অযোধ্যায় রামজন্মভূমি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ধন্নিপুর গ্রামে পাঁচ একর জমির উপর গড়ে উঠবে মসজিদ। গত ২৬ জানুয়ারি এই মসজিদ তৈরির কাজ শুরু হলো। মসজিদের জমি উত্তর প্রদেশের ওয়াকফ বোর্ডের। আর মসজিদ তৈরি করবে ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশন(আইআইসিএফ) ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের প্রধান জাফর আহমেদ ফারুকি বলেছেন, ''মাটি পরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নকশা তৈরি হয়ে গেছে। তা অনুমোদনের জন্য গেছে। অর্থ জোগাড়ও চলছে। ২৬ জানুয়ারি গাছও লাগানো হয়েছে।''
আইআইসিএফ যে নকশা তৈরি করেছে, তাতে মসজিদের মূল গম্বুজটি হবে কাচের। বিশাল বাগান থাকবে। থাকবে একটি সুদৃশ্য হাসপাতাল। সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করানো যাবে। এক হাজার মানুষ যাতে খেতে পারেন, তার ব্যবস্থাও থাকবে। মসজিদ চত্বরে একটি সংগ্রহশালাও থাকতে পারে। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া মৌলবী আহমদুল্লাহ শাহের নামে রাখা হতে পারে।
কিন্তু এই মসজিদকে ঘিরে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কোঅর্ডিনেশন কমিটি থেকে শুরু করে অনেক মুসলিম সংগঠনের মত হলো, ইসলাম ও শরিয়ত অনুসারে কোনো মসজিদ বিনিময় করা জমিতে বানানো যায় না। বাবরি মসজিদের বিনিময়ে এই জমি দেয়া হয়েছে বলে তারা দাবি করছেন।
মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য ও অল ইন্ডিয়া বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কোঅর্ডিনেশন কমিটির আহ্বায়ক জাফরইয়াব জিলানি জানিয়েছেন, ওই প্রস্তাবিত মসজিদ ওয়াকফ আইনের বিরোধী। কারণ, মসজিদ বা মসজিদের জমি কখনো বদলাবদলি করা যায় না। শরিয়া আইন অনুসারে তা করা অসম্ভব। এজন্যই মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এর আগে ওয়াকফ বোর্ডকে জমি না নেয়ার অনুরোধ করেছিল।
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
-
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷
কিন্তু আইআইসিএফ ট্রাস্ট এবং ওয়াকফ বোর্ডের বক্তব্য, ধন্নিপুরের জমি মোটেই বদলাবদলি করে পাওয়া নয়। তারা জমির জন্য নয় লাখ ২৪ হাজার টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি উত্তর প্রদেশ সরকারকে দিয়েছেন। আর এই জমি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার দিয়েছে। ফলে বদলাবদলির প্রশ্ন আসে না।
এই বিতর্ককে আরো উসকে দিয়েছেন এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। তিনি বলেছেন, ওই মসজিদ তৈরির জন্য অর্থ দেয়া ও সেখানে নামাজ পড়া হারাম। ইন্দো ইসলামিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের আতহার হুসেন টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে বলেছেন, ''বিশ্বের কোনো জমি হারাম হতে পারে না, এমন কোনো জমি নেই যেখান থেকে নমাজ পড়া যায় না। তাঁর মতে, ওয়েইসি তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুসারে কথা বলেছেন। আমার মনে হয় না, আমাদের হাসপাতাল, যেখানে শয়ে শয়ে মানুষ চিকিৎসা পাবেন, সেটা হারাম।''
জিএইচ/এসজি(পিটিআই, এএনআই)