ঈদের আগে গাড়িভাড়ায় নৈরাজ্য
৯ এপ্রিল ২০২৪নির্দিষ্ট ভাড়ার কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছেন না কেউ। একই পরিস্থিতি লঞ্চের ক্ষেত্রেও।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি আশঙ্কা করেছিলো এবার ঈদের আগে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় করবে বিভিন্ন যানবাহন। তবে সংগঠনের মহাসচিব মঙ্গলবার বলেন, "এখন যা পরিস্থিতি দেখছি তাতে এর পরিমাণ আরো বেশি, ২০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।”
ঘরমুখো যাত্রীদের অভিযোগ
মানবাধিকার কর্মী নুরুল ইসলাম ঢাকায় থাকেন। দুইদিন আগেই কাজে গাজীপুর গিয়েছেন তিনি। সেখান থেকে মঙ্গলবার বগুড়া যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি ঈদ করতে। বিকেল চারটার দিকেও তিনি নিশ্চিত নন যে যেতে পারবেন কীনা। তিনি বলেন, "৫০০ টাকার ভাড়া এক হাজার টাকা চাচ্ছে। ট্রাকে করে ২৫০ টাকায় যাওয়া গেলেও এখন চাচ্ছে ৫০০ টাকা। পোশাক কর্মীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে।”
এই পরিস্থিতি দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ তার। তিনি বলেন, "বাস কাউন্টারের লোকজনের কথা, এই ভাড়ায় গেলে যান, না গেলে না যান।”
মহাখালী বাস টার্মিনালে পোশাক শ্রমিক মো, ইমন তার পরিবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন ময়মনসিংহ যাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, "২০০ টাকার ভাড়া চাইছে ৬০০ টাকা। আজকেই ঈদ যাত্রীদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। তারা যার কাছ থেকে যা পারছে আদায় করে নিচ্ছে। আমরা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছি। মনে হচ্ছে যা বেতন বোনাস পেয়েছি তা বাস ভাড়াতেই শেষ হয়ে যাবে।”
চায়না বেগম যাবেন সায়েদাবাদ থেকে বরিশাল। তিনি বলেন, "বরিশালের ভাড়া চাইছে ৮০০ টাকা। এটা প্রায় দুই গুণ।”
শ্রমিক নেতা যে পরিস্থিতির কথা জানালেন
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকন বলেন, "মহাখালী বাসস্ট্যান্ড খেকে ঢাকা-ময়মনসিংহের ভাড়া ৩০০ টাকা। সেখানে এখন নেয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশালের ভাড়া ৫০০ টাকা, নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলের ভাড়া ২০০ টাকা, নেয়া হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকা। ঢাকা-কুমিল্লা রুটে বাস বেশি থাকলেও ঈদের অজুহাতে ১০০ টাকা করে বেশি রাখা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, "জেলা থেকে জেলায় বাস ভাড়ায় আরো বেশি নৈরাজ্য চলছে শেষ সময়ে। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের ভাড়া ৮০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। এটা দুই গুণ। প্রতিটি রুটেই ঈদ উপলক্ষে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নতুন ট্রেনের কারণে বাসগুলো সেখানে সুবিধা করতে পারছে না।”
তিনি জানান, "যারা আগেই বাসের টিকিট কেটে রেখেছেন তারা স্বস্তিতে আছেন। ওইসব পরিবহণে তো এখন আর টিকিট নাই। কিন্তু যারা আগে টিকিট কাটেননি, শ্রমজীবী, পোশাক শ্রমিক, নিম্ন আয়ের মানুষ, তারা পড়েছেন বিপাকে। লঞ্চেও ঈদ বখশিশের নামে ভাড়া কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।”
মহাখালীর ঈগল পরিবহণের কাউন্টার ম্যানেজার মিলন মিয়া বলেন, "শেষ সময়ে যাত্রী বেশি, বাস কম। তাই ভাড়া একটু বেড়েছে। আর এই সময়ে ভাড়া বাড়বে এটা তো সাধারণ নিয়ম, তারপরও টিকিট দিতে পারছি না।”
চন্দ্রা পরিবহণের কাউন্টার ম্যানেজার আব্দুল হালিমও জানালেন একই পরিস্থিতির কথা। তিনি বলেছেন, "শেষ সময়ে সবাই এক যোগে বাড়ি ছুটছে। তাই ভাড়া একটু বেশি।”
ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে পুলিশ থাকলেও বাসের কর্মচারীরা তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে যুগ্ম কমিশার মো. মেহেদী হাসান বলেন, "বাড়তি ভাড়া আদায় করলে বিআরটিএর মোবাইল কোর্টের তা দেখার কথা। তবে আমরাও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিই। আর যাত্রীরা সরাসরি ৯৯৯-এ ফোন করতে পারেন।”
তবে ঢাকার কোনো বাস টার্মিনালেই বিআরটিএর মোবাইল কোর্টের দেখা মেলেনি।
বাড়তি ভাড়ার পরিমাণ কত?
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি দুই দিন আগে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলো, ঈদ যাত্রায় বিভিন্ন পরিবহণে ৯৮৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হবে। তারা তাদের পর্যবেক্ষণে যাত্রী প্রতি ২০০ টাকা অতিরিক্ত আদায়ের চিন্তা করে ওই হিসাব দিয়েছিলো। কিন্তু মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, "আমাদের ধারণার চেয়ে বাস্তবে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আমাদের হিসাব ছিলো ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত। এখন যাত্রীর চাপ একদিনে অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভাড়ার নৈরাজ্য কোনো হিসাবেই মেলানো যাচ্ছে না। আমার বাসার সামনে সাইনবোর্ড (নারায়ণগঞ্জ) থেকে নরসিংদীর ভাড়া ৮০ টাকা। আজকে (মঙ্গলবার) সকালে নিয়েছে ৫০০ টাকা।”
তিনি বলেন, "লঞ্চেও একই অবস্থা। এমনিতে লঞ্চে যাত্রী কমলেও ঈদের সময় ৬০ লাখ যাত্রী লঞ্চে ঢাকা ছাড়ছেন বলে আমাদের পর্যবেক্ষণ। অর দুই হাজার ৫০০ ধারণ ক্ষমতার লঞ্চ এখন সাত হাজার যাত্রী বহন করছে। ঢাকা বরিশাল রুটে লঞ্চের ডেকের ভাড়া ৪০০ টাকা ভাড়া হলেও আজকে (মঙ্গলবার) ৬০০-৮০০ টাকা করে নেয়ার তথ্য পেয়েছি। ঢাকা-ভোলা রুটে ভাড়া ছিলো ৪৫০টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৮০০ টাকা।”
তিনি বলেন, "আমাদের হিসাবে আজকে এক দিনে কমপক্ষে ৪০ লাখ যাত্রীর চাপ পড়ায় যানবাহনের মালিকেরা এই সুযোগ নিচ্ছে। এমনকি মোটরবাইক রাইডের ভাড়াও বেড়ে গেছে। তারা এক হাজার টাকার নিচে কোনো ট্রিপ নিচ্ছে না।”
বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "ঈদে লঞ্চের ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ কাল্পনিক। আমরা সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে এক পয়সাও বেশি নিচ্ছি না। এমনিতিই লঞ্চের যাত্রী অনেক কমে গেছে। সাধারণভাবে তাই যাত্রী আকর্ষণে স্বাভাবিক সময়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম নেয়। এখন সরকার নির্ধারিত ভাড়াই নেয়া হচ্ছে।”
আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, "ঈদে যাতে বাড়তি ভাড়া কেউ না নেয় এজন্য মালিক সমিতি তৎপর আছে। কেউ বাড়তি নিলে পুলিশ বা আমাদের মালিক সমিতির কাছে অভিযোগের অনুরোধ করছি।”