এবোলা ভাইরাস
২৪ জুলাই ২০১২কঙ্গোর এবোলা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মারাত্মক ভাইরাসজনিত এক রোগের খবর শোনা যায় ১৯৭৬ সালে৷ সেই নদীর নাম থেকেই এই ভাইরাসের নাম দেয়া হয় এবোলা৷ সেই সময় নদী তীরবর্তী গ্রামগুলিতে এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত ৩১৮ জনের মধ্যে ২৮০ জনই মারা যায়৷
ধারণা করা হয় এক জাতীয় বানর ও বাদুরের মধ্যে এই ভাইরাস আস্তানা গাড়ে৷ এই সব জীবজন্তুর ভাইরাস প্রতিরোধী শক্তি আছে বলে মনে করা হয়, তাই রোগটা এদের মধ্যে মাথা চাড়া দিতে পারে না৷ কিন্তু এই সব প্রাণীর সংস্পর্শে এলে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়৷ তবে কিছু কিছু গরিলার মধ্যেও এই অসুখ দেখা গেছে৷
রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ
সাধারণত শরীরের তরল পদার্থ যেমন রক্ত, লালা ইত্যাদির মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হয় এবোলা ভাইরাস৷ ক্ষুদ্র কোনো ক্ষত দিয়েই শরীরে ঢুকে পড়তে পারে এই ভাইরাস৷ আক্রান্ত হওয়ার চার থেকে ১৬ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণগুলি দেখা যায়৷ আক্রান্তরা জ্বর, শরীর কাঁপুনি, মাথাব্যথা, পেশিব্যথা, অরুচি এসব উপসর্গের কথা বলেন৷ সংক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে রক্ত বের হতে থাকে৷ চলে যেতে পারে দৃষ্টি শক্তিও৷ এমনকি মানসিক বৈকল্য ও শরীরে অবশ ভাবও দেখা যায়৷ একে একে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ মৃত্যু ঘটে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই৷
এবোলা ভাইরাসের বেশির ভাগ সংক্রমণই ঘটে থাকে উন্নয়নশীল দেশগুলির হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নোংরা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে৷ হাসপাতালের কর্মী ও নার্সদের মাধ্যমেও ছড়ায় এই ভাইরাস৷
এবোলা ভাইরাসে সংক্রমণ হলে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম৷ ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীই মারা যান৷ এটা নির্ভর করে ভাইরাসটির প্রজাতির ওপর৷ এই জীবাণুর গবেষণাও করতে হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে৷ গবেষণাগারের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে করতে হয় পরীক্ষা নিরীক্ষা৷
এবোলা নিরোধক ওষুধ বের হয়নি
এখন পর্যন্ত এবোলা প্রতিরোধী ওষুধ বা টিকা বাজারে আসেনি৷ রোগীকে উপসর্গগুলি কমানোর ওষুধ দেয়া হয়৷ বিগত বছরগুলিতে এই ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা বের করার জন্য বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে৷ কিন্তু মানবদেহে প্রয়োগ করার অনুমোদন এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি৷
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় গবেষক চার্লস আর্নজটেন ও তাঁর টিম ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এবোলা প্রতিরোধে এমন এক ধরনের টিকা আবিষ্কার করেছেন, যা চিকিত্সা জগতে আশার আলো জাগাতে পারে৷ এটি সুলভ মূল্যে প্রস্তুত করা যায়৷ আরেকটি ইতিবাচক দিক হল, বহুদিন পর্যন্ত এই টিকা মজুত করে রাখা যায়৷ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা যখন তখন এই টিকার প্রয়োজন হতে পারে এবং দ্রুত সরবরাহ করতে হতে পারে৷
এবোলা ইমিউন কমপ্লেক্স
এই টিকাকে ‘এবোলা ইমিউন কমপ্লেক্স' বলা হয়৷ এবোলা ভাইরাস থেকে সংগ্রহ করা প্রোটিন এবং এক ধরনের অ্যান্টিবডি দিয়ে তৈরি হয় এই প্রতিরোধী পদার্থটি৷ উত্পাদনের এই প্রক্রিয়াটি চলে জিন পরিবর্তন করা তামাক গাছে৷ গবেষণাগারে এই টিকা দেয়ার পর ইঁদুরগুলিকে এবোলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত করা হয়৷ পাঁচটির মধ্যে চারটি ইঁদুরই বেঁচে থাকে৷
ক্যানাডায় আরেক ধরনের টিকা বের করে মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়েছে৷ বছর তিনেক আগে হামবুর্গের এক ভাইরাস বিশেষজ্ঞ সুই এর খোঁচায় আহত হয়ে সম্ভবত এবোলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হন৷ নিরাপত্তাজনিত কারণে তাঁকে এমন এক ধরনের ওষুধ দিয়ে টিকা দেয়া হয়, যা শুধুমাত্র বানরের ওপরই পরীক্ষা করা হয়েছিল৷ কয়েক সপ্তাহ পর তিনি হাসপাতালের কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারেন৷
ক্যানাডার এই টিকা এখনও বাজারে বের হওয়ার অনুমোদন পায়নি৷ এজন্য আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন৷ এছাড়া এই টিকা সংরক্ষণ করাও সহজ নয়৷ সব সময় ওষুধের গুণাগুণের দিকে নজর রাখতে হয়৷
অ্যারিজোনায় তৈরি টিকা মানুষের জন্য কতটা কার্যকর হবে, তা এখনও গবেষকরা বলতে পারছেন না৷ এছাড়া এটাও বলা যাচ্ছে না, এই টিকা এবোলা দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর কাজে লাগবে কিনা৷
ডা. চার্লস আর্নজটেন আশা করেন, ভবিষ্যতে হাসপাতালগুলিতে এবোলা প্রতিরোধী টিকা ও অ্যান্টিবডি দুটোই মজুত করে রাখা যাবে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কেউ যদি এবোলা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়, তাকে প্রথমে অ্যান্টিবডি দিয়ে ইনজেকশন দেয়া হবে, তারপর আমাদের তৈরি এবোলা প্রতিরোধী টিকা দেয়া হবে তাকে৷ এর ফলে নিজস্ব রোগ প্রতিরোধী শক্তি গড়ে উঠতে পারে রোগীর শরীরে৷ বিশেষ করে মধ্য আফ্রিকার দেশগুলিতে, যেখানে এই অসুখ মাথা চাড়া দেয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে এই টিকা ও অ্যান্টিবডি কাজে লাগবে৷''
প্রতিবেদন: মারিয়েকে ডেগেন / আরবি
সম্পাদনা: জাহিদুল হক