উত্তরবঙ্গে ফের রামকৃষ্ণ মিশনের জমি দখলের অভিযোগ
৪ আগস্ট ২০২৪রামকৃষ্ণ মিশনের জমি দখলের জন্য গত মে মাসে হামলার অভিযোগ উঠেছিল দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। তারপর জমি মাফিয়াদের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফের একবার অন্য একটি জমি হাতানোর অভিযোগ তুলেছেন মিশন কর্তৃপক্ষ।
জমি হাতিয়ে গুদাম
শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের উল্টোদিকে মাল্লাগুড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের ৯ দশমিক ৯০ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ১০ বিঘা জমি আশ্রম কিনেছিল ১৯৭৬ সালে। বাকি জমি আশ্রমকে দান করা হয়। অভিযোগ, জমির সিংহভাগই দখল হয়ে গিয়েছে। তৈরি হয়েছে গুদাম ঘর, দোকান। এমনকি দখলদাররা নিজেদের নামে জমির নথি তৈরি করে নিয়েছে।
আড়াই দশক ধরে বেহাত হয়ে রয়েছে জমি। এই জমির বাজারমূল্য ১৪০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে জমির মিউটেশনের জন্য আবেদন করে আশ্রম। ভূমি দপ্তর থেকে জানা যায়, এই জমির মিউটেশন হয়ে গিয়েছে অন্য নামে। প্রশ্ন উঠেছে, দলিল যদি আশ্রম কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে, তাহলে অন্য কারো নামে মিউটেশন হল কী করে?
দখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেবকে ২৭ জুলাই চিঠি দেন রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ পেয়েই শুক্রবার শিলিগুড়ি পুরনিগম ভবনে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মেয়র।
বৈঠকের পর সাহুডাঙ্গি রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী বিনয়ানন্দ মহারাজ বলেন, "আমরা জমি উদ্ধারের জন্য মেয়রের কাছে আবেদন করেছিলাম। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, ওই জমি উদ্ধারে সাহায্য করবেন।"
মেয়র গৌতম দেব বলেন, "১৯৭৬ সালের জমি। ১৯৯০ সাল থেকে সেখানে স্থায়ী, অস্থায়ী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি হতে শুরু করে। বাম আমলে জমি দখল হয়ে গিয়েছে। অথচ জমির দলিল রামকৃষ্ণ মিশনের নামে রয়েছে। আমি যেখানে বিষয়টি জানানোর সেখানে জানাব।”
মে মাসের হামলা
লোকসভা নির্বাচনের সময় রামকৃষ্ণ মিশনের ভবনে দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়েছিল। তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয় মে মাসে।
শিলিগুড়ির সেবক রোডের চার মাইলে প্রায় দুই একর জমি সহবহুতল রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করেছিলেন একজন। এই সেবক হাউসেই থাকতেন মিশনের কয়েকজন সন্ন্যাসী। এই আশ্রমটি জলপাইগুড়ি রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত। অভিযোগ, সেখানে গভীর রাতে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। নিগ্রহ করা হয় আবাসিকদের।
কয়েক কোটি টাকা দামের জমি দখলের জন্যই হামলা চালানো হয় বলেই মিশনের অভিযোগ। নিরাপত্তারক্ষী ও আশ্রমিকদের প্রাণনাশের হুমকি দেয় হামলাকারীরা। অভিযোগ, সেবক হাউস ছেড়ে দিতে বলে। এনিয়ে নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূলকে আক্রমণ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
মমতার হুঁশিয়ারি
ভোটের মধ্যে এই ঘটনায় রাজ্য সরকার অস্বস্তিতে পড়ে। তৃণমূলের স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও জমি মাফিয়াদের যোগসাজশের অভিযোগ তোলে বিজেপি। উত্তরবঙ্গে কোচবিহার ছাড়া সব আসনে এই লোকসভা ভোটেও হেরেছে তৃণমূল। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী জমি দখলের ব্যাপারে কড়া অবস্থান নেন।
জুনের শেষ সপ্তাহে নবান্নে পুরসভাগুলির সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি শিলিগুড়ির জমি মাফিয়াদের নিয়ে তীব্র ভর্ৎসনা করেন মেয়র গৌতম দেবকে। বলেন, "ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে একটা ল্যান্ড মাফিয়া গ্রুপ তৈরি হয়েছে। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে বিএলআরও এবং পুলিশের লোকও জড়িত আছে। আগেও এ বিষয়ে আমি সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি।"
মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরই তৎপর হয় পুলিশ, প্রশাসন। সরকারি জমি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয় ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকার তৃণমূলের ব্লক সভাপতি ও জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সাবেক কর্মাধ্যক্ষ দেবাশিস প্রামাণিককে। ধরা হয় গৌতম গোস্বামী নামে আর এক তৃণমূল নেতাকে।
জমি জবরদখল ও বিক্রির অভিযোগে চলতি সপ্তাহে শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরো দুই তৃণমূল নেতাকে। ফুলবাড়ি ১ নম্বর অঞ্চলের সাবেক অঞ্চল সভাপতি মোহাম্মদ আহিদ ও মোহাম্মদ নাসিরকে পুলিশ ধরেছে।
এর পরেও যে জমি মাফিয়ারা বেআইনিভাবে হাতানো জমি ভোগদখল করে চলেছে, সেসব জমি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়নি, এটা প্রমাণিত হয়েছে সাহুডাঙ্গি আশ্রম কর্তৃপক্ষের অভিযোগে।
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও কেন জমি মাফিয়ারা এখনো দখলদারি বজায় রাখতে পারছে? সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ভূমি রাজস্ব দপ্তরের আধিকারিকদের সরকারি জমি কেনাবেচার সঙ্গে যোগসাজস আছে। কয়েকজন আধিকারিককে বদলিও করা হয়েছে। কিন্তু নিচুতলায় জমিকে ঘিরে এত রকমের স্বার্থ জড়িত থাকে যে, চট করে এর সমাধান সম্ভব নয়। পুলিশ ও শাসক দল স্থানীয় স্তরে যে সমঝোতা করে চলে, তাকে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ ছাড়া ভাঙা যায় না।"