করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আরোপিত কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে ২০২০ সালে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎস ঈদুল ফিতরের উদযাপন ছিল ঘরবন্দি, ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ছিল খুব সীমিত৷ ২০২১ সালে বিধি-নিষেধর বেড়াজাল খানিকটা শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি র কিছুটা উন্নতি ঘটলেও তা ২০১৯ সালের মতো হয়নি৷ তবে ২০২২ সালে এসে সবধরণের বিধিনিষেধ উঠে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ধারায় ঈদের অর্থনীতিতে আবার জোয়ার লক্ষ করা গেছে৷
কোনো বিস্তারিত গবেষণাভিত্তিক কাজ না হলেও এটা এখন সর্বজন স্বীকৃত যে ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও লেনদেন হয়ে থাকে তা সারা বছরের বিভিন্ন উৎসবভিত্তিক অর্থনীতির অন্তত অর্ধেক৷ ঈদুল আজহা, পহেলা বৈশাখসহ অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতীয় দিবসভিত্তিক উৎসব বাকিটা সম্পন্ন করে বলে ধারণা করা যায়৷ রাস্তার ধারের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে বিলাসবহুল বিপণী বিতানের কেনাবেচা কিংবা কাঁচাবাজার থেকে খাবার-দাবারের বিকিকিনি সবটাতেই ঈদকেন্দ্রিক লেনদেনেই সবচেয়ে বেশি হয়৷ এই ঈদকে ঘিরে দেশজুড়ে যাত্রী পরিবহনের যে ব্যবসাটা হয়, তার সারা বছরে এমনকি ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের সময়ও হয় না৷ ঈদের ছুটিতে দেশীয় পর্যটন ব্যবসাও চাঙা হয়ে ওঠে যা একমাত্র বছর শেষের শীতের ছুটির সাথে তুলনীয়৷
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘দেনার নীচে পইড়া গেসি’
ঢাকার মিরপুরে ভ্রাম্যমাণ খাবার বিক্রেতা মো. নয়ন বলেন, ‘‘করোনার আগে তো দিন আনসি, দিন খাইসি৷ কিছু টাকাপয়সা হাতেও রাখতে পারসি, ঈদ গেসে কোনোরকম৷ এহন করোনা হওয়ার পর ঈদ-উদ দেখার সুযোগ নাই৷ হাতে জমানো টাকা শেষ হয়া আরো ৪০-৫০ হাজার টাকা দেনার নীচে পইড়া গেসি৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘বাপ-মারে ঈদে কাপড় দিতে পারি নাই’
ঢাকার আগারগাঁওয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. সুমন মিয়া দুই ছেলে এক মেয়ের জনক৷ ঈদে গ্রামের বাড়ি বরিশালে যাওয়ার সুযোগ হয়নি এবার৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের ঈদ্গুলি আছিল ভালোই, পরিবার, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরে কাপড় দিতে পারসি৷ কিন্তু করোনার পর থেকে আর এইগুলি সম্ভব হইতেসে না৷ এইবারের ঈদে খালি ছেলে-মেয়েরে এক সেট কাপড় দিসি, বাপ-মা’রে কিছু দিতে পারি নাই, মনটা ছোট হয়া আছে এইজন্য৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘আমগো কথা কে ভাবে!’
ঢাকার শ্যামলী এলাকার ময়লা সংগ্রহকর্মী জামাল হোসেন৷ করোনার আগে-পরের ঈদের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমাগো আর ঈদ কী? করোনার আগে যা-ও আছিল, এহন এক্কেরে আমরা শ্যাষ৷ আপনেগো মতো কত সাংবাদিক ছবি তুললো, কই আমরা কিছু পাইছি? কেউ এক পয়সা দিয়া জিগাইছে কিছু? আমগো কথা কে ভাবে? কেউ না৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘এই ঈদে মার্কেট থিকা কাপড় কিনসি’
ঢাকার পীরেরবাগে মুদি দোকানি মোছা. সীমা আক্তার৷ স্বামীর অন্য আয়ের পাশাপাশি এই ছোট দোকান করছেন তিনি ৩-৪ বছর যাবত৷ সাম্প্রতিক ঈদ কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘গত দুই রোজার ঈদে তিন মেয়েকে ফুটপাথ থেকে কাপড় কিনা দিসি কম দামে৷ কাপড়চোপড় না দিলে কান্নাকাটি করে, নিজেরও খারাপ লাগে৷ এই ঈদে লকডাউন না থাকায় ব্যবসাপাতি কিছুটা ভালো, তাই মার্কেট (শপিং মল) থেকে ওগোরে কাপড় কিনা দিতে পারসি৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘করোনার ক্ষতি পূরণ করা কঠিন’
ঢাকার শেওড়াপাড়ায় মিথুন হেয়ার ড্রেসারের নরসুন্দর রতন চন্দ্র শীল৷ এই ঈদে তার আয় গত দুই বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘করোনার লকডাউনে দীর্ঘ সময় দোকানপাট খুলতে পারি নাই৷ বাসা ভাড়া বাকি পড়সে প্রায় ৪০ হাজার টাকা৷ করোনায় আমাদের যে ক্ষতি হইসে, তা পূরণ করতে আমার মনে হয় বছর ৩-৪ লাগবে৷ এছাড়া উপায় নাই৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘পরিবারকে গ্রামে পাঠায় দিসি’
ঢাকার আগারগাঁওয়ের ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন রিপন দেবনাথ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ধর্মে তো ঈদ নাই, আমরা পূজা পালন করি৷ সামনের বড় পূজা দূর্গাপূজা এই কোরবানি ঈদের আগেই৷ তবে লকডাউনের কারণে গত দুই বছর কামাই-রোজগার তেমন আছিল না, পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করসি৷ পূজায় ছেলেমেয়েদের তেমন কিছুই দিতে পারি নাই৷ পরিবারকে লকডাউনে বাড়িতে যে পাঠাইসি, এখনো আনার সাহস পাই নাই৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘পুলিশ খালি দৌড়ানি দিতো’
ঢাকার মিরপুরের কাঁচা সবজি বিক্রেতা মো. নাসির উদ্দিন৷ বাড়তি খরচ করে ঈদে বাড়ি যাননি তিনিও৷ নাসির বলেন, ‘‘লকডাউনে যে চাইরটা ঈদ গেসে, টেরই পাই নাই৷ লকডাউনের সময় পুলিশ রাস্তায় খাড়াইতেই দেয় নাই, যদিও নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচাবাজারের অনুমতি আছিল বইলা শুনসিলাম৷ কিভাবে যে দিনগুলা পার করাইসে আল্লাহ, বইলা বুঝাইতে পারবো না৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা করার অবস্থা হইসিলো’
আগারগাঁওয়ের ৬০ ফুট সড়কে একটি দোকানে রংয়ের কাজ করছিলেন রংমিস্ত্রী আবুল হোসেন৷ ঈদের তৃতীয় দিনেই কাজে লেগে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পারলে তো আমরা ঈদের দিনেও কাম করি৷ প্যাটে ভাত না থাকলে ঈদ কী আর আনন্দ কী৷ কাজ কাম যে এখন পাইতেসি টুকটাক এইটাই বেশি৷ করোনার সময় জমানো টাকা-পয়সা সব শেষ হয়া ধার কর্জ করসি মানুষের কাছে৷ মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা করার দশা হইসিলো আমাগো মতো গরীব মানুষের৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘সংসার চালাইতে রিক্সাও টানসি’
করোনার সময় আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায় মো. আবদুল জলিলের৷ সম্প্রতি তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে চাকরি পেয়েছেন৷ ঈদে তাই মেলেনি ছুটি৷ জলিল বলেন, ‘‘সংসার চালাইতে এই বয়সে রিক্সা পর্যন্ত টানসি৷ এখন আল্লাহ মুখ তুইলা একটু চাইসে৷ দুই মাস হইসে এই চাকরি পাইসি, তা-ও ঈদে ছুটি পাই নাই৷ খাইয়া-পইরা কোনোরকম এখন আছি মন্দের ভালো৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘প্যাটে ভাত না থাকলে আবার ঈদ কী’
দৈনিক মজুরিতে হোটেলে কাজ করেন ছবির এই ব্যক্তি৷ লকডাউনে সব বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন তার আয় ছিল না৷ এবার ঈদে তারও বাড়িতে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি৷ ঈদ উদযাপনের কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, ‘‘পেটে যদি ভাত না থাকে, তাইলে ঈদ আইলেই কী আর গেলেই কী৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
‘কাম না করলে খাওন নাই’
ঢাকার চিড়িয়াখানা-কমলাপুর রুটে চলাচলকারী আয়াত পরিবহণের চালকের সহকারি মো. রুবেল মিয়া৷ বাড়িতে না গিয়ে ঈদের মধ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি৷ রুবেল মিয়া বলেন, ‘‘করোনায় অনেকদিন পরিবহণ বন্ধ আছিল৷ যা-ও চালু আছিল, প্যাসেঞ্জার আছিল না, কারণ, অফিস আদালত, স্কুল কলেজ বন্ধ আছিল৷ আমরা যে কেমনে সংসার চালাইসি, কইতে পারি না৷ খায়া না খায়া দিন কাটসে৷ আমগো কাম না করলে খাওন নাই৷’’
-
যেমন ছিল ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষদের ঈদ
বিপরীত চিত্র
করোনার সময় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরি হারান মিল্টন শেখ৷ পরে শুরু করেন খাবার ও পণ্য ডেলিভারির কাজ৷ আয়-রোজগার করে গত বছরের ঈদে বাড়িতে টাকাও পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু এবার সেই তুলনায় আয় ভালো হয়নি বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘গত তিন-চার মাসে কাজের চাপ তুলনামূলক কম৷’’ ঈদের মধ্যে বাড়ি না গিয়ে ঢাকায় বাড়িতে বাড়িতে খাবার ও পণ্য সরবরাহের কাজ করে গেছেন মিল্টন৷
লেখক: মর্তূজা রাশেদ (ঢাকা)
ঈদুল ফিতরের ব্যবসা-বাণিজ্যের শুরুটা হয় অবশ্য ঈদের আগে পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে৷ এই মাসের জন্য প্রধানত খাদ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা একদিকে যেমন কাঁচাবাজারের ও খাবারের দোকানের বিকিকিনি বাড়ায়, অন্যদিকে বাড়ায় মূল্যস্ফীতিও৷ আর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ঈদের সময় অব্যাহত থাকে৷ মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য কষ্টকর হলেও এটা থেকে বোঝা যায় যে বাজারে টাকার সরবরাহ ও লেনদেন বেশ বেড়েছে৷ এ বছর ঈদের প্রাক্কালে মুদ্রাবাজারে টাকার সরবরাহ কি পরিমাণ ছিল, তা জানতে অবশ্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে৷ বাংলাদেশ ব্যাংক এ মাসের শেষের দিকে এপ্রিলের মুদ্রা সরবরাহের হিসেব প্রকাশ করবে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মাসের মাঝামাঝি এপ্রিলের মূল্যস্ফীতির তথ্য জানাবে৷ মার্চ মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ যা ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ অনুমান করা যায় যে এপ্রিলে তা আরেকটু বাড়বে এবং তা সাড়ে ছয় শতাংশ অতিক্রম করে যেতে পারে৷
ঈদের সময় মানুষের খরচ করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হয় আরো দুটি সূচকে৷ একটি হলো ঈদের আগে দেশে আসা প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) প্রবাহে, অন্যটি হলো ডিজিটাল ও অনলাইন ব্যাংকিং লেনদেনের পরিসংখ্যানে৷ মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ডভিত্তিক লেনদেন ইত্যাদির এপ্রিল মাসের হালনাগাদ পরিসংখ্যান পেতেও সময় লাগবে৷ ফলে আপাতত, কোনো রকম আনুষ্ঠানিক উপাত্ত ছাড়াই এটা বলতে হচ্ছে যে ঈদের অর্থনীতিতে বড় ধরণের লেনদেন হয়েছে যা অর্থনীতি চাঙা হওয়ার একটি প্রমাণ৷
এছাড়া রমজানন মাসে বাংলাদেশের সামর্থ্যবান মুসলমানেরা জাকাত আদায় করে থাকেন, প্রচুর দান-সাদকাহ করেন৷ এর ফলেও একদিকে বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ে, অন্যদিকে গরিব ও অভাবী মানুষের হাতেও কিছু টাকা আসে৷ আবার বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা এসব দানের অর্থে অভাবগ্রস্ত ও নিম্নআয়ের অনেক মানুষের জন্যে ঈদের আগে খাবার-সামগ্রী ও পোশাক কিনে বিতরণ করে৷ এভাবে বাজারে বিকিকিনি বেড়ে যায়৷
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি একটি অনুমিত হিসেব দিয়েছে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসার লেনদেনের বিষয়ে৷ তাতে বলা হয়েছে যে এবারের ঈদে এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে আর তা ২০১৯ সালের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বলেও ধারণা করা হচ্ছে৷
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এবারের ঈদের কেনাকাটার সাথে পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক কেনাকাটা অনেকটাই মিশে গিয়েছে দুটি উৎসবদুই সপ্তাহের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে৷ গত দুই বছর যেখানে পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়েছিল, সেখানে এবার তা অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা-বিক্রেতারা৷ ফ্যাশন হাউজ রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাসের সাথে এ নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কাছাকাছি দুই উৎসবকে মাথায় রেখে এবার অনেকটা মিশ্র্র ধরণের পোশাক এনেছি৷ উদ্দেশ্য ছিল যারা ঈদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় নতুন কাপড় কেনেন, তারা যেন বৈশাখী পোশাককে তাদের পছন্দ হিসেবে বেছে নেন৷ আমাদের সে প্রয়াস অনেকটাই সফল হয়েছে৷’’
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
ঈদ খাবারের আইকন
দুধ, চিনি, বাদাম, এলাচ দিয়ে রান্না করা লাচ্ছা ও বাংলা সেমাই বাংলাদেশে ঈদ খাবারের আইকন। ঈদের দিন সকালে খাবার টেবিলে সুস্বাদু সেমাই পরিবেশন করা বাঙালির ঐতিহ্য। অতিথি আপ্যায়নে এর জুড়ি মেলা ভার।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
সেমাই শব্দের গল্প
বাংলা অভিধানে ‘সেমাই’ শব্দকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও দেশি। ভাষা পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, গ্রিক শব্দ ‘সেমিদালিস’ থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি। সেমিদালিস অর্থ ময়দা। সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় ‘সমিদা’ রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকে সেমাই, সেমিয়া, সেমাইয়া ইত্যাদি শব্দের উদ্ভব। সেমাইয়ের ইংরেজি নাম ‘ভারমিসেলি’। এটি ইতালীয় শব্দ ‘ভারমিয়েল্লি’র ইংরেজি রূপ।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি
ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ লাচ্ছা সেমাই। এর উৎপত্তি কোথায় এবং এই নাম কেন সেসব নিয়ে মতভেদ আছে। আরবি শব্দ ‘লম্বুতদার’ ঢাকার আদি বাসিন্দাদের মুখে উচ্চারিত হতো ‘লাচ্ছাদার’। দুটি শব্দেরই অর্থ সুস্বাদু। তাই ধারণা করা হয়, লাচ্ছাদার থেকেই লাচ্ছা নামটি এসেছে। জনশ্রুতি আছে, ঢাকায় আগত অবাঙালি কিংবা আদি ঢাকাইয়ারা প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
লম্বা বাংলা সেমাই
ঈদে লাচ্ছা সেমাই জনপ্রিয় হওয়ার আগে লম্বা সেমাই বেচাকেনা হতো বেশি। এর আরেক নাম ‘বাংলা সেমাই’। একসময় অতিথি আপ্যায়নে এর কদর ছিল বেশি। দাম কম হওয়ায় খোলা লম্বা সেমাই ছিল ঈদ খাবারের অন্যতম উপকরণ। তবে এখন লম্বা সেমাইয়ের চাহিদা খুব কম।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
মণ মণ সেমাই
বাজারের চাহিদা পূরণে শহরের বিভিন্ন কারখানায় এখন দিন-রাত উৎপাদন চলছে। সেমাই কারখানার আয়তন এবং অর্ডার অনুযায়ী উৎপাদন নির্ভর করে। প্রতিদিন গড়ে একেকটি কারখানায় ২০ মণ পর্যন্ত সেমাই তৈরি করা হয়। কাঁচামাল হিসেবে থাকে প্রতি বস্তা ময়দা (৭৪ কেজি), মূল্য ৪ হাজার টাকা। ডালডার দাম কার্টন প্রতি (১৬ কেজি) ২ হাজার ৯০০ টাকা। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সেমাইয়ের দামও বেড়েছে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
যেভাবে তৈরি হয় সেমাই
এখন প্রায় সব কারখানায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেমাই তৈরি হয়। এরপর প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করেন ব্যবসায়ীরা। প্রথমে সরু ফালি করে ময়দার মণ্ড কেটে রাখেন কারিগররা। সেগুলো গোলাকার করার পর লাচ্ছার খামি বানানো হয়। তেল ও ডালডা দিয়ে ভাজলে হয়ে যায় সেমাই। তারপর তেল ঝরাতে স্তূপ করে রাখা হয় কারখানায়। ঝরে পড়া গরম তেল আবারও চুলায় ঢেলে ভাজা হয় খামি।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
কারিগর-শ্রমিকদের কথা
ঈদ উপলক্ষে উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কারখানা। রমজানের কিছুদিন আগে থেকে এই পেশায় যুক্ত হয় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। ঈদ ঘনিয়ে এলে তাদের ব্যস্ততা বাড়ে। প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক মেলে। প্রতিষ্ঠান ভেদে কেউ কেউ বেতনভুক্ত হিসেবে কাজ নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে মাত্র দুই মাস ব্যস্ত থাকেন সেমাই কারখানার শ্রমিকরা। বছরের বাকি সময় বিস্কুট, চানাচুরসহ অন্যান্য কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
মৌসুমী ব্যবসায়ী
রাজধানীতে শতাধিক কারখানায় সেমাই তৈরি করা হয়। অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী সেমাই প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। তাদেরই একজন অ্যারাবিয়ান সুইট অ্যান্ড ফুড প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী হাফেজ মো. শাহ আলম। তার সেমাইয়ের কারখানা ঠাটারি বাজারের বি.সি.সি. রোডে। তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, করোনার পর ব্যবসা ভালো যাচ্ছে। চাঁদরাতের পরই ব্যবসা গুটিয়ে নেন তিনি।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
তিন মাস বেচাকেনা
একসময় সারাবছর সেমাই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন কেবল তিন মাস সেমাই বেচাকেনা হয়ে থাকে। রোজার ঈদের আগে দুই মাস ও কোরবানির ঈদের সময় এক মাস সেমাইয়ের চাহিদা থাকে। রমজান মাস এলে সেমাই তৈরির তোড়জোড় দেখা যায়। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এবারও সেমাই তৈরির ধুম পড়েছে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
বাড়িতেই সেমাই তৈরির কারখানা
পুরান ঢাকার ওয়ারী ভজহরি সাহা স্ট্রিট, কামরাঙ্গীরচর হারিকেন গলির সামনে মাজার রোড এবং দয়াগঞ্জে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে সেমাই তৈরির অস্থায়ী কারখানা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের আঁধারে এগুলোতে সেমাই উৎপাদন হয়। পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতকে কৌশলে ফাঁকি দিতে এই পন্থা বেছে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
সুরক্ষা ব্যবস্থার বালাই নেই
৭/৪ করাতিতোলা দয়াগঞ্জে হারুন মোরব্বা ঘর কারখানা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। ময়দার মণ্ড কেটে যারা ফালি করেন এবং খামি বানান, তাদের হাত ও মাথায় কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। তীব্র গরমে কারিগরদের শরীরের ঘাম গড়িয়ে পড়ে ময়দায়। এভাবেই তৈরি হয়ে থাকে দুধরাজ লাচ্ছা সেমাই। পুরান ঢাকার জুরাইন ও মৌলভীবাজার এলাকায় বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসায়ী এসব বিক্রি করে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
যন্ত্রের মাধ্যমে খামি
হারুন মোরব্বা ঘর কারখানায় দেখা গেল, শ্রমিকরা হাত দিয়েই খামি এদিক-ওদিক করছেন। তাদের পোশাক ও চারপাশের নোংরা পরিবেশ দেখে বাজার থেকে কেনা সেমাই কতটা স্বাস্থ্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। যদিও ঢাকার বেশিরভাগ কারখানায় এখন যন্ত্রের মাধ্যমে খামি করা হয়। সেমাই তৈরির এমন একেকটি যন্ত্রের দাম দেড়-দুই লাখ টাকা। মফস্বলে এখনও খামি তৈরির জন্য ময়দাকে পা দিয়ে মাড়ানোর কথা শোনা যায়।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
যে কারণে বন্ধ অসংখ্য কারখানা
সেমাই উৎপাদনের অধিকাংশ কারখানার বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-র অনুমোদন নেই। ঢাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার লোভে মানহীন সেমাই তৈরিতে ময়দায় মিশিয়ে দেয় রঙ ও বিষাক্ত রাসায়নিক। তাছাড়া যত্রতত্র গড়ে ওঠা সেমাই কারখানায় নিম্নমানের পাম অয়েল ও ডালডা ব্যবহারের অভিযোগ তো পুরোনো। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের কারণে অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
ক্রেতাদের ভাবনা
কেনাকাটার সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই উৎপাদনের ব্যাপার নিয়ে ভাবে না বেশিরভাগ ক্রেতা। তাদের কথায়, ঈদে অতিথি আপ্যায়নে সেমাইয়ের বিকল্প নেই। জুরাইন এলাকার একজন প্রবীণ ক্রেতা ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘খেতে তো হবে। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের তো ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজির লাচ্ছা সেমাই কেনার সামর্থ্য নেই।’’
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
ঘি নয়, ডালডা...
খোলা লাচ্ছা সেমাই বিক্রির ক্ষেত্রে দোকানিরা ‘ঘিয়ে ভাজা’ কথাটি উল্লেখ করে থাকেন। এতে করে বিক্রি হয় বেশি। আদতে পাম অয়েল ও ডালডা ছাড়া সেমাই তৈরিতে অন্য কিছু ব্যবহার করা হয় না।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
টুকরি টুকরি সেমাই
ঢাকায় একেকটি পাইকারি দোকানে প্রতিদিন ১০-২০ মণ সেমাই বিক্রি হয়। একেকটি টুকরিতে ৩৭ কেজি লম্বা সেমাই থাকে। এর মূল্য ১ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকা। প্রতি টুকরিতে ২০ কেজি লাচ্ছা সেমাই থাকে। বর্তমানে এক টুকরি লাচ্ছা সেমাই ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
সুদৃশ্য বাক্সে সেমাই
পুরান ঢাকার চকবাজারে সুদৃশ্য বাক্সে সেমাই বিক্রি হয়। আলাউদ্দিন সুইটমিটে প্রতিদিন কারখানা থেকে পাঁচ থেকে আট মণ সেমাই আসে। ৫০০ গ্রাম লাচ্ছা সেমাই ১৪০ টাকা, ২০০ গ্রাম বাংলা সেমাই ৪০ টাকা। লাচ্ছা স্পেশাল ৫০০ গ্রাম ২৮০ টাকা এবং ১ কেজির দাম ৫০০ টাকা। জাফরান, কাঠবাদাম, চেরি ফল, খেজুর, কিশমিশ দিয়ে বানানো আনন্দ বেকারির ভিআইপি লাচ্ছা সেমাই ৫০০ গ্রামের দাম ৮০০ টাকা।
-
সেমাইয়ের গল্প শুনি
হরেক রকম সেমাই
ঢাকাসহ সারাদেশে প্যাকেটজাত লম্বা সেমাই এবং লাচ্ছা সেমাই পাওয়া যায়। বনফুল, অ্যারাবিয়ান, কুলসম, অলিম্পিয়া, বোম্বে, প্রাণ, কিষোয়ান, ওয়েল ফুড, ফুলকলি ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই বেশি চোখে পড়ে। প্রতি কেজি খোলা বাংলা সেমাই ৬৫ থেকে ৭০ টাকা এবং খোলা লাচ্ছা সেমাই ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের ১৮০ থেকে ২০০ গ্রামের প্যাকেট পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।
লেখক: জনি হক
সার্বিক বিকিকিনির বিষয়ে সৌমিকের ভাষ্য হলো: ‘‘গত দুই বছর মানুষ খুব কমই ঘরের বাইরে গিয়ে কেনাকাটা করতে পেরেছে৷ একটা হাঁপ ধরা অবস্থা ছিল৷ এবার সে অবস্থা কেটে গেছে৷ মানুষ দোকানপাটে গিয়েছে, ঘুরেছে, পছন্দ করে কাপড় কিনেছে, প্রিয়জনদের উপহার দিয়েছে৷ অনলাইন কেনাকাটার ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে গেছে৷ পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় আয়-উপার্জনও কম-বেশি বেড়েছে৷ সবমিলিয়ে বেচাকেনা মোটামুটি একটা ভাল জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে৷’’
পোশাকের মধ্যে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, লুঙ্গিসহ বাহারি জামা, জুতা থেকে শুরু করে প্রসাধন সামগ্রী বিক্রির ধূম লক্ষ্য করা গেছে৷ এই সময়ে গাড়ি ও মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে, বেড়েছে ইলেকট্রনিক্স পণ্যের বিক্রি৷ ঈদের খাদ্যপণ্যের মধ্যে সেমাই ও পোলাওর চালের বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ৷
এবারের ঈদের দীর্ঘছুটিতে সুন্দরবন ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলোয় বেড়াতে গেছেন প্রচুর মানুষ৷ এটি দেশীয় পরযটনখাতকে চাঙ্গা করায় বড় ভূমিকা রেখেছে৷ পরযটন ও বিমান চলাচল বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলমের পরযবেক্ষণ হলো, ঈদের ছুটিকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ পরযটন ব্যবসা যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা প্রায় কোভিড-পূর্ব সময়ের মতো হয়েছে৷ এই লেখকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতাও অনেক বেড়েছে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় বা শিথিল করায়৷ আবার সৌদি আরব রামাদান মাসে উমরাহ পুরোপুরি উম্মুক্ত করে দিয়েছে এবং সাওয়াল মাসের মাঝামাঝি পযরন্ত তা বহাল রেখেছে৷ ফলে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ সৌদি আরব গিয়েছেন এখনোও যাচ্ছেন৷ আবার কোভিডের কারণে গত দু'বছর দেশে আসতে পারেননি এমন বহু প্রবাসী-বাংলাদেশি এবার দেশে এসেছেন আপনজনদের সাথে ঈদ করেছে৷’’
আসজাদুল কিবরিয়া, দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক
বস্তুত ঈদকেন্দ্রিক অর্থনীতি বাংলাদেশে এতোটাই বৈচিত্র্যময় হয়েছে যে প্রায় সংশ্লিষ্ট সবখাতই এখানে কম-বেশি ব্যবসা করেছে৷ আর খুচরা ও পাইকারী ব্যবসা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশ জোগান দেয় যা টাকার অংকে গত অর্থবছর ছিল প্রায় চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা৷ যদি দোকান মালিক সমিতির প্রাক্কলন বিবেচনা নেয়া হয়, তাহলে ঈদের সময়ই এর ৪০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে৷ ফলে চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়৷ বিবিএসের হিসেব অনুসারে গত ২০২০-২১ অর্থবছর যেখানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ, সেখানে সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ৷ বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছে যে এবছরও প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নিচে থাকবে৷ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্ব বাণিজ্যের গতি কমা এবং জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা স্পষ্ট৷ এমন অবস্থায় ঈদকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তেজীভাব ও দেশজ ভোগব্যয় বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিময়তা ধরে রাখায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে৷ কেননা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুলাংশেই চালিত হয় ভোগব্যয় দ্বারা, যদিও আয়ের বৈষম্যের কারণে ভোগব্যয়েও যথেষ্ট বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়৷
ঈদের দিন ঢাকা শহরের চিত্র যেমন ছিল...
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
ঈদের চাঁদ ওঠার আনন্দ
৩০ দিন সিয়াম সাধনার পর গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় ঈদ-উল-ফিতরের চাঁদ দেখা গিয়েছে৷ সন্ধ্যা নামতেই ঢাকার আকাশে আতসবাজি ফাটিয়ে ঈদ উদযাপন শুরু হয়৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
একসঙ্গে নামাজ
ঢাকার প্রধান দুই জামাতস্থল বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদ্গাহে সেখানে মুসল্লিরা ঈদের নামাজ আদায় করতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপস্থিত হন৷ করোনার বিধিনিষেধ না থাকায় এবারের জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
ঈদের নামাজে মুসল্লিদের ঢল
ঢাকার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এবং হাইকোর্টস্থ জাতীয় ঈদ্গাহে একাধিক জামাতে লাখো মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন৷ সকাল থেকেই ঈদের নামাজে আসা মুসল্লিদের চাপ সামলাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়েছে৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
নামাজের সময়সূচি
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে ঈদ-উল-ফিতরের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৭টায়৷ এরপর ধাপে ধাপে সকাল পৌনে ১১টা পর্যন্ত পাঁচটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়৷ এছাড়া জাতীয় ঈদ্গাহে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় সকাল সাড়ে আটটায়৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
দুই বছর পর জাতীয় ঈদ্গাহে নামাজ
করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরের চারটি ঈদ লকডাউনের মধ্যে পড়েছিল৷ সামাজিক দূরত্ব এবং বিধিনিষেধের কারণে হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদ্গাহে ঈদের কোনো জামাত অনুষ্ঠিত না হলেও এবার নামাজের আয়োজন করা হয়েছে৷ এবার জাতীয় ঈদ্গাহ ময়দানে প্রায় ৩৫ হাজার মুসল্লিদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
স্বস্তির ঈদ
জাতীয় ঈদ্গাহে ছেলেসহ দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় পরে ঈদের নামাজ পড়তে এসেছেন পেশায় আইনজীবি মোঃ শিপু কাজী৷ তিনি বলেন, ‘‘করোনার কারণে মানুষ এতদিন নিঃশ্বাস আটকে রেখেছিল৷ আমরা কেউ কারো বাসায় ঘুরতে যেতে পারতাম না৷ দুই বছর পর এই স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকু আমাদের জন্য বিরাট পাওয়া৷’’
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
নারীদের জন্য নামাজ পড়ার পৃথক ব্যবস্থা
হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদ্গাহ ময়দানে নারীদের জন্য পৃথক নামাজের ব্যবস্থা ছিল৷ সেখানে একসঙ্গে প্রায় তিন হাজার নারীর নামাজের ব্যবস্থা ছিল৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
করোনা থেকে মুক্তিলাভের দোয়া
ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লিদের অনেকেই নামাজ শেষের দোয়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ কী দোয়া করলেন জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘করোনার কারণে গত ২ বছর মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হয়েছে৷ এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেরই প্রিয়জন মারা গিয়েছে৷’’ তাই আল্লাহর কাছে তার দোয়া, করোনা থেকে যেন সবাইকে মুক্তি পায়৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
কঠোর নিরাপত্তা
লকডাউন অথবা করোনার বিধিনিষেধ এবার না থাকলেও জাতীয় ঈদ্গাহ এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তৎপরতা দেখা গিয়েছে৷ পুলিশ এবং র্যাব একাধিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নজরদারি করেছে এবং র্যাবের একাধিক হেলিকপ্টার আকাশে উড়তে দেখা গিয়েছে৷ পুলিশের পক্ষ থেকে মুসল্লিরা যেন জায়নামাজ এবং ছাতা ছাড়া আর কিছু সঙ্গে না আনেন সে ব্যাপারেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
‘আমগোরে কিছু সালামি দিয়া যান’
ঢাকার পল্টন মোড়ে গিয়ে দেখা যায় সড়ক বিভাজকের উপর কয়েকজন গৃহহীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন৷ প্রতিবেদককে দেখে সেখানে বসবাসকারী মোঃ জসিম নামের একজন বলেন, ‘‘আপনেরা তো বেতন-বোনাস পাইসেন, আমগোরে কিছু সালামি দিয়া যান৷ এই ঈদে আমরা কিছু পাই নাই কারো থেকে৷’’ পেশা জানতে চাইলে তারা বলেন, রাস্তা থেকা কাগজ-প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করেন ওই ব্যক্তিরা৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
ভিক্ষুক বেড়েছে
ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ আদায় করতে গিয়ে জাতীয় মসজিদ ও ঈদ্গাহসহ বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শত শত ভিক্ষুক হাত পাতছেন৷ মোঃ তারেক আমিন নামের একজন মুসল্লি ভিক্ষুকদের ব্যাপারে প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘সম্প্রতি ভিক্ষুকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে৷’’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘করোনার ফলে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, তাছাড়া জিনিসপত্রের যা দাম, মানুষ বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়েই রাস্তায় নামছেন৷’’
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
ঝড়-বৃষ্টি
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, ঈদ-উল-ফিতরের দিন সকালে বৃষ্টি এবং কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে৷ ভোর থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল৷ সকাল নয়টায় হালকা বৃষ্টি শুরু হয়৷ পরে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ মুষলধারে বৃষ্টি হয়৷ নামাজ শেষে অথবা নামাজে এসে অনেক মুসল্লিই বৃষ্টিতে ভিজে যান৷
-
ঈদ উৎসবে শহর ঢাকা
একসঙ্গে ঘোরা
ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের লেডিস ক্লাব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সকালের ফিরনি-সেমাই খাওয়ার পর ঘুরতে বেরিয়েছেন তিন ভাই-বোন৷ কোনো অভিভাবক ছিল না তাদের সঙ্গে৷ কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে আসমা, জাকারিয়া এবং স্বপ্না বলেন, ‘‘আমাদের বাসা এই এলাকায়৷ বেশি দূর যাব না৷ এই বড় রাস্তা পর্যন্ত ঘুরেই বাসায় চলে যাব৷ বাবা বলেছে বিকালে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে৷’’
লেখক: মর্তূজা রাশেদ (ঢাকা)