শিক্ষাবিদরা বলছেন, দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে৷ যদিও এটা খারাপ কিছু না, কিন্তু যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে৷ এমন ব্যক্তিরা উপাচার্য হচ্ছেন যারা কোন হলের হাউজ টিউটর হিসেবেও কখনও দায়িত্ব পালন করেননি৷ ফলে তাদের পক্ষে এসব সংকট মোকাবেলা করা কঠিন৷ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা নতুন কিছু নয়৷ যেসব কারণে এখন অস্থিরতা হচ্ছে, একই কারণে আগেও সংকট হয়েছে৷ দেশে যদি গণতন্ত্রের সংকট হয় এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়বে৷

একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থির হওয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক কোন যোগসূত্র দেখেন কিনা? জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ তবে যেটা বলা হচ্ছে, ছাত্রলীগে এমন সব ছাত্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে তারা হয়ত এক সময় ছাত্রদল বা শিবির করতো৷ তাদের তাদের মূল সংগঠনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখা উচিৎ৷ দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা কী তাহলে যোগ্য নন? জবাবে অধ্যাপক মান্নান বলেন, ‘‘দলীয় বিবেচনা আমি খারাপভাবে দেখি না৷ যদি যোগ্য লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাতে তো কোন সমস্যা নেই৷ এমন সব উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তারা কখনও বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালনও করেননি৷ একটা হলের হাউজ টিউটর ছিলেন না৷ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন কীভাবে?''

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনো বখাটে, কখনো পরিবহন শ্রমিক আবার কখনো স্থানীয় এলাকাবাসীর হাতে মার খাচ্ছেন৷ আবার কোথাও ছাত্র সংগঠনের দুটি গ্রুপের মারামারিতে অস্থির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস৷ কোথাও আবার চলছে শিক্ষকদের গ্রুপিং৷ এসব বিষয় বিরূপ প্রভাব পড়ছে লেখাপড়ায়৷ শিক্ষাবিদেরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ আবাসন নিশ্চিত না হওয়ায় এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাইরের মেসে বা হোস্টেলে থাকেন৷ তারা বাইরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কথা বলার পরিবেশ পান না৷ এ ছাড়া উন্মুক্ত হওয়ায় অনেক ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা অবাধে বিচরণ করে৷ অনেক সময় বখাটের হাতে নারী শিক্ষার্থী হয়রানি হচ্ছে৷

ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ না থাকা এর বড় কারণ৷ আরেকটি বিষয় হলো, একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় যে ছাত্র সংগঠন আছে তাদের একক আধিপত্য৷ যেমন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা নিজেরাই মারামারি করেছে৷ এখন দেশে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আপনি এটা আশা করবেন কীভাবে? এর প্রভাব তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেই৷ আবার দেখেন দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ হচ্ছে৷ তারা আসলে প্রশাসনিকভাবে অতটা দক্ষ নন৷ ফলে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না৷ এছাড়া শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে৷ ফলে তারা সুযোগ পেলেই প্রতিবাদ করেন৷ এসব কারণেও সমস্যাগুলো হচ্ছে৷''

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা অন্যতম৷ গত সোমবার বহিরাগত তরুণের গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিডিও ধারণ নিয়ে তর্কাতর্কি এবং এর জেরে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন শেখপাড়া বাজারে দুই শিক্ষার্থীকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করা হয়৷ বখাটেদের হামলায় ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হাসান জিসাদ ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্ত হাসান আহত হন৷ তাদের কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এ ঘটনায় কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা৷ এরপরই ক্যাম্পাসে বহিরাগতেরা প্রবেশ করতে পারবে না বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ এই ঘটনায় ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও বাইরে মহানগর ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিয়েছে বলে জানা গেছে৷ গত ১১ মার্চ বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গাড়িচালক শরিফুল ও তার সহযোগী রিপনের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন আকাশের৷ এরপর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে আকাশসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফের কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়৷ পরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে ঘটনা বড় হয়ে যায়৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ছোড়ে৷ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়৷ পরদিন ১২ মার্চ আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা৷ এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মতিহার থানায় মামলা করা হয়৷ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও দাবি মানার আশ্বাসে ক্লাসে ফেরেন শিক্ষার্থীরা৷  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এতজন কর্মকর্তা একসঙ্গে পদত্যাগ করছেন এবং তার পেছনে যেসব কারণ আছে বলে জানা যাচ্ছে তা উদ্বেগজনক৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিতর্ক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এটি তদন্ত করে দেখা উচিত৷ আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনা তাতে মনে হচ্ছে, আমাদের সমাজে সার্বিকভাবেই সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে এসেছে৷ সে কারণে তারা স্থানীয়দের কাছে অতিথি৷ স্থানীয়দের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত মিটিয়ে ফেল উচিত৷ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এখানে ভূমিকা রাখা উচিৎ৷ তারা চাইলে পরিস্থিতি এতদূর যেত না৷''

গত মঙ্গলবার সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেগুনার চালক-সহকারী ও এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয়৷ যাত্রী পরিবহনকারী লেগুনা পেছন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে প্রথমে কথা-কাটাকাটি হয়৷ পরবর্তী সময়ে সংঘর্ষে জড়ায় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা৷ পরে সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানা পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়৷ এ ঘটনার পর শুক্রবার পর্যন্ত ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কাস ও পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ৷

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত ৮ মার্চ৷ অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন নতুন উপাচার্য হয়ে আসার পর বেপরোয়া হন শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলায় আত্মস্বীকৃত খুনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব চন্দ্র দাস৷ ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী রানা তার বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সে বিপ্লবকে ভর্তির সুযোগ দেন৷ গত ৩০ জানুয়ারি রাতে বিপ্লবের নেতৃত্বে কয়েকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে উঠতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বাধা দেন৷ এ নিয়ে এক সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা হয়৷ পরে এর জেরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৭ মার্চ এনায়েত উল্লাহ এবং সালমান চৌধুরীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে৷ পরদিন ৮ মার্চ দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আল আমিনের দোকানের সামনে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে প্রকাশ্যে মারধর করে গুরুতর আহত করে বিপ্লব গ্রুপ৷ এই হামলার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা৷

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি দুই দফায় ১৯ শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন৷ এরমধ্যে প্রথম দফায় প্রক্টরসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পদ থেকে ১৬ শিক একযোগে পদত্যাগ করেন৷ এর এক দিন পরেই চার পদ থেকে পদত্যাগ করেন আরও তিন শিক৷ মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদে নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে প্রক্টরের দ্বন্দ্ব থেকেই পদত্যাগের ঘটনা৷ বিষয়টি নিয়ে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে৷ প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, উপাচার্যের সঙ্গে প্রক্টরিয়াল টিমের মনোমালিন্য চলছিল৷ বিষয়টি নিয়ে এখনও অস্থিরতার মধ্যে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়৷

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংঘাত বাড়ছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুচ্ছ কারণে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও রোধ করতে পারছে না৷ তবে প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিলে দ্রুত সমাধান সম্ভব৷ আমি মনে করি, রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শৃঙ্খলা রায় পরিবেশ রা কমিটি করা উচিৎ৷ ক্যাম্পাসে পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজনের সম্পৃক্ততা আছে৷ যে কারণে তুচ্ছ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ এই পরিস্থিতি এড়াতে পরিবেশ রক্ষা কমিটি গঠন করা প্রয়োজন৷ যেই কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বাইরে জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক প্রতিনিধি এবং ক্যাম্পাস-সংশ্লিষ্ট বাজার কমিটির প্রতিনিধিদের রাখতে হবে৷ এর ফলে অনেক সংঘাত এড়ানো সম্ভব৷''