মহম্মদ আখলাখকে মনে আছে? উত্তরপ্রদেশের ওই ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে ফ্রিজ খুলে যখন মাংস পরীক্ষা করছে একদল জনতা, তখনো তিনি জানতেন না, এর পরিণতি কী হতে চলেছে! জানতেন না রাস্তায় টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হবে। তার অপরাধ, ফ্রিজে সন্দেহজনক মাংস।
আখলাখ একা নন, ভারতের কোনো না কোনো রাজ্যে কম-বেশি প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ঠিক এভাবেই মার খাচ্ছেন জনতার হাতে। কেউ মারা যাচ্ছেন, কেউ বা মরার মতো বেঁচে থাকছেন। যারা মার খাচ্ছেন, তাদের কেউ ছিচকে চোর, কেউ নেশাখোর, কেউ স্রেফ সন্দেহজনক, কেউ বা রাজনৈতিক বিরোধী। ক্ষমতাবান জনতা আইন হাতে তুলে নিয়ে বিচার এবং শাস্তির নিদান দিচ্ছে রাস্তাতেই।
মাত্র কয়েকমাস আগে কলকাতায় কিছু কলেজের ছাত্র মোবাইল চোর সন্দেহে ঠিক এভাবেই পিটিয়ে খুন করেছিল এক ব্যক্তিকে। যে ঘটনার বিবরণ পড়তে পড়তে মনে পড়ছিল ছোটবেলায় দেখা এক দৃশ্য। স্কুলের জানলা দিয়ে দেখতে হয়েছিল এক সিঁধেল চোরকে গণপ্রহার। স্কুলের দেওয়ালের পাশে লাইটপোস্টে বেঁধে শখানেক মানুষ পেটাতে পেটাতে অজ্ঞান করে দিয়েছিল তাকে। তারপর সেই সংজ্ঞাহীন শরীর চ্যাংদোলা করে তুলে ফেলে দিয়েছিল পাশের পুকুরে।
আশ্চর্য হতে হয়েছিল ওইদিন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির আমার অধিকাংশ সহপাঠীর আচরণে। ওই চোরকে মারা প্রতিটি মারে উল্লাস অনুরণিত হচ্ছিল স্কুল বিল্ডিংজুড়ে। যেন টেলিভিশনে ডাব্লিউ ডাব্লিউ ই রেসলিংয়ের ম্যাচ চলছে!
রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন প্রণব মুখোপাধ্যায় একটি ভাষণে দেশের মানুষকে সহিষ্ণু হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। দেশজুড়ে একের পর এক গণপ্রহার বা লিঞ্চিং নিয়ে কথা বলতে গিয়েই ওই আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো, বোশিরভাগ মানুষ স্বভাবত অসহিষ্ণু। আইন হাতে তুলে নেওয়া যেন জনতার অভ্যাস। কারণ, এই অভ্যাসের সূত্র সামাজিক ক্ষমতা প্রদর্শন। ডারউইনের তত্ত্বই বলে সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। সমাজে এই ‘ফিট'-এর সংজ্ঞা তৈরি হয় ক্ষমতার পিরামিড মেপে। যার যত বেশি ক্ষমতা, সে তত বেশি শক্তিশালী। গণপ্রহার বা লিঞ্চিং সেই শক্তিপ্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার।
পাশাপাশি আরো একটি সমস্যা আছে। সমাজের দায়ভার জনগণ যাদের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা ক্রমশ অস্বচ্ছ, অনৈতিক ঘুঘুর বাসায় পরিণত হয়ে উঠছে। যে সিস্টেমকে মানুষ অভিভাবকত্বের দায়ুত্ব দিয়েছিলেন, তা আজ দুর্নীতি, অন্যায়ের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যে পুলিশের কাজ প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, সে-ই আজ দলদাসে পরিণত হয়ে অনৈতিক শাসক পোষা লেঠেলবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। দোষীকে ধরা নয়, তাকে আড়াল করাই যেন তার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় বলে, জাস্টিস ডিলেড ইস জাস্টিস ডিনায়েড। দেশের আদালতে লাখ লাখ বিচার অপেক্ষমান যুগ যুগ ধরে।
তাই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বার বার। মানুষ ধরেই নিচ্ছেন, আইনি পথে বিচার মিলবে না। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাৎক্ষণিক বিচারের রাস্তায় যেতে হবে। আর তার সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। মানুষকে আরো খেপিয়ে তুলছে রাজনৈতিক সিস্টেম।
রাজনৈতিক পরিবেশ যতদিন না সুস্থ হবে, এই ভয়াবহতার অভিঘাত ততদিন চলতেই থাকবে, উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। নৃশংসতা আরো নৃশংস হবে।