1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘এখনো তারা আমাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে'

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৫ মে ২০২৪

২০২১ সালে বগুড়ায় কিশোর বাউল মো. মেহেদি হাসানের চুল কেটে দিয়েছিল গ্রামের মাতব্বররা৷ শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ ও শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের সেই অভিজ্ঞতা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন শিল্পী নিজেই৷

https://p.dw.com/p/4fUa7
লালন ফকিরের প্রতিকৃতি
লালন ফকির ১৯ শতকের একজন সুফি সাধক ও বাউল৷ তিনি অসংখ্য জীবন, আধ্যাত্মিকতা ও দেহতত্ত্ব সংক্রান্ত গান তৈরি করেছেন৷ তাকে নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে।ছবি: Mortuza Rashed

ডয়চে ভেলে: আপনি তো নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ২০২১ সালে৷ সেটা কী কারণে?

মো. মেহেদি হাসান: আমরা গান-বাজনা করি৷ বেশির ভাগ সময়ই সাদা পোশাক পরি৷ আমরা যারা আধ্যাত্মিক লাইনে, তারা আসরে মোমবাতি, আগর বাতি জ্বালাই৷ এই সাদা পোশাক, মোমবাতি আগরবাতি জ্বালানো, আমার বাউল গান গাওয়া- তাদের কাছে এগুলো ভুল৷ তাদের সমাজে চলবে না৷ এগুলো ধরে বসে তখন আমার সাথে তারা ওইরকম আচরণ (মাথার চুল কাটা) করেছিল৷

তারা কী বলতো আপনাকে?

তারা বলতো আমি নাকি হিন্দু হয়ে গেছি, হিন্দুদের কাজ-কারবার করি৷ আমি গান-বাজনা করি, এগুলো করা যাবে না৷ এগুলো মুসলিম শাস্ত্রে নাকি নিষিদ্ধ৷ আসলে ওদের যে ব্যাখ্যা ওগুলো কিছুই না৷ আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করার জন্য এই বানোয়াট কথাগুলো বলেছে৷

আপনাকে কী করেছিল?

আমি তখন ছোট ছিলাম৷ আমার চুল কেটে দিয়েছিল৷ আমার কাঁধ পর্যন্ত চুল ছিল৷ তা সবই কেটে দেয়৷ এখন আবার চুল বড় হয়েছে৷

 চুল কেটে দেয়ার পর কী হলো? আপনি কি কোনো বিচার পেয়েছেন?

মামলা হয়েছিল৷ তারা জামিনে আছেন৷ পরে আমি মামলার খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম৷ অগ্রগতি জানতে গিয়েছিলাম৷ আমাকে ওরা মামলার কাগজটাই দেখালো না৷

তারা বলতো আমি নাকি হিন্দু হয়ে গেছি: হাসান

ওরা কারা, থানা পুলিশ?

কোর্টে গিয়েছিলাম৷

তখন তো কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছিল..

তখন তিনজন অ্যারেস্ট হয়েছিল৷ ১১ দিন পরই তারা জামিন পেয়েছে৷

জামিন পাওয়ার পরে তারা আপনার সঙ্গে কোনো ঝামেলা করেছে বা আপনাকে হুমকি দিচ্ছে ?

অনেক কিছু করছে৷ আমাদের সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছে৷ আমাদের সঙ্গে কেউ কথা বললে, মিশলে তাদের ভয় দেখায়৷ এরকম অনেক নির্যাতনের মধ্যে আছি৷

সমাজ থেকে কি আপনাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়?

বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে৷ গত তিন বছর ধরে আমাদের সমাজে নেয়নি৷ সমাজের কোনো কাজ-কর্মে  আমাদের নেয় না৷ কোনো ধর্মসভায় নেয় না৷ তারা আসে না৷

আপনারা কোথায় থাকেন?

আমরা বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার গুজিয়াবাজার জুরি মাঝপাড়া গ্রামেই থাকি৷ তবে আমরা যে তিন ঘর বাউল আছি, তারা একখানে বসবাস করি৷ আমাদের আলাদা করে রেখেছে৷

তাহলে আপনাদের বাজার করা, যাওয়া-আসা, কাজ-কর্ম এগুলো কীভাবে করেন? থাকতে তো হয়? খেতে তো হয়?

আমরা সবই করি৷ কিন্তু কেউ আমাদের সাথে কথা বলেনা৷ কেউ কথা বলার চেষ্টা করলে তাদের ওরা হুমকি দেয়৷ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আসামিরা নানা রকম কথা বলে৷ মাঝে-মধ্যে আমাদের হিজড়া বলে৷ তবে বাজারে গিয়ে কেনা-কাটা করতে পারি৷ সেখানে সমস্যা হয় না৷

তারা কারা , তাদের নাম কী?

যেমন একজন আছে খোকন৷ আরেকজন মেজবাউল৷ আরো কয়েকজন আছে৷

তারা কি প্রভাবশালী? মেম্বার চেয়ারম্যান? তারা কি রাজনীতি করে?

তারা মেম্বার, চেয়াম্যান না৷ তারা এলাকার মাদ্রাসা, মসজিদ কমিটির সভাপতি-এইরকম- মাতব্বর যাকে বলে৷

আপনার কোনো গান নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল?

কোনো গান মানে, যে-কোনো গানই গাওয়া যাবে না৷ তারপর আমাদের তরিকার চলাফেরা, ধর্মসভা এগুলো করা যাবে না৷ সাদা পোশাক পরা যাবে না৷

তারা আপনাকে তখন ‘হিন্দু' বলেছে৷ কিন্তু আপনি তো হিন্দু না..

আমি একজন মুসলমান৷ আমি নামাজ,রোজা সবই করি৷ আমি হলাম তরিকাপন্থি৷ একজন গুরুর হাতে হাত দিয়ে বায়াত করেছি৷ আমি মোমবাতি আগরবাতি জ্বালাবো৷ আমার গুরুকে স্মরণ করবো৷ আমার আল্লাহ রাসুলকে ডাকবো৷ এগুলো তাদের কাছে ভুল৷ তারা বলে মসজিদে আসো৷ ওগুলো করা লাগবে না, ওগুলো মূর্তিপূজা৷

এদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়?

হ্যাঁ, উদ্দেশ্য আছে৷ আমাদের অনেক জমি, সেই জমি ওরা দখল করে খাচ্ছে৷ তারা প্রতি বছর একটা করে বানোয়াট কথা ছাড়ে আর আমাদের ওপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে৷

কত জমি?

আমাদের তিন ঘরের ৫৪ বিঘা জমি নিয়ে এখন মামলা চলছে৷

আপনাদের তিন পরিবারে কতজন লোক?

বিশ জন হবে৷ আমরা দুই বোন এক ভাই৷ আমার বাবা অন্যের কাজ করে৷ আর আমি টুকটাক গান গেয়ে যা পাই তা দিয়ে আমার পোশাক, খাওয়া-দাওয়া চলে৷ আর তারা ওই কাজ (চুল কেটে দেয়া) করার পর আমি যে-কোনো জায়গায় যেতেও পারি না৷ একটা কলঙ্ক৷

আপনারা কোন তরিকার? কোন গুরুর হাতে বায়াত হয়েছেন?

আমরা চিশতিয়া নিজামিয়া তরিকার৷ আমার গুরুর নাম দয়াল হজরত ইমরান শাহ চিশতি নিজামিয়া৷

আপনি কোন ধরনের গান করেন?

আমি লালন শাহর কিছু গান গেয়েছি৷ এছাড়া রশীদ সরকার, মুক্তা সরকার, কাজল দেওয়ান ,রাজ্জাক দেওয়ান- এদের গান গাই৷ আমি কিছু গান লিখেছিও, তা এখানো প্রকাশ্যে গাওয়া হয়নি৷ আমার কিছু গান ইউটিউব চ্যানেল ওয়ালারাও রেকর্ড করে নিয়ে গেছে৷ কিছু তারা প্রচার করেছে, কিছু করেনি৷

অনেকে বলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে৷ আাপনি কী মনে করেন?

না এটা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কোনো বিষয় নয়৷ অনেক বাউল আছে৷ তারা কি মুসলমান না?  সবাই কি হিন্দু?