বৃহস্পতিবার দুপুরে আচমকাই শহিদ মিনারের নীচে বসা আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণ চালালো পুলিশ। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের মেরে ধরে চ্যাংদোলা করে পুলিশের বাসে তোলা হয়। আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, ৭০ দিন ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালানোর পর কেন এভাবে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হলো? একইসঙ্গে তাদের বক্তব্য, ন্যায্য সরকারি চাকরির দাবিতে তারা আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। চাকরির প্রতিশ্রুতি পেলেই তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন তুলে নিতেন।
চাকরির দাবিতে ৭০ দিন আগে শহিদ মিনারের নীচে আন্দোলনে বসেছিলেন এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা। সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন এসএলএসটি চাকরিপ্রার্থীরাও। অর্থাৎ, শারীরশিক্ষা এবং কর্মশিক্ষার শিক্ষক পদপ্রার্থীরা। আন্দোলন চলাকালীনই এসএসসি নিয়োগ নিয়ে একাধিক দুর্নীতি সামনে আসে। আদালত বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে। সিবিআই তদন্তও চলছে।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
তিন দফায় আন্দোলন
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীতে ২০১৯ সালের প্রথম দফার আন্দোলন ২৯দিনের মাথায় তুলে নেন আন্দোলনকারীরা। আশ্বাস ফলপ্রসূ না হওয়ায় দ্বিতীয়বার আন্দোলনে বসেন চাকরিপ্রার্থীরা। আন্দোলন চলে ১৮৭ দিন। বর্ষণমুখর রাতের অন্ধকারে দ্বিতীয় দফার সেই আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। অবস্থান মঞ্চ থেকে আন্দোলনকারীদের সমস্ত জিনিসপত্র সমেত তুলে দেয়া হয়। এখন চলছে তৃতীয় দফার আন্দোলন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
সব বাধা উপেক্ষা করে
তৃতীয় দফায় বিগত সাতমাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই আন্দোলন। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে এই শামিয়ানার নীচে আন্দোলনরত কয়েকশত চাকরিপ্রার্থী নারী পুরুষ। প্রথমদিকে শামিয়ানা টাঙানোর অনুমতিও ছিল না। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নীচে তীব্র রোদেই অবস্থান করে আসছিলেন একঝাঁক তরুণ তরুণী। পরবর্তীকালে লালবাজার থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শামিয়ানা টাঙানো হয়।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা, বাসটার্মিনাসের শৌচাগার পয়সা দিয়ে ব্যবহার করতে হয়। নারী-পুরুষের জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
মাথা গোঁজার ঠাঁই
রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই অবস্থানে প্রতিদিন সামিল হন চাকরিপ্রার্থীরা। কেউ কেউ প্রতিদিন যাতায়াত করেন আবার অনেকে এই আন্দোলনের স্বার্থে বাড়িঘর ছেড়ে দিনের পর দিন এখানেই পড়ে আছেন। কোনোদিন আত্নীয়-স্বজন, কোনোদিন বন্ধুর বাড়িতে রাতটুকু থাকেন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও
একসঙ্গে দুইটি লড়াই লড়ছেন বীরভূমের সোমা দাস। এসএসসি দুর্নীতির পাশাপাশি ব্লাড ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও তার লড়াই। দ্বিতীয় দফার কেমোথেরাপি সম্পূর্ণ হলেও তৃতীয় দফার কেমো নিতে হতে পারে। এই আন্দোলন চলাকালীন তার চিকিৎসাও চলেছে। সোমবার তাকে সহকারী শিক্ষিকার চাকরি দেয়ার নির্দেশ দেয় শিক্ষা দফতর, কিন্তু তিনি তার প্রাপ্য সরকারি চাকরিটি নেবেন ঠিকই, সঙ্গে আন্দোলনও চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
সন্তান হারানো মইদুল
যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের প্রেসিডেণ্ট মইদুল ইসলাম। আন্দোলন চলাকালীন সন্তান হারিয়েছেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তিনি পুত্রসন্তান লাভ করেন। আন্দোলনের ব্যস্ততায় সদ্যোজাতের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করাতে পারেননি। আট দিনের মাথায় মারা যায় শিশুপুত্রটি। মইদুল এখনো বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
হারাতে হলো টিউশন
পিয়ালী সরকারের সামান্য যে কয়টা প্রাইভেট টিউশন ছিল, এই আন্দোলনের ফলে সে সব যেতে বসেছে। বিক্ষোভ দেখানোর জন্য কামাই হয়ে যায় টিউশন। ছাত্রছাত্রীর বাবা-মা রুষ্ট হন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
জুলেখার লড়াই
জুলেখা মণ্ডলের বাড়ি নদিয়ার তেহট্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করা সম্ভব হয় না। পরিচিত কারো বাড়িতে রাতটুকু কাটিয়ে আবার ধরণামঞ্চে ফেরেন। বাবা দর্জির কাজ করতেন, পায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে কাজও বন্ধ হয়েছে। জুলেখার একার কাঁধে সংসারের দায়িত্ব। রোটেশন পদ্ধতিতে যখন বাড়ি যান, তখন পড়ান। ছাত্র সংখ্যা কমে গেছে আগের থেকে।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত
অর্পিতা হাজরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় বাড়ি। ধরণামঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য প্রতিদিন সাতঘণ্টা ধরে যাতায়াত করতে হয়। ভোর পাঁচটায় উঠে রান্না করে তারপর আসেন, আবার বাড়ি ফিরে ১০ বছরের মেয়েকে নিয়ে পড়তে বসেন। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়েছেন। সারাদিনের কাজকর্ম সেরে সারারাত পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন। এখন প্রতিবেশীদের কটাক্ষ শুনতে হয়, সত্যি যদি পাশ করতো নিশ্চয়ই চাকরি পেত”
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
পড়ানো সেরে বিক্ষোভে
হাবড়ার জয়া খাঁ। বাবা মা আর মেয়ে এই তিনজনের পরিবার। বাবা মা দুইজনেই অসুস্থ। সকালে ছাত্র পড়িয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন। পাঁচটা পর্যন্ত থাকেন, আবার বাড়ি ফিরে টিউশনি করাতে চলে যান। একটু ভালো খবরের অপেক্ষায় বসে থাকেন বাবা মা।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
স্বামী-সন্তান নিয়ে
নাজমুন নাহার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। উত্তর চব্বিশ পরগণায় বাড়ি হলেও স্কুল বাঁকুড়ায়। ইনিও এসএসসির মেধাতালিকায় রয়েছেন। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছেন তাই প্রতিদিন বিক্ষোভে যোগ দেন। স্বামী মাহসুজার রহমান চাকরিপ্রার্থী না হলেও স্ত্রীর লড়াইতে তিনিও সামিল। সন্তান নিয়ে অবস্থান বিক্ষোভে উপস্থিত থাকছেন প্রতিদিন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
চাষ অবহেলা করে
তপন কুমার মাহাতো জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রাম সিমলাপাল থেকে ধরণায় এসেছেন। প্রতিদিন যাতায়াত সম্ভব নয় বলে বারুইপুরে অনেকের সঙ্গে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে সামান্য কিছু জমি রয়েছে, তাতে চাষবাস চললেও এই আন্দোলনের ফলে তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে। বন্ধুদের থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তপন।
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
আয়ুষির ক্ষোভ
দক্ষিণেশ্বরের বাসিন্দা আয়ুষি দাসের ক্ষোভ, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছের মানুষ হয়ে ফেল করা প্রার্থীরা, এমনকি পরীক্ষা না দেওয়া লোকজনও চাকরি করছে, আর তারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন”
-
লড়াইয়ের মঞ্চে ক্যান্সার আক্রান্ত নারী, সন্তান হারানো বাবা
অভিযোগ ও বিক্ষোভ
ইংরাজি বিষয়ের চাকরিপ্রার্থী পলাশ মণ্ডল। বললেন, যারা ওয়েটিং লিস্টে থাকল আর যারা এমপ্যানেলড হলো, কেউ জানেনা আসল রহস্যটা কী। পুরোটাই ধোঁয়াশা। যারা পাশ করেছে তারাও জানেনা কত নম্বর পেয়েছে আর যারা ফেল করেও চাকরি করছে তারা জানেনা কত তাদের নম্বর”
এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক হাজার ৬০০ পদে নিয়োগের আশ্বাস দিয়েছেন। এরপরেই আন্দোলন তুলে দিতে পুলিশ আশ্বস্ত হয়। পুলিশের দাবি, আদালতও আন্দোলন নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন ঠিক করে দিয়েছিল। একসঙ্গে ৩০ জনের বেশি আন্দোলন করতে পারবেন না, আন্দোলনস্থল বদলানো যাবে না ইত্যাদি। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেই নিয়ম মানছিলেন না। এছাড়াও বর্ষা চলে আসায় সমস্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা ছিল প্রশাসনের। সে কারণেই তাদের তুলে দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের পাল্টা যুক্তি, তীব্র গরমে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়েছেন, ফলে বর্ষার যুক্তি ধোপে টেকে না। তাদের দাবি, আন্দোলন তারা আদালতের নির্দেশ মেনেই করচিলেন। ডয়চে ভেলেকে এক আন্দোলনকারী জানিয়েছেন, ''এতদিন ধরে আন্দোলন চলছে, কোনো সহিসং ঘটনা ঘটেনি, হঠাৎ কেন পুলিশের মনে হলো যে মেরে ধরে আন্দোলন তুলে দিতে হবে?''
বৃহস্পতিবার দুপুরে কলকাতা পুলিশের ডিসি দক্ষিণের নেতৃত্বে আচমকাই আন্দোলনস্থলে বিশাল পুলিশবাহিনী জড়ো হয়। আন্দোলনকারীদের উঠে যাওয়ার নোটিস দেওয়া হয়। এর আধঘণ্টার মধ্যেই তাদের মেরে ধরে চ্যাংদোলা করে তুলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, চাকরির নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিলে তারা নিজেরাই আন্দোলনস্থল ছেড়ে দিতেন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি নির্দিষ্ট নয়, তা-ই তারা সেই প্রতিশ্রুতির পরেও আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। ভবিষ্যতে ফের তারা আন্দোলনে নামবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
এসজি/জিএইচ (পিটিআই)