1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইন যখন হিমঘরে থাকে মানুষ তখন আগুনে পুড়ে

সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
সঙ্গীতা ইমাম
৮ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়৷

https://p.dw.com/p/4dJbj
ঢাকার একটি ভবনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন দমকলকর্মীরা
ঢাকার বেইলি রোডে একটি ভবনে ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুন লেগে মারা যান অন্তত ৪৬ জনছবি: Mahmud Hossain Opu/picture alliance/AP

কোনো কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য, আবার কিছু ঘটনার পিছনে থাকে রাজনৈতিক দলের দূরভিসন্ধি ও জনবিরোধিতা৷ এছাড়াও নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থে অবহেলাজনিত কারণে ঘটে অগ্নিকাণ্ডের দূর্ঘটনা৷ প্রতিটি ঘটনাই যারপরনাই বেদনা আর বিভৎসতার অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়৷ তবে ব্যক্তিগত, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী হত্যাযজ্ঞ যেন ভয়াবহতার সবকিছু ছাপিয়ে যায়৷ সম্প্রতি ঢাকার বেইলি রোডের সাততলা রেস্টুরেন্ট ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন অন্তত ৪৬ জন৷ আহত হয়ে বিভিন্ন বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন অসংখ্য মানুষ৷

এ ভবনটি বা এরকম বহু ঝাঁ চকচকে, আলো ঝলমল ভবন আমরা চলতি পথে প্রতিদিনই দেখি ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায়৷ প্রায়শ এমনই কোন ভবনে বন্ধু বা পরিবার নিয়ে খেতে যাই, সময় কাটাতে যাই অথবা কোন উৎসব উদযাপন করি৷ সে সময় কখনো মনেই হয় না এ সুন্দর সাজানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সুরের আবেশ ছড়ানো এ ভবনটি মুহূর্তেই পরিণত হতে পারে একটি মৃত্যকূপে৷

গত বৃহস্পতিবার ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি৷ চার বছর পর পর আসা এ দিনটি উদযাপন করতে অনেকেই বেছে নেন রেস্তোরাঁয় খাওয়া, নানা জায়গায় বেড়ানো৷ মগবাজার, শান্তিনগর, বেইলি রোড, রাজারবাগ, শান্তিবাগ, মালিবাগ, রাজারবাগ এলাকার মানুষজন একটু উদযাপনের জন্য, খাবার জন্য বা নিজেদের বা বছরের বিশেষ দিনটি একসাথে হৈ হৈ করে কাটানোর জন্য যান এই সমস্ত রেস্টুরেন্টগুলোতে৷  তাছাড়া শহরে বেড়ানোর জায়গাই বা কই? প্রেম করতে গেলেও রেস্টুরেন্ট, বন্ধুরা আড্ডা দিবে-তাও সেই রেস্টুরেন্টে খেতে খেতেই৷  পর্যাপ্ত পার্ক নেই, নেই নিরিবিলি কোথাও বেড়ানোর জায়গা৷ এসব রেস্টুরেন্টে যান একটু সুন্দর সময় কাটাতে, তাই তখন আমাদের চোখে পড়ে না যে সিঁড়িটি সরু৷ সেই একমাত্র সরু সিঁড়িতেও নানা আবর্জনা বা দাহ্য গ্যাস সিলিন্ডার রাখা৷ সাধারণ ভোক্তাদের তো জানার কথাও নয় যে সুউচ্চ এ ভবনগুলোতে কোনো অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা আছে কিনা? ফায়ার এক্সিট আছে কিনা? এই ইমারতে রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি আছে কিনা?

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী প্রতিটি মহানগরে এক একটি এলাকা ঠিক করা থাকে আবাসিক বা বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে৷ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খোঁজ রাখবেন, মনিটরিং করবেন-বর্তমানে ভবনগুলোর হাল হক্কিকত কেমন৷ বাণিজ্যিক ভবনগুলোও কোনোটি অফিস, কোনোটি রেস্টুরেন্টের জন্য নির্ধারিত থাকে৷ রেস্টুরেন্টের অনুমতি এবং লাইসেন্স দেয় আবার সিটি কর্পোরেশন৷ এসব রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কাগজপত্র না দেখে যাচাই-বাছাই না করে কীভাবে এসব অনুমতি দিয়ে এতো এতো মৃত্যু আর এতো পরিবারের দুর্দশার কারণ হন, তার ভিতরের খবর আমরা স্পষ্ট না জানলেও অনুমান করতে পারি৷ শুধু অনুমান বললেও ভুল হবে, কারণ বাংলাদেশের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির নমুনা কী প্রকট, আমরা তা জানি৷ কিন্তু যারা এ দুর্নীতিগুলো করে, তারা জানেও না এ দুর্নীতি যে তাদের পরিবারেও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে৷  এ ভাবনা কি আদৌ তাদের মাথায় আসে?

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে ঘটে যাওয়া ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি কর্পোরেশন, ভবন মালিক, রেস্টুরেন্ট মালিক যাদেরই দোষারোপ করি না কেন এই প্রাণগুলো তো আর ফিরে আসবে না৷ আহত হয়ে যাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হয়েছে, তাদের সে ক্ষতি পূরণ হবে না ঠিকই; কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের হতেই হবে৷ যাতে করে ভবিষ্যতে অন্যকেউ এ ধরনের দুর্নীতি করতে গেলে, টাকার বিনিময়ে অবৈধকে বৈধ করে এমন মৃত্যু ফাঁদ তৈরি করার অনুমতি দিতে বুক কাঁপে৷ তাদের সামনে যেন এ শাস্তির স্পষ্ট নজির থাকে৷

এই মৃত্যুকূপটি এক পরিবারের পাঁচ জনকে গ্রাস করেছে, যাঁদের চোখে ছিল বিদেশে আবাস তৈরির স্বপ্ন৷ পিতার সামনে তিনটি জ্বলজ্যান্ত সন্তানকে নিথর লাশে পরিণত করেছে৷ মা এবং বোনকে রেস্টুরেন্টের সামনে নামিয়ে পরদিন ভর্তি পরীক্ষা থাকায় বাসায় চলে যায়৷ এরপর দেখে মা ও বোনের ঝলসানো দেহ৷ এমনি আরো কত শত গল্প হারিয়ে গেছে এই অগ্নিকাণ্ডে৷ মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত বড়ো বোন, ছোটো বোন আর কাজিনকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার আগের রাতে খেতে গিয়ে লাশের ব্যাগে স্থান হয়েছে তিনজনের৷ কী অপরাধে এই অসময়ে চলে যেতে হলো এত এত তরতাজা প্রাণ?

বড়ো বড়ো স্থপতিকে বিভিন্ন মিডিয়াতে ইন্টারভিউ দিতে দেখেছি, তারাও বিরক্ত, তারা বলছেন, তাদের করা নকশা বদল করে, তাদের পরামর্শ অমান্য করে বাড়ি মালিকরা ভবন নির্মানে যথেচ্ছাচার করেছেন৷ প্রশ্ন এ কথা কি স্বনামধন্য স্থপতিরা ২৯ তারিখে জেনেছেন? আগে জেনে থাকলে আইনের আশ্রয় নেননি কেন?

কতো যে কর্মচারী ছিল প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্টে৷ তাদের খবর কে রাখছে? আগুনে আটকে পড়া পুত্রের আর্তকণ্ঠের ফোনে বাবা জেনেছেন, সন্তানহারা হতে চলেছেন তিনি৷ কারও হয়ত খবরই করেনি কেউ৷ যে দেহগুলো ডিএনএ টেস্টের জন্য পড়ে আছে, তাদের হয়ত স্বজন নেই বা স্বজনেরা ততটা সচেতন নয়; হয়ত তারা ভাবছেন, শহরে কাজে আছে ভালোই আছে৷

আমার অতি নিকটজন ও তার কন্যা আগুনে দগ্ধ হয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছেন৷ সহকর্মী লুৎফুননাহার করিম লাকী ও তার কন্যা জান্নাতিন তাজরী৷ লাকী সেদিনও ক্লাস করে গেছেন৷ বৃহস্পতিবার, ২৯ শে ফেব্রুয়ারিতে রেস্টুরেন্টে অফার থাকায় ব্র্যাকে পড়ুয়া কন্যাকে নিয়ে বিরিয়ানি খেতে যান৷ ছেলে নামিয়ে দিয়ে যাবার সময় তাকেও ডেকেছিলেন মা৷ ছেলে নামেনি পরদিন ভর্তি পরীক্ষা থাকায়৷ নামেনি ঠিকই কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাটিও আর দেওয়া হয়নি৷ মা ও বোনের লাশ কাঁধে জানাজা ও কবর দেয়ার কাজ করতে হয়েছে তাকে৷ হিমগাড়িতে মা মেয়ের নিথর দেহ যখন স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ালো তখন লাকী আপার সহকর্মী আর ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের আর্ত কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে বেদনা বিধুর এ পরিবেশ অবহ৷ চার জন সদস্যের একটি পরিবারের দুইজন চলে গেলেন আকাশের ঠিকানায়৷ বাকি ২জনের পরিবারটির অবস্থা কি অনুমান করতে পারি আমরা৷ আমাদের প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন আলিশার বড়ো বোন এ প্রতিষ্ঠানেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফওজিয়া আফরিন, এখন মালয়েশিয়ায় পড়াশুনা করেন৷  ফিরে চলে যাবে তাই বোন আর কাজিনকে নিয়ে একটু আনন্দময় সময় কাটাতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে এলেন ঘরে৷

কেবল বেইলি রোডের ঘটনাই নয়, এখনও ঢাকা শহরের বুকে জমে আছে নিমতলী ট্র্যাজিডির ভয়াবহ ক্ষত৷ ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চকবাজারে রাসায়নিক গুদামে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল, সে সময়েই নানা আলোচনা হয়েছিল, সরকার রাসায়নিক গুদাম সরানোর নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল৷ কিন্তু আজ পর্যন্ত সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো হদিস নেই৷ পুরান ঢাকা এখনও মৃত্যুকূপই হয়ে আছে৷ একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল৷ সে সময়ও ভবন নির্মাণের নীতিমালাসহ নানা বিষয় আলোচনায় এসেছিল৷ কিন্তু কোনো কিছুরই কোনো বাস্তবায়ন হয়নি৷ এখন বেইলি রোডের ঘটনায় আবারও সামনে এসেছে নীতিমালা ও অনুমোদনের কথা৷ সরকারের তোড়জোড় শুরু হয়েছে৷ কিন্তু কবে আবার তা মিলিয়ে যাবে, আমরা জানি না৷

এত মৃত্যুর দায় নিতেই হবে প্রশাসনকে৷ শুধু সৎকারের আর চিকিৎসার খরচ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না৷ দায় এড়াতে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার গ্রেফতার আর রেস্টুরেন্টে সাময়িক সিল গালাও নয় কোনো সমাধান৷ সর্ষের ভিতরের ভুতটা খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় এনে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা না ঘটার নিশ্চয়তা দিতে হবে৷ আর প্রশাসনকে করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত৷ কারণ দুর্নীতির কারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে চলেছে৷

সঙ্গীতা ইমাম, শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
সঙ্গীতা ইমাম বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মী
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য