1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কথা না শুনলে চাকরি থাকবে না

হারুন উর রশীদ স্বপন
৭ মে ২০২১

বাংলাদেশে যদি কোনো সাংবাদিক মালিক পক্ষের কথা না শোনেন তাহলে চাকরি থাকবে না৷ আর থাকেও না৷ যদি তাদের ফরমায়েস মতো কাজ না করেন, তাহলে তার চাকরি থাকে না৷ কারো চাকরি ছেড়ে দেয়ার মতো সক্ষমতা থাকলে সেটা তার পরম সৌভাগ্য৷

https://p.dw.com/p/3t7Iw
Symbolbild Journalismus & Recherche
ছবি: Imago Images/Panthermedia

তিনি হয়তো স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারেন৷ কিন্তু এমন সৌভাগ্যবান সাংবাদিক কত জন আছেন?

পত্রিকার নাম নাইবা বললাম৷ ২০০৪ সালের ঘটনা৷ দেশের  একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় অপরাধ রিপোর্টিং বিভাগের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে মাত্র যোগ দিয়েছি৷ পত্রিকার মালিক যেমন ‘সুবিখ্যাত' সম্পাদকও ডাকসাইটে৷ যোগদানের পরের সপ্তাহেই পত্রিকার রিপোর্টারদের সাপ্তাহিক বৈঠকে হাজির হলেন মালিক৷ আছেন সম্পাদকও৷ ওই প্রথম মালিককে সরাসরি আমি দেখি৷ সবাই তটস্থ৷ যেন ভয়ে কাঁপছেন৷ সম্পাদক কী কথা বলবেন! মালিকই রিপোর্টারদের রিপোর্টের ফলোআপ এবং আপডেট নেয়া শুরু করলেন৷ আর সেটা ছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা৷ অমুক ব্যাংককে ধসিয়ে দেয়ার কী হলো? ওই বিভাগের (সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লেখো, ট্যাক্স নিয়ে ঝামেলা করছে৷ আমাদের তো ওই ব্যাংক এখনো লোন দেয়নি৷ ব্যাংকের এমডি টিকে আছেন কীভাবে?

আমি নতুন হওয়ায় সেই যাত্রায় আমার ওপর কোনো ফরমায়েশ ছিলনা৷ বেঁচে গেলাম৷ তবে যতদিন ছিলাম ভয়ে ভয়ে ছিলাম৷ কারণ, ওই মালিক বসতেন মতিঝিলের একটি ভবনে৷ সেখানে প্রায়ই রিপোর্টারদের ডাক পড়তো৷ আর ডাক পড়া মানে কাউকে ধসিয়ে দেয়ার অ্যাসাইনমেন্ট নাজিল হওয়া৷ চাকরি করতে হলে সেটা করতে হবে৷ কেউ সেটা করতে অস্বীকার করলে বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেয়ার হুমকিও নাকি দেয়া হতো৷

ওই মালিকের যেহেতু জমির ব্যবসা, তাই দেখেছি কয়েকজন রিপোর্টারের কাজই ছিল অন্য হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে নিয়মিত ‘গল্প' লেখা৷ তারা বাধ্য হয়েই সেটা করতেন৷ না করলে চাকরি থাকতো না৷

বড় পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে তখন আমার মোহভঙ্গ হয়৷ আমার কপাল ভালো ওই পত্রিকায় ছয় মাসের বেশি চাকরি করতে হয়নি৷ বেশি বেতনে নতুন আরেকটি পত্রিকায় চাকরি পেয়ে যাই৷ তখন বিএনপি ক্ষমতায়৷

সেখানে গিয়ে পড়ি আরেক সংকটে৷ তবে আমি ‘বড় ভাই' বলে জানি তেমন আরেকজন ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন সেখানে৷ তিনি মাঝে মাধ্যেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমাদের বাঁচাতেন৷ একবার তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটা ভালো প্রতিবেদন করলাম৷ তার ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে৷ পুরোটাই সরকারি ডকুমেন্টভিত্তিক৷ সম্পাদকও প্রশংসা করলেন৷ কিন্তু রিপোর্ট আর ছাপা হয় না৷ আমিও আর খোঁজ নিতে সাহস পাই না৷ তারপর সম্পাদক একদিন নিজেই ডাকলেন আমাদের পুরো ক্রাইম টিমকে৷ জানালেন ওই প্রতিবেদন ছাপা যাবে না৷ আমরা কেউই কারণ জানতে চাইলাম না৷ তারপরও সম্পাদক নিজেই বললেন, মালিক পক্ষের নিষেধ আছে৷ রিপোর্টের মৃত্যু হলেও সম্পাদক যে নিজেই কৈফিয়ত দিয়েছিলেন, তার জন্য অনেক খুশি হয়েছিলাম আমি৷

তবে ওই পত্রিকার একজন উপ-সম্পাদক আমাকে বেশ ঘাঁটিয়েছিলেন৷ তখন জঙ্গিদের গোপন বৈঠকের একটি অডিও এসেছিল আমার হাতে৷ সেটা নিয়ে প্রতিবেদন করার সময় কিছু বিষয় আমি বাদ দিই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে৷ কিন্তু তিনি আমার কাছে সেই অডিও টেপ চাচ্ছিলেন একটি দূতাবাসকে দেয়ার জন্য৷ আমি না দেয়ায় তিনি সেই দূতাবাসকে দিয়ে আমাকে কৌশলে হুমকি দেয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন৷ আর হুমকি ছিল ওই দেশে যেতে চাইলে ভিসা না দেয়ার৷ সেই দেশটিতে আজও আমার যাওয়া হয়নি৷

পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করার সময় মালিকের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে আরেক সংকটে পড়ি আমি৷ তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তখন তালাক দেবেন৷ তার প্রতিবাদে ওই নারী টেলিভিশন চ্যানেল ভবনের  নীচ তলায় লিফটের সামনে এসে অনশন শুরু করেন৷ আমার ওপর ‘দায়িত্ব’ পড়লো তাকে পুলিশ ডেকে জোর করে উঠিয়ে দেয়ার৷ তা  সম্ভব না হলে লোকজন জোগাড় করে তাকে যে-কোনো উপায়ে ওখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে৷ আমার ‘শুভাকাঙ্খী' সহকর্মীরা বার বার মালিককে ফোন করে বলছিলেন , ‘‘হারুন তো কিছুই করছেনা স্যার৷ তাকে আপনি এত সুবিধা দিয়েছেন তাহলে কী জন্য?  আপনার বিপদে  সে কিছুই করছে না৷’’

আমি তো মহা বিপদে৷ চাপ আরো বাড়ছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ সহায়৷ আমি বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, পুলিশ আনলে বা কোনো জোর করলে সিন ক্রিয়েট হবে, তাতে ঝামেলা আরো বাড়বে, সবাই খবর পেয়ে যাবে, নিউজও হতে পারে৷ তার চেয়ে বরং চুপচাপ থাকলে তিনি কয়েক ঘণ্টা পর ক্লান্ত হয়ে নিজেই চলে যাবেন৷ শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল৷

আর ওই চ্যানেলেই কয়েকটি হাউজিং কোম্পানির রীতিমতো ডাকাতির খবর প্রচার করতে পারিনি৷ কারণ, তারা বিজ্ঞাপন দিতো৷ একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনার ফুটেজ আনার পরও সেটা প্রচার হয়নি৷ কারণ, ওই কারখানাটি ছিল মালিকের এক ‘পাতানো ভাইয়ের’৷

Harun Ur Rashid Swapan DW Korrespondent in Dhaka
হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলেছবি: DW

আমি সাংবাদিকতা শুরু করি ১৯৯৭ সালে দেশের একটি প্রাচীন দৈনিক দিয়ে৷ একবার সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করলাম৷ লিড হলো৷ ধন্য ধন্য পড়ে গেল৷ কিন্তু  সকাল পার হয়ে দুপুর হতেই চাকরি নিয়ে টান৷ কারণ, তিনি মালিকের এলাকার লোক এবং কাছের৷ দুপুরের পর মালিক এলেন৷ বার্তা সম্পাদক ছুটোছুটি শুরু করলেন৷ আমার কাছে ডকুমেন্ট চাইলেন৷ সব নিয়ে গেলেন মালিকের রুমে৷ বের হলেন এক ঘন্টা পর৷ ডকুমেন্ট দেখানোর পর চাকরি রক্ষা পেলো অনেক কষ্টে৷

এবার আরেকটি সংবাদমাধ্যমের কথা বলি৷ সেখানে আমি তখন রিপোর্টার থেকে নিউজ ম্যানেজার৷ সেখানে মালিক বলে দিতেন কার কার কিরুদ্ধে কোনো তথ্যভিত্তিক খবর পেলেও লেখা বা প্রকাশ করা যাবে না৷ সেখানে তালিকা ছিল কাকে রক্ষা করতে হবে আর কাকে ধসিয়ে দিতে হবে৷ বেশ কয়েকবার ঘটেছে, কোনো একটি ঘটনায় একটি-দুইটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘ওহি' নাজিল হতো- আর লেখা যাবেনা৷ একজন ছিলেন মালিক পক্ষের ‘পীর’৷ তিনি যা করবেন সব কিছুই হালাল করার দায়িত্ব ছিল আমাদের৷ আর এই পীর বংশ ধীরে ধীরে বাড়ছিল৷ তাদের রক্ষায়  কাজ করতে না পারলে চাকরি থেকে বিদায়৷ সত্যিই এক দিন আমাকে সেখান থেকে বিদায় নিতে হয়েছে৷

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সর্বশেষ সমালোচনার মুখে পড়েছে মুনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনার খবর পরিবেশন নিয়ে৷ আর সেই ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর৷ আমার পর্যক্ষেণ হলো, এই ঘটনায় যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র সক্রিয়৷ এখানে বসুন্ধরার নিজেদের ৫ টি সংবাদমাধ্যম চুপচাপ৷ কিন্তু তাদের পক্ষ নিয়েছে আরো কয়েকটি সংবাদমাধ্যম৷ এই পক্ষ নেয়ায় উৎসাহী গ্রুপ যেমন আছে, তেমনি বাধ্যও হয়েছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম৷ নয়তো ছোট মাছকে বড় মাছ গিলে খাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ এখানে আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন৷

আর সাধারণভাবে দেখলে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই এই ঘটনা কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে৷ বিষয়টি নিয়ে  জোরে কথা বলতে যেন ভয় পাচ্ছে৷

কিন্তু সব কিছুর পরও সাংবাদিকতা এমন এক পেশা, যেখানে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার সৎ সাহস থাকতে হয়৷ এই দুঃসময়ের মধ্যেও এই বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা সেটা পারেন৷ তাদের দেখেই এখনো সাংবাদিকতার সাহস পাই৷ আশার আলো দেখি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

কিয়েভে জেলেনস্কির সঙ্গে জোসেপ বরেল।
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ
প্রথম পাতায় যান