছে। সেন্টারের সামনে নোটিশ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।''
নো অবজেকশন সার্টিফিকেট
পুলিশের তদন্তে কোচিং সেন্টার ও পুরসভার বেশ কিছু গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রাউস আইএএস কোচিং সেন্টার ২০২১ সালের অগাস্টে এমসিডি-র কাছ থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট পায়। এনডিটিভি-র রিপোর্ট অনুসারে বেসমেন্টে পার্কিং ও কিছু জিনিস রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
চলতি মাসে রাউস কোচিং সেন্টার দিল্লির দমকল বিভাগ থেকে এনওসি পেয়েছিল। সেখানেও বলা হয়েছিল, বাড়ির বেসমেন্ট আইন অনুসারে ব্যবহার করা উচিত।
বিল্ডিং আইনে বলা হয়েছে, বেসমেন্টে পর্যাপ্ত নিকাশী ব্যবস্থা রাখতে হবে। একাধিক বেরোবার রাস্তা রাখতে হবে। রাজেন্দ্র নগরে ঢোকা ও বেরনোর একটি রাস্তাই ছিল।
এর পাশাপাশি আরো একটি প্রশ্ন উটছে। সেটা হলো, এতটা জল কী করে বেসমেন্টে ঢুকলো? স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ, এই এলাকায় নিকাশী ব্যবস্থার হাল খুবই খারাপ। তাদের অভিযোগ, নিকাশী ব্যবস্থা কাদা-মাটি ও আবর্জনায় ভরে গেছে। তাই বৃষ্টি হলেই জল জমে যাচ্ছে।
তবে এই কোচিং সেন্টারের পড়ুয়া কিশোর লাল কুশ্বাহা পুরসভাকে এক মাস আগে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, কোচিং সেন্টার বেআইনিভাবে বেসমেন্টে লাইব্রেরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তারপরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন?
বেআইনি নির্মাণ ও ব্যবহার
দিল্লিতে বেআইনি নির্মাণ বা বাড়ির অংশ বেআইনিভাবে ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এনিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকে না বলেও অভিযোগ। আপ নেতা অনুপ ঠাকুর ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এমসিডি কাজ করেনি বলেই এই অবস্থা হয়েছে। তারা যদি নিকাশী ব্যবস্থা থেকে কাদা-মাটি-আবর্জনা সরাতো, তাহলে্ এই অবস্থা হয় না। দিল্লি তে পরিকল্পনামাফিক শহর। এখানে তো এই অবস্থা কোনোভাবে মানা যায় না।''
সম্প্রতি দিল্লির মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজের একটি ভিডিও সামনে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সৌরভ বলছেন, খাতায় কমলে ডিসিল্টিংয়ের কাজ হয়েছে। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়নি। ডিডাব্লিউ এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করে দেখতে পারেনি।
জিএইচ/এসজি (পিটিআই, এএনআই, এনডিটিভি)