কলকাতায় বন্ধ হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রাম, পর্যটকদের জন্য চলবে একটা রুটে
এখন মাত্র দুইটি রুটে ট্রাম চলতো। সেটাও বন্ধ করে শুধু পর্যটকদের জন্য এসপ্ল্য়ানেড থেকে ময়দান ট্রাম চলবে।
সেই ১৮৭৩ থেকে
শেষ হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ট্রামের সফর। ট্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৭৩ থেকে। পরিবেশবান্ধব এই যান ছিল কলকাতার সবচেয়ে নির্ভরয়োগ্য ও জনপ্রিয় বাহন। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে ধীরে ধীরে ট্রামের যাত্রাপথের সংখ্যা কমতে থাকে। বাম সরকারের আমলে সেই সংকোচন শুরু হয়। বর্তমান সরকারের আমলে তার যাত্রা শেষ হচ্ছে।
চলবে শুধু পর্যটকদের জন্য
যাত্রীবাহী ট্রাম আর চলবে না। এখন থেকে শুধু পর্যটকদের জন্য ট্রাম চলবে। সেটাও এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত। বাকি রুটের ট্রামলাইন হয় উঠিয়ে দেয়া হবে বা তার উপর দিয়ে পিচ করে দেয়া হবে।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
পরিবহনমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী সম্প্রতি জানিয়েছেন, যানজটমুক্ত বাহনকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। সেজন্যই আর ঐতিহ্যের ট্রাম আর চলবে না। ধর্মতলা থেকে একটি ট্রাম চলবে। পুরো বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারাধীন আছে। মন্ত্রীর যুক্তি, যানজটের কারণেই আবেগ নয়, মানুষের সুবিধার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কলকাতায় রাস্তা বাড়েনি। কিন্তু যানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই অবস্থায় ট্রাম চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
দেশের একমাত্র শহর
কলকাতাই ছিল দেশের একমাত্র শহর, যেখানে ট্রাম চলত। সেটাও এবার যাত্রীদের জন্য বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সরকার।
ক্রমশ কমেছে
একটা সময় প্রায় সারা কলকাতা-জুড়ে ট্রাম চলত। ট্রামে ফ্যানের ব্যবস্থা থাকায় অনেকের পছন্দের যান ছিল ট্রাম। কিন্তু মানুষের ব্যস্ততা বাড়ার পর, শহরের আয়তন বাড়ার পর যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রামকে আধুনিক করা হয়নি। বরং সরকার সহজ পথে হেঁটেছে। ট্রাম ধীরগতির বাহন, যানজট হচ্ছে যুক্তি দিয়ে একের পর এক রুটে ট্রাম বন্ধ করা হয়েছে। এখন মাত্র দুইটি রুটে ট্রাম চলত। ট্রাম কোম্পানি পরে বাস চালাতে শুরু করে।
মামলা চলছে
কলকাতা হাইকোর্টে ট্রাম নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা চলছে। কলকাতা হাইকোর্ট ট্রাম নিয়ে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনার কথা জানতে চেয়েছিল। তারপর এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে পরিবহন দপ্তর।
ট্রাম বাঁচাও মঞ্চের প্রতিবাদ
কলকাতার ট্রাম বাঁচাও মঞ্চ রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা বলেছে, কলকাতার এই ঐতিহ্যকে এভাবে হারিয়ে যেতে দেবেন না তারা। তারা সম্প্রতি মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তাদের দাবি
ট্রাম বাঁচাও মঞ্চের দাবি, ট্রাম হলো একমাত্র পরিবেশবান্ধব যান। কলকাতার ঐতিহ্যের অংশ। তাই ট্রাম চালাতে হবে। পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই চালাতে হবে।
পরিবহন মন্ত্রকের দাবি
পরিবহন মন্ত্রকের বক্তব্য, কলকাতায় পরিবেশবান্ধব যানবাহনের সংখ্যা প্রচুর। এখন নতুন প্রযুক্তির পরিবেশবান্ধব যান বাজারে এসেছে। ইলেকট্রিক গাড়ি প্রচুর মানুষ ব্যবহার করছেন। সিএনজি চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে। তাই শুধু টার্মকে পরিবেশবান্ধব বলার দিন আর নেই। কলকাতায় রাস্তার পরিমাণ খুবই কম। সেখানে ট্রাম চালালে যানজট পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে বাধ্য।
ট্রাম নিয়ে
ট্রাম নিয়ে কলকাতার মানুষের প্রচুর নস্টালজিয়া আছে। আছে নানা কাহিনি। এই ট্রামের তলায় চাপা পড়েই মারা গিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাস। অতীতে এই ট্রাম থেকেই প্রেমের শুরু হয়েছে অনেকের। ইউরোপের অনেক শহরে ট্রাম চলে। তবে সেখানে মান্ধাতার আমলের ট্রাম নয়, তাকে আধুনিক করা হয়েছে। সেখানে কলকাতায় ট্রামকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে দেয়ার পথ নেয়া হচ্ছে।
ট্রাম কন্ডাক্টরের কথা
ট্রামের কন্ডাক্টর শুভাশিস রায় বলেছেন, ' পার্ক সার্কাস ডিপোতে ১৯৮৪ সালে কন্ডাক্টারের চাকরি পাই। আজ যদি কোন ট্রামের কন্ডাক্টর বা চালকের দায়িত্ব চলে যায় সেটা আমার জন্য খুব বেদনাদায়ক। সরকার শিল্প আনার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা বলছে। অথচ ঘরের কাছেই শিল্পের সুযোগ আছে। নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোতে তো সেই ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা কাজে লাগানো হোক। সেদিকে নজর দেওয়া হলে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
ট্রামচালক যা বললেন
ট্রামচালক রাজু যাদব জানিয়েছেন, '১৯৯৫ সাল থেকে শুনছি ট্রাম বন্ধ হবে। ট্রাম এখন খুবই কম চলছে। তাও ট্রাম বন্ধ হবে বলে মনে হয়না। ট্রাম বয়স্ক মানুষের জন্য সুবিধাজনক। ট্রাম বন্ধ হওয়া উচিত নয়।'
পর্যটকের বক্তব্য
পর্যটক অভিজিৎ লাকুলে বলেন, ' মুম্বই থেকে এসেছিলাম। ট্রাম কলকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ যান। কিন্তু ট্রামও বিলুপ্ত হতে চলেছে। ট্যাক্সি চালকদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তারাও জানিয়েছেন কলকাতার রুট অনেকক্ষেত্রে একমুখি হওয়ায় বাস ও ট্যাক্সির জন্য ট্রাম যেতে পারেনা। আসলে আমরা ঐতিহ্যবাহী যানকে গুরুত্ব দিতে ভুলে গিয়েছি।'
যাত্রীর দুঃখ
ট্রামের নিয়মিত যাত্রী কানন রায় জানিয়েছেন, 'আমাদের মতো বয়স্ক মানুষের জন্য বাসে যাতায়াত খুব কষ্টকর। ঠিক সময়ে পাওয়াও যায়না। তাই ট্রাম অনেক সুবিধাজনক। ট্রাম উঠে যাওয়া খুব দুঃখের।'
৬৫ বছর ধরে
এলপি তিওয়ারি বলেছেন, ' আমি ৬৫ বছর ধরে ট্রাম চড়ছি। ট্রাম বন্ধ হওয়া উচিত নয়। মহিলা, শিশু ও বয়স্ক মানুষদের জন্য ট্রাম অনেক সুবিধাজনক।'