গ্রেপ্তারকৃতদের ন্যায়বিচার কি নিশ্চিত হচ্ছে?
১৩ অক্টোবর ২০২৪আইনি সহায়তা সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়ার সময় অপদস্থ করে কিভাবে? জনরোষ? দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের৷ আমার সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে, দ্বিমত থাকতে পারে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের৷ কিন্তু পুলিশ হেফাজতে তার উপর নির্যাতন করা হবে, সেটা আমি মানতে রাজি না৷ যেভাবে ভিডিও করা হচ্ছে সেটা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত?''
জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘এমন আরো অনেক ঘটনা আছে৷ এদের যখন আদালতে নেয়া হচ্ছে তখন সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালাতে দেখছি৷ কিন্তু হামলার কারণে তো কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখছি না৷ কাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, যারা আগের সরকারে ছিল৷ মানি লন্ডারিংয়ে আমরা কি কাউকে গ্রেপ্তার হতে দেখছি? আমরা তো জানতাম কিছু কিছু লোক বন্দি আছে, তারা দেশের বাইরে গেল কিভাবে? এই প্রশ্নগুলো আমিই রাখলাম৷ এগুলোতে যদি মনে হয়, ন্যায় বিচার আছে, তাহলে আছে!''
বিগত সরকারের মন্ত্রী-এমপি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ অধিকাংশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আদালতে নেওয়ার সময় তারা নানা ধরনের হেনস্থার শিকার হয়েছেন৷ এমনকি অনেকের পক্ষেই আদালতে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি৷ আবার কারও পক্ষে আইনজীবী দাঁড়ালেও সেই আইনজীবী তার পছন্দের নয়৷ আদালতেই আয়োজন করে একজন দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আওয়ামী লীগ ঘরানার অধিকাংশ আইনজীবী এখনো কোর্টে যান না৷ যারা যাচ্ছেন তাদের অনেকই শঙ্কার মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছেন৷
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তারা একদম আইনি সুবিধা পাচ্ছেন না৷ মামলাগুলোই তো কনফিউজিং৷ যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের জন্য যেমন এটা হ্যারাজম্যান্ট, তেমনি যারা ভিকটিম তাদের জন্যও অবিচার৷ বাদিরা এখন এসে বলছেন, আমি আসামি চিনি না৷ আমরা জানি কোন ঘটনায় হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে৷ এখানে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, পিক অ্যান্ড চুজ করা হচ্ছে৷ এটা হওয়া উচিত না৷ প্রশাসন কিন্তু প্রথমে বলেছিল, তদন্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে৷''
আদালত নির্দেশ দেয়ার পরও ডিভিশন দেয়া হচ্ছে না জানিয়ে সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘‘শাহরিয়ার কবির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে ডিভিশন দিতে দুইবার বলেছেন আদালত৷ কিন্তু তাকে দেয়া হচ্ছে না৷ অসুস্থ যারা আছেন তাদের গরম পানি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না৷''
ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ লিখেছেন, ‘‘আদালত প্রাঙ্গণে এবং আদালতে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে আমি উদ্বেগজনক বলে মনে করি৷ যেকোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার প্রাপ্তি যেমন অধিকার, তেমনি তার নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব৷ আটক ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার সময় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার যাতে করে এই ধারণা তৈরি না হয় যে, তিনি ন্যায়বিচার বঞ্চিত হতে পারেন৷''
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা সত্যি যে, প্রত্যেকটা আসামির আইনি কাঠামোতে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে৷ একই সঙ্গে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, চেতনা বোধ৷ জুলাই হত্যাকাণ্ডের আদর্শিক মূলমন্ত্র কী ছিল? ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধ৷ রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি৷''
এই আইনজীবী আরো বলেন, ‘‘আপনাকে মনে রাখতে হবে, আদালতে যেটা হচ্ছে, সেটা ‘সিভিলাইজ প্রোটেস্ট'৷ এটা তো থাকতে পারে৷ আমি তো লন্ডনে থাকা অবস্থায় দেখেছি, টনি ব্লেয়ারকে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে৷ ফলে এটা সারা বিশ্বেই আছে৷ কাদের বিরুদ্ধে এটা হচ্ছে, যারা গণধিকৃত৷ যদিও যেটা হচ্ছে সেটা কাম্য না৷''
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে পুলিশ গত সোমবার গ্রেপ্তার করে৷ তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় দুটি হত্যা মামলা, খিলগাঁও থানায় দুটি হত্যা মামলা ও একই থানায় আরো দুটি হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা হয় পৃথক মামলা৷ সোমবার তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত একটি হত্যা মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন৷ ঠিক পরদিনই রিমান্ডে থাকাকালে অসুস্থ বোধ করায় তদন্ত কর্মকর্তা তাকে আদালতে হাজির করেন৷ এ সময় তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা৷ পৃথক ছয়টি মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জিয়াদুর রহমান তার জামিন দেন৷ ওই দিনই সন্ধ্যায় আদালত থেকে মুক্তি পান তিনি৷
সিনিয়র আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘জামিনের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে সেটা তো আমরা মিডিয়ার কারণেই জানতে পেরেছি৷ একজনকে পেন্ডিং মামলায় শোন অ্যারেস্ট করা হচ্ছে৷ অন্যদিকে, একজনকে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় জামিন দিয়ে দিচ্ছে৷ রিমান্ড শেষ না হলে জামিনের সুযোগ নেই৷ এখন যেটা হচ্ছে সেটা কোনো আইন নয়, এটাকে কাজীর বিচারও বলা যাবে না৷''
১৮৭৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি এখনও এই অঞ্চলের চারটি দেশে কার্যকর আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কোনো দেশে একটা নজিরও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, পাঁচ দিনের রিমান্ড হয়েছে, একদিন পরই জামিন হয়ে তিনি মুক্তি পেয়ে গেছেন৷ এই ঘটনাগুলো দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না৷ বিষয়টি নিয়ে যে আমরা উচ্চ আদালতে যাব, আমাদের নিরাপত্তা কী? আমরা তো নিরাপদ বোধ করছি না৷ আর উচ্চ আদালত কি বিষয়গুলো দেখছেন না? তারাও তো দেখছেন৷ আমরা জানি না কে টার্গেট? এই টার্গেট অবস্থায় তো বিচার চলতে পারে না৷''
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামিনের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটা আইনে যে করা যাবে না তা নয়, এটা আইনের ব্যত্যয় নয়৷ কিন্তু এমন প্রচলন আমাদের নেই৷ তবে যার জামিনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাকে কিন্তু পুলিশ আদালতে সোপর্দ করেছে৷ এরপর আদালত তার জামিন দিতেও পারেন, বা কারাগারে পাঠাতে পারেন৷ কাউকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিলে যে পাঁচ দিনই রাখতে হবে, বিষয়টি এমন নয়৷ পুলিশ চাইলে এর মধ্যে যে কোনো সময় তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানোর আবেদন করতে পারেন৷ তখন আদালতের এখতিয়ার তাকে জামিন দেবেন কিনা?''
আইনে বৈষম্যের সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আইনে আছে কোনো বৈষম্য করা যাবে না৷ ফলে এই মামলায় একই ধরনের অপরাধের দায় যদি কারও বিরুদ্ধে থাকে তাতে একজন জামিন পেলে অন্যজন জামিন চাইতে পারেন৷ তাকে জামিন না দিলে বৈষম্য হবে৷ এই সরকারও তো বৈষম্যবিরোধী৷ তবে এখানে অপরাধের গুরুত্ব যদি আলাদা হয়, তাহলে বিষয়টি আদালত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷''
সাবের হোসেন চৌধুরীর জামিন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী৷ তিনি বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের এই নেতার নির্দেশে ১১টি গুম-খুন হয়েছে৷ তাহলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কীভাবে তার মতো লোক জামিনে মুক্তি পেলেন?''
অন্যদিকে, অনেকের রিমান্ডের মেয়াদ বেড়েই চলেছে৷ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা ১৭ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের একসঙ্গে ৪৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত৷ গত মঙ্গলবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন৷ এর আগে বিভিন্ন মামলায় ১৮ দিনের পুলিশ রিমান্ডে ছিলেন তিনি৷ একই দিনে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকেরও ২৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত৷
রিমান্ড বা জামিনের ক্ষেত্রে আদালত পিক অ্যান্ড চুজ করছেন কিনা জানতে চাওয়া হয় বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের কাছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আসামির জামিনের বিষয়ে আমরা তো আদালতকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারি না৷ তবে যা হয়েছে, তাতে জনমনে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে৷ হত্যা মামলার আসামিকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে থাকা অবস্থায় জামিন দেওয়ায় মানুষের মনে নানা ধরনের শঙ্কা কাজ করছে৷''