অভ্র-বিজয় বিতর্কের সুরাহা চায় ব্লগাররা
কম্পিউটারে বাংলা ভাষায় লেখালেখির শুরুটা অনেকের ক্ষেত্রেই বিজয়ের হাত ধরে৷ বিশেষ করে যারা কম করে হলেও এক যুগ ধরে বাংলা লিখছেন, তাদের অধিকাংশই বিজয় কী-বোর্ড লে-আউটে বেশ সাবলিল৷
কিন্তু সেই কম্পিউটারে বাংলা লেখা মানুষগুলো যখন ইন্টারনেটে লিখতে শুরু করলেন, তখন তারা হাতে পেলেন অভ্র৷ যে কিনা নিজেকে যেকোন সাইটে জুড়ে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছে, এমনকি সুযোগ দিচ্ছে বিনা খরচায় ব্যবহারের৷ তাই, ইন্টারনেটে লেখালেখির জন্য খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অভ্র৷ বিশেষ করে বর্তমান বাঙালি ইন্টারনেট প্রজন্ম অনেকটাই নির্ভরশীল অভ্র'র উপর৷
বিপত্তি লে-আউট নিয়ে
তবে বিপত্তি অন্যত্র৷ অভ্র'র একটি কী-বোর্ড লে-আউটের সঙ্গে অনেকটা মিলে যাচ্ছে বিজয়ের লে-আউট৷ আর তাই, বিজয় কী-বোর্ড লে-আউটের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটার্স এর কর্ণধার মোস্তফা জব্বার দাবি করছেন, ‘‘অভ্র নামক যে সফটওয়্যারটি আছে, তাতে বিজয় কী-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করাটা পাইরেসি৷''
যদিও অভ্র'র লে-আউটে কয়েকটি পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো, তারপরও বিজয় আর অভ্র'র এক অংশের লে-আউটের মধ্যে মিল কমপক্ষে ৮০ শতাংশ৷ তবে, এই দুই সফটওয়্যারের নির্মাণ পদ্ধতি এবং ধরণ আলাদা বলে মত অনেকের৷ বিষয়টি নিয়ে অভ্র'র নির্মাতা মেহেদী হাসান খান-এর সঙ্গে কথা বলার জন্য কয়েকবার তাঁর মোবাইলে চেষ্টা করা হলেও, শেষ পর্যন্ত কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি৷ অবশ্য দৈনিক প্রথম আলোতে মেহেদী দিনকয়েক আগেই মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘‘আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের যুক্তি ও অবস্থান তুলে ধরব৷''
সোচ্চার ব্লগাররা
অভ্র-বিজয় নিয়ে এই বিতর্কে সোচ্চার বাঙালি ব্লগাররা৷ কমিউনিটি ব্লগ সাইট কিংবা ব্যক্তিগত ব্লগ – এমনকি ফেসবুক, সর্বত্রই আলোচনার বিষয় অভ্র-বিজয় দ্বন্দ্ব৷ ডয়চে ভেলের সেরা বাংলা ব্লগ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ব্লগার আলী-মাহমেদ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘অভ্র চাচ্ছে ভাষা উম্মুক্ত হোক এবং এর জন্য এরা কেউ টাকা চাচ্ছে না৷ এই সফটওয়্যার ব্যবহার করার জন্য আমার নিজেকে কখনো চোর মনে হবেনা৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষার জন্য, বাংলা ভাষা উম্মুক্ত করার জন্য যে টাকা চাইবে, তাকেই আমি অপছন্দ করবো৷ কারণ অর্থের লালসার কাছে আর যাই হোক, দেশপ্রেম হয়না৷''
একই বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন উপস্থাপক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আব্দুন নুর তুষার৷ এই বিষয়ে ‘সাপ্তাহিক' পত্রিকায় লেখা তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিতর্কও চলছে বেশ৷ ডয়চে ভেলেকে তুষার বলেন, ‘‘একটি সফটওয়্যার ফ্রি অথবা ফ্রি নয়, এটি আসলে তর্কের জায়গাটি নয়৷ আর আমার সহজ যুক্তিটি হচ্ছে, সফটওয়্যার হচ্ছে কলমের মতো, ভাষার পরাধীনতার সঙ্গে সফটওয়্যারের ফ্রি হওয়া না হওয়ার কোন সম্পর্ক নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘যদি সফটওয়্যার দিয়ে বাংলা লিখতে গেলে সেই সফটওয়্যারটি ফ্রি হতেই হবে, এটি আমরা বলি, তাহলে কলম দিয়ে বাংলা লিখতে গেলে, সকল কলম ফ্রি করে দেয়া উচিত৷''
সমাধান চায় ব্লগাররা
এদিকে আলোচনা সমালোচনা যাই থাক, অভ্র-বিজয়ের এই বিবাদ দিনকে দিন জটিল আকার ধারণ করছে৷ তাই, বিষয়টির সমাধানের দিকেই নজর ব্লগার আরিফ জেবতিকের৷ তিনি বলেন, ‘‘অভ্র এবং বিজয় নিয়ে যে তর্কটি শুরু হয়েছে, এটি আসলে আমাদের সকলের জন্যই বিব্রতকর৷ বিশেষ করে ইন্টারনেটে বাংলা লেখালেখির যে ব্যাপক প্রসার হচ্ছে, এই সময়টাতে সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি আমাদের জন্য কাম্য নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘জিনিসটা যেহেতু সরকারের কাছে আছে এবং কপিরাইট অফিস ইতিমধ্যেই মেহেদীকে একটি নোটিশ জারি করেছে, সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় এটি সরকারি পর্যায়েই সমাধান করে ফেলা উচিত৷''
কপিরাইট কার্যালয়
বর্তমানে অভ্র-বিজয়ের এই দ্বন্দ্বের অবস্থান কপিরাইট কার্যালয়ে৷ সংস্থাটি থেকে অভ্র'র নির্মাতাকে পাঠানো নোটিশের জবাব দেয়ার সময় শেষ হচ্ছে ২২শে মে৷ মোস্তফা জব্বার অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘অভ্র বিরুদ্ধে তিনটি আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ আর তাই কপিরাইট রেজিস্ট্রারের সিদ্ধান্ত না মানলে অভ্র'র বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে চান তিনি৷''
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেট-এর ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এই খাতে তরুণ প্রোগ্রামারদের সংখ্যাও৷ তাদের তৈরি বিভিন্ন ছোট ছোট সফটওয়্যারের ব্যবহারও বাড়ছে৷ আর তাই, এদেরকে উৎসাহ প্রদান যেমন জরুরি, তেমনি প্রয়োজন সঠিক দিন নির্দেশনাও৷ কিন্তু অভ্র-বিজয় দ্বন্দ্ব কি তরুণদের এই আগমনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না ?
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ