নারী অধিকার
২৪ ডিসেম্বর ২০১১সমকামীদের সম্পর্কে এখন বলা হয়, তাদের অনুভূতি প্রকাশে কোনো বাধা থাকা উচিত নয়৷ কিন্তু কেউ যদি বলে, আমরা আমাদের ধর্মের রীতি নীতিও প্রকাশ করতে চাই, তাহলে সবাই এক বাক্যে ‘না' বলে উঠবে৷ কয়েক বছর আগে ফ্রান্স ও ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশে হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর এটা ছিল সারাহ বেনখেরা-এর উত্তর৷ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত এক জার্মান তরুণী সারাহ৷ পরেন খিমার, এক ধরনের আপাদ মস্তক ঢাকা কোট৷
সারার বান্ধবীদের অবশ্য তার সঙ্গে বন শহরের সুপার মার্কেটে ঘুরে বেড়াতে কোনো অসুবিধা হয়না৷ সদ্য ২০ পার হওয়া আর দশটা মেয়ের মতই জিনস ও পুলওভার পরা মেয়ে তারা৷
ইউরোপের বহু দেশের আইন কানুনে কিন্তু পোশাক আশাকের ব্যাপারে এই ধরনের সহনশীলতা প্রকাশ পায় না৷ ফ্রান্সে হিজাব পরা নিষেধ করা হয়েছে, এই কারণ দেখিয়ে যে, এই প্রথা মেয়েদের দমন করার বহিঃপ্রকাশ৷ জার্মানিতে স্কুলে ও অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা নিষেধ করা হয়েছে৷ সম্প্রতি বেলজিয়ামে আইন প্রণয়নের জন্য একটি বিল আনা হয়েছে, যাতে প্রকাশ্য স্থানে হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির কথা বলা হয়েছে৷
ইউরোপীয় সরকাররা এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেখান এই বলে যে, হিজাব পরার মাধ্যমে ইউরোপীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ততার প্রতি অনীহাই প্রকাশ পায়৷ আসল কথা হল, অনেক ইউরোপীয় হিজাবকে বিরক্তিকর মনে করেন৷
তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান তরুণী সাদিয়া বিলিচিও লক্ষ্য করেছেন যে, হিজাব তাঁর জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ আমি জার্মানিতে কোনো চাকরি খুঁজে পাইনি৷ অনেক জার্মান প্রশ্ন করেছেন, কেন আমি হিজাব পরি৷''
সব মুসলিম নারীই যে হিজাব পরার পক্ষে তা নয়৷ ডয়চে ভেলের সাংবাদিক পারওয়ানে আলিজাদা মনে করেন, ইসলাম বলেছে কোনটা সঠিক, কোনটা নয়৷ হিজাব পরা বা না পরা একান্তই তাঁর সিদ্ধান্ত৷ কোনো কিছুতেই ধর্ম তাঁকে বাধ্য করেনি৷
আত্নপরিচিতির প্রশ্ন
সারাহ জানায়, সে পরিবারের বিরুদ্ধে অনেকটা বিদ্রোহ করে খিমার পরার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তার এই পোশাক তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে৷ সারাহর ভাষায়, ‘‘আমি আমার জীবনের অর্থ নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করি৷ তারপর প্রার্থনা শুরু করি, আমার মনে হতে থাকে, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেই থেকে আমি খিমার পরা শুরু করি৷'' সারাহ আত্মপোলব্ধি থেকে খিমার পরা শুরু করলেও হিজাব পরা সব মেয়ের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য নয়৷
সাদিয়া বিলিচিকে হিজাব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করেন তিনি৷ সাদিয়া তুর্কি বংশোদ্ভূত, ১৩ বছর ধরে জার্মানিতে বসবাস করছেন৷ তাঁর পরিবার সারাহর পরিবারের মত নয়৷ সাদিয়ার পরিবারের সব মেয়েই হিজাব পরেন৷ অবশ্য তিনি জানান, নিজের ইচ্ছাতেই হিজাব পরছেন তিনি, পরিবার তাঁকে বাধ্য করেনি৷
হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা?
জার্মানিতে জন্ম নেয়া আরেক মুসলিম মেয়ে জানান, তিনি হিজাব পরেন, যেহেতু এটি আল্লাহর আইন এবং সব মুসলিম মেয়ের এই আইন মেনে চলা উচিত৷ হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে জার্মানিতে বসবাস করতে চাননা তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এরকম হলে আমি জার্মানি বা ইউরোপে থাকবনা৷ জার্মানি ছেড়ে আমি এমন কোনো দেশে যাব, যেখানে আমার হিজাব পরার অধিকার থাকবে৷''
শুধু পশ্চিমের দেশগুলিতেই হিজাব বিতর্কিত বিষয় নয়৷ নয়া দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্রী উজমা ফালাকও হিজাব পরা নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন৷ হিজাব শব্দটি বহু অপব্যবহৃত শব্দ৷ তিনি লক্ষ্য করেছেন, ‘‘বন্ধু বান্ধব ও সমাজের অন্যান্যরা হিজাব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷ ভিন্ন সংস্কৃতির কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তারা অদ্ভুতভাবে তাকায়, প্রশ্ন করে কেন আমি এটা পরি, কেউ কেউ শুধুই কৌতূহলী হয়৷''
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হিজাব সম্পর্কে কোনো আইন নেই৷ শ্রীনগরের জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাংকের শাকিরা নবি বলেন, ‘‘হিজাব এমন একটা জিনিস, যা পরতে বা না পরতে কেউ বলেনা৷ এটা তোমার জীবন, তুমিই সিদ্ধান্ত নেবে হিজাবের ব্যাপারে কী করবে৷''
হিজাব নিয়ে উভয় সংকট
বন ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর সাবিনে ডামির গাইল্সডর্ফ এ কথা সমর্থন করে বলেন, ‘‘বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে হিজাব পরায় গুরুত্ব দেয়া হয়৷ আরব দেশগুলিতে হিজাব পরা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার৷ কিন্তু এটা ভয়ংকর, যখন মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়৷ তবে একথাবলা যায়না যে, সব সময় পুরুষরা, পরিবার বা সমাজই মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করে৷''
বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা ড. শিরিন আমির মোয়াজামি মনে করেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের মত ধর্ম নিরেপেক্ষ দেশে নিজেদের ধর্মীয় সত্তাটা প্রকাশ করার জন্যই অনেক মেয়ে হিজাব পরেন৷
অন্যদিকে গাইলসডর্ফের মতে, হিজাব পরা মানেই নিপীড়ন বা ধর্মীয় চরমপন্থা বোঝায় না৷ তবে কিছু বাস্তব অসুবিধার কথা তুলে ধরেন তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ইউরোপীয় দেশগুলির সরকারদের এক্ষেত্রে কিছু কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়৷ একদিকে তারা আইনগত কারণে স্কুলে ধর্ম নিরেপক্ষতা বজায় রাখতে চান, অন্যদিকে অনেক মেয়েই হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারে৷''
জার্মানিতে হিজাব পরা নিষেধ করার ব্যাপারে সারাহ বেনখেরা-র এখন পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই৷ তবে হিজাব বিদ্রোহের জন্য কিছু মূল্য তাকে দিতে হয়েছে৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পার্টিতে যেতে পারেনা সে৷ এর জন্য আফসোস নেই সারাহর মনে, ছোটখাট আনন্দের চেয়ে আত্ম-অনুসন্ধান তার কাছে অনেক বড়৷
প্রতিবেদন: বেনিশ আলি ভাট/ রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক