প্রথমেই বলে নেয়া ভালো, এই লেখা যখন লিখছি, তখনো তথাকথিত ক্যালিফোর্নিয়া ভাইরাস নিয়ে বৈজ্ঞানিকরা খুবই কম জানেন। এই ভাইরাস সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এই স্ট্রইন অন্যগুলির তুলনায় খুবই দ্রুত ছড়ায় এবং আরো ভয়ঙ্কর। তাই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে আরো ভালো করে চিকিৎসা ও যত্নের দরকার।
এই ভাইরাস সম্পর্কে যা কিছু জানা গেছে, তা প্রি-প্রিন্টের একটি রিপোর্ট থেকে। লেখাটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রি-প্রিন্ট হলো সেই রিপোর্ট বা সমীক্ষা যেখানে প্রাথমিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয়। তবে সেই রিপোর্ট বৈজ্ঞানিকরা খতিয়ে দেখেননি বা বলা যায় রিপোর্টের রিভিউ হয়নি। সাধারণত, এই ধরনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে আসেন না।
তাই এই রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, সেই তথ্যগুলি এখনো সমর্থিত নয়।
যা জানা গেছে
আমরা জানি যে, ক্যালিফোর্নিয়া করোনাভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় অ্যামেরিকার দক্ষিণের এই রাজ্যে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটা করোনা ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইন।
কিন্তু এই নতুন প্রকারের ভাইরাসেরও দুইটি প্রকারভেদ আছে। একটি অন্যটার থেকে কিছুটা আলাদা। এই দুই ধরনের নাম হলো বি.১.৪২৭ এবং বি..১.৪২৯। তবে প্রি-প্রিন্ট সমীক্ষায় লেখকরা এগুলিকে ক্যাল.২০সি বলে অভিহিত করেছেন। এই গবেষকরা সকলেই লস এঞ্জেলসের সেডারস-সিনাই মেডিক্যাল সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত।
যে সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি বিশ্লেষণ করে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, ক্যাল.২০সি করোনার একটা নতুন স্ট্রেইন।
সরকার বাড়িতে থাকার নির্দেশ জারি করার পর ক্যালিফোর্নিয়ায় শুনশান রাস্তা।
করোনার নতুন স্ট্রেইন এর আগে ব্রিটেনে পাওয়া গেছে, যার নাম বি.১.১.৭। এই স্ট্রেইন অত্যন্ত ছোঁয়াচে। গবেষকরা লিখছেন, লস এঞ্জেলস ও ক্যালিফোর্নিয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো স্ট্রেইনের জন্য করোনার প্রকোপ অত্যন্ত বেশি তা বলা যাবে না। শুধু এই টুকু বলা যেতে পারে, এই অঞ্চলে করোনার প্রকোপ এবং ক্যাল.২০সি স্ট্রেইন দুইটিই বেড়েছে।
ক্যাল.২০সি কেন আলাদা?
২০২০ সালের জুলাইতে এই স্ট্রেইন লস এঞ্জেলসে এবং অক্টোবরে ক্যালিফোর্নিয়ায় দেখা যায়। তারপর থেকে এই স্ট্রেইনের প্রকোপ বেড়েছে। গবেষকদের দাবি, করোনায় রোগীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ এই স্ট্রেইনে আক্রান্ত।
ফলে বিষয়টি একটু জটিল হয়ে যাচ্ছে, যা আমরা সহজ করে ব্যাখ্যা করব।
কোভিড ১৯ ক্লাস্টারের দুইটি সাব গ্রুপ হলো ২০জি ও ২০সি। উত্তর অ্যামেরিকায় ২০জি ক্লাস্টারের ভাইরাসের প্রকোপ বেশি।
এল৪৫২আর হলো ভাইরাস স্পাইক প্রোটিনের মিউটেশন। স্পাইক প্রোটিন হলো সেই জিনিস যা মানুষের শরীরের কোষে সংক্রমণ ঘটায়।
নতুন মিউটেশন এই স্পাইক প্রোটিনকে আরও সহজভাবে মানুষের শরীরের কোষে ভাইরাল রিসেপটরে ঢুকে যেতে সাহায্য করে। রিসেপটরকে সাধারণত গেটওয়ে বা প্রবেশদ্বার বলা হয়, যেখান দিয়ে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়।
এই এল৪৫২আর স্পাইক প্রোটিনকে বেশ কিছু অ্যান্টিবডি থামাতে পারে না। তবে গবেষকরা লিখেছেন, ক্যাল.২০সি কতটা সংক্রামক ও তাকে অ্যান্টিবডি কাবু করতে পারে কি না, তা এখনো অজানা।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা
প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা ভাইরাসের টিকা নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ সরকারি কর্মচারি, চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তি এবং সম্মুখসারির যোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিবন্ধনের সুযোগ দিচ্ছে।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
ভয় কেটে যাচ্ছে
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের করোনা টিকাদান কেন্দ্রের ইনচার্জ হামিদা বেগম বলেন, “শুরুতে মানুষের মাঝে অনেক শঙ্কা এবং ভয় ছিল। কিন্তু গত ১০ তারিখ থেকে প্রচুর মানুষ কেন্দ্রে আসছে। গড়ে আমরা দৈনিক ১৫০০-র চেয়েও বেশি মানুষকে টিকা দিচ্ছি৷’’
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
নেই সামাজিক দূরত্বের বালাই
একাধিক টিকাদান কেন্দ্রে ঘুরে কোথাও টিকা দিতে আসা মানুষদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে দেখা যায়নি। একটি কেন্দ্রের কর্তব্যরত একজন নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন “সীমিত পরিসরে শুরু করায় এখন সব ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তাছাড়া সাধারণ মানুষের এ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও রয়েছে৷”
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
চলছে কাউন্সেলিং
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভ্যাকসিন গ্রহণের পর পর্যবেক্ষন কক্ষে বিশ্রাম করছেন মিরপুর থেকে আসা এম শামসুল হক। টিকার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কর্তব্যরত সেবিকা। টিকা নেওয়ার পর কেমন লাগছে- জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন. ‘‘আলাদা কোনো শারীরিক অনুভূতি নেই৷’’
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
ক্ষোভ
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে করোনা টিকা নিতে সস্ত্রীক এসেছিলেন মীর কবির হোসেন। পাঁচ তলায় লিফট ছাড়া উঠে তিনি ক্ষুব্ধ৷ জানালেন, তারা দু’জনই হৃদরোগ এবং শ্বাসকষ্টের রোগী। বয়স্ক রোগীদের কথা ভেবে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা৷
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
বন্ধ অন স্পট নিবন্ধন
করোনা ভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রমে গত ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি নিবন্ধন হওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এক ঘোষণার মাধ্যমে অন স্পট নিবন্ধন স্থগিত করা হয় এবং শুধু অনলাইনে নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়। কবে আবার এ সুযোগ চালু করা হবে, সে সুম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
নেই আলাদা পর্যবেক্ষণ কক্ষ
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল একটি ছোট কনফারেন্স কক্ষে টিকা দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। নেই পৃথক কোনো টিকা পরবর্তী পর্যবেক্ষণ কক্ষ। এ কারণে অনেককে ভোগান্তিতে পড়তে দেখা যায়।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
এসেছেন সপরিবারে
পরিবারের পাঁচজন সদস্যসহ টিকা কেন্দ্রে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা খান মো. ইসহাক। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর পর্যবেক্ষণ কক্ষে বিশ্রাম নিতে নিতে জানালেন, টিকা নিতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট এবং সকলের প্রতি তার আবেদন, সবাই যেন কোনো শঙ্কা ছাড়াই টিকা নেন।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
দ্বিতীয় ডোজ আট সপ্তাহ পর
প্রথম ডোজ নেওয়ার পরই আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার তারিখও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। এর মাঝে কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যায় নির্ধারিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধও জানিয়ে রাখছেন টিকা দেয়ার কাজে সংশ্লিষ্টরা৷
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
অনলাইন নিবন্ধনে জটিলতা
করোনার টিকে নিতে নিবন্ধন করতে হচ্ছে ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইটে। কিন্তু অনেকেই জানেন না OTP (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) কী। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মকর্ত একজনও নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, নিবন্ধনে তিনি নিজেও ভোগান্তিতে পড়েছেন এবং আরেকজনের মাধ্যমে করিয়ে নিয়েছেন। প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা সাধারণ মানুষকেও এ সমস্যায় পড়তে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
ভিআইপি বুথ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-তে গিয়ে ভিআইপি বুথ খোলা হয়েছে। কারা এর আওতায় পড়বেন জানতে চাইলে কর্তব্যরত ব্যক্তি জানান, মন্ত্রীপরিষদ, বিচারবিভাগ, সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কর্তব্যরতরা এই বিশেষ বুথে টিকা নিতে পারবেন।
-
যেভাবে চলছে করোনার টিকা দেয়ার কার্যক্রম
স্বেচ্ছাসেবক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক করোনা টিকা কেন্দ্রে গিয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকদের কর্মসূচিতে সহযোগিতা করতে দেখা গেছে। টিম লিডার নাফিজ কালাম নিবিড় জানান, তাদের ২০ জনের একটি দল বিএসএমএমইউতে আসা টিকাগ্রহীতাদের রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত পুরোটা সময় সেবা দিচ্ছেন।
ভাইরাস বদলায়
সার্স-কোভিড ভাইরাস নানা ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০২০-র জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে এই ভাইরাসের নতুন প্রকার দেখা যায়, তার নাম ডিজি১৪জি। মূল স্ট্রেইনের থেকে এটি আলাদা। উহানে ২০১৯ সালে করোনার সংক্রমণের পিছনে ছিল মূল স্ট্রেইনটি। এরপর নতুন স্ট্রেইন বিশ্বজুড়ে ছড়াতে থাকে।
২০২০-র অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরে ডেনমার্ক একটি স্ট্রেইন চিহ্নিত করে, যা মিংকগুলির সংক্রমণ ঘটাচ্ছিল। এই স্ট্রেইনের নাম দেয়া হয় ক্লাস্টার ৫। ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্য(বি.১.১.৭) ও দক্ষিণ আফ্রিকায়(বি.১.৩৫২) নতুন স্ট্রেইন দেখা দেয়। তা দ্রুত ছড়াতে থাকে। জাপান ও ব্রাজিলেও নতুন স্ট্রেইন দেখা যায়।
যাঁরা বিশেষজ্ঞ নন, তাঁদের বুঝতে একটু অসুবিধা হতে পারে, কারণ, নাম দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক রীতি নেই। নেচার পত্রিকায় সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তবে ডাব্লিউএইচও জানিয়েছে, সব ভাইরাসই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়।
এই অবস্থায় একটা কথা মনে রাখা ভালো, আপনার এলাকায় যে স্ট্রেইন থাকুক না কেন, শুধু এটা মনে রাখবেন, নিজেকে ও অন্যদের সুরক্ষিত রাখার জন্য যা করা দরকার, তা করতেই হবে। সেখানে ঢিলেমি থাকা উচিত নয়।
জুলফিকর আব্বানি/জিএইচ