1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

২০২২ হোক বাংলাদেশের গণমাধ্যমের শিরদাঁড়া সোজা করার বছর

৩০ ডিসেম্বর ২০২১

২০২১ সালটি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক৷ কারণ এ বছর দেশটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে৷ সে হিসেবে বছরটি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷

https://p.dw.com/p/44yzk
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার ২০২১ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP Photo/picture alliance

কিন্তু আসলেই কি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এ বছরটি বিশেষ কিছু? নাকি গত এক দশকে আমরা বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যবস্থার যে অবনমন লক্ষ্য করেছি তারই ধারাবাহিকতায় তথৈবচ সাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ?

২০২১ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা মে মাসে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা এবং গ্রেপ্তার করা৷ এ ঘটনা দেশ ও দেশের বাইরে আলোড়ন তুলেছিল৷ ছয় দিন পর রোজিনা ইসলাম জামিনে মুক্তি পান৷ পরে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামভিত্তিক সংস্থা ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তাকে ‘ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড-২০২১' দেয়৷ রোজিনাকে হেনস্তা ও গ্রেপ্তার বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকের ক্রমাবনতির একটি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল এটি৷

২০২১ সালের ২০ এপ্রিল ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২ তম, ২০২০ সালে যেটি ছিল ১৫১ তম৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, তার ভিত্তিতে ২০০২ সাল থেকে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে৷ ২০১৩ সাল থেকে এই সূচকে বাংলাদেশ আছে৷ তখন বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৪ তম৷ ২০২১ সালের প্রতিবেদনে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার পেছনে৷ সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (১৪৫), ভারত (১৪২), মিয়ানমার (১৪০), শ্রীলঙ্কা (১২৭), আফগানিস্তান (১২২), নেপাল (১০৬), মালদ্বীপ (৭৯), ভুটান (৬৫)৷ এই ধারবাহিক অবনমনের পেছনে গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের অদৃশ্যমান কঠোর নীতি, দমনমূলক আইন বিশেষ করে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার, সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ ও বেসামরিক এবং রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি দায়ী৷

বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র রাজধানীর চেয়ে রাজধানীর বাইরে বেশি ঘটেছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২১) পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশে এক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং ১৫৪ সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হামলা-মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ নির্যাতিত সাংবাদিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আট জন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীদের দ্বারা ১৪ জন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৩ জন, হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালের ডাকা হরতালে ১৩ জন সাংবাদিক আহত হন৷ এ ছাড়া ১০৬ জন সাংবাদিক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী মহল ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ ২০২১ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিক হয়রানির আরেকটি নতুন সংযোজন হলো সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে সেপ্টেম্বর মাসে ১১ সাংবাদিক নেতার তথ্য চায়৷

২০১৮ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ আইনটি প্রণীত হওয়ার পর থেকে এটি প্রমাণিত যে, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হামলার চেয়ে মামলার শক্তি বেশি৷ আর্টিকেল নাইনটিন ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া ২২৫টি মামলার ঘটনা রেকর্ড করেছে৷ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪১৭ জন ব্যক্তি এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬৮ জন সাংবাদিক৷ এ সময় ১৫ জন সাংবাদিক এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ এ আইনে ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় মারা যান৷ তার মৃত্যু আইনটির ভয়াবহতার কথা আরও একবার মনে করিয়ে দেয়৷ ‘৩০০ টাকা বরাদ্দে রোগী পায় ৭০ টাকার খাবার’- এমন খবর প্রকাশ করে জুলাই মাসে ঠাকুরগাঁওয়ের তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা হয়৷ এমনকি এই মামলায় অসুস্থ সাংবাদিককে হাতে হাতকড়া লাগাতে পিছপা হয়নি পুলিশ৷ আইনটি শুধু নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃতই হচ্ছে না, বরং এটি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে৷ ফলে সাম্প্রতিক সময়ে সেলফ-সেন্সরশিপ শব্দটি বাংলাদেশের সাংবাদিক মহলে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ৷ সম্পাদকেরা সংগত কারণেই জেল বা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঝুঁকি এড়াতে চান৷ ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বছরটিতে ক্রমেই খারাপ হয়েছে৷

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘ কী বলছে?

সেলফ-সেন্সরশিপের কারণে ২০২১ সালটি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের জন্য আস্থার সংকটের বছর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে৷ এ বছর শুধু সরকার ও রাজনৈতিক চাপের কারণেই নয়, বাণিজ্যিক কারণেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে ‘স্টোরি কিলিং’ বা ‘চেপে যাওয়া সাংবাদিকতা’র নজির আমরা দেখেছি৷ এপ্রিল মাসে আলোচিত মুনিয়া মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর একটি বড় অংশের চরিত্র এমনভাবে ফুটে উঠেছিল যেটা পাঠক-দর্শকের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল৷ বাংলাদেশের প্রথম সারির দু'একটি সংবাদপত্রে খবরটি প্রথম পাতায় ছাপা হলেও কোন কোন পত্রিকায় খবরটি প্রকাশ করা হয়েছে বেশ গুরুত্বহীনভাবে ভেতরের পাতায়৷ এ ঘটনায় মুনিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির কথা বলা হলেও বেশিরভাগ গণমাধ্যমে তার নাম প্রকাশ পায়নি৷ সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে৷ এমনকি সাংবাদিকদের মধ্য থেকেও অনেকে এসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ আবার অনেক গণমাধ্যমে অতি উৎসাহী এবং অপসাংবাদিকতার চর্চাও এ ঘটনায় দেখা গেছে৷ একইভাবে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের কভারেজও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ৷

তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, ২০২১ সালে গতানুগতিক ধারায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যবস্থা কর্তৃত্ববাদী ও সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে পরিচালিত হয়েছে৷ বাংলাদেশের মতো দেশগুলো যেখানে কর্তৃত্ববাদী মডেল অনুসৃত হয় সেখানে গণমাধ্যমের মালিকানা ব্যক্তি ও রাষ্ট্র—দুই খাতে থাকে৷ কিন্তু গণমাধ্যমের ভূমিকা হয় একটি, সেটি হলো নাগরিকদের তথ্য জানানো হবে সরকারের প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে এবং সরকার যতটুকু চায় ঠিক ততটুকু তথ্যই দেয়া হয়৷ এর উদ্দেশ্য হলো স্থিতাবস্থা বহাল রাখা৷ আর সোভিয়েত মডেল অনুযায়ী, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ এবং কর্তৃত্ব থাকবে এমন মানুষের হাতে থাকে যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চাওয়া পূরণ করে থাকে৷ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও পুঁজির স্বার্থ দেখাই হচ্ছে এখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাজ৷ ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা বাড়ছে৷ 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের আস্থাহীনতার সংকট গুজব বা ভুয়া তথ্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে৷ কারণ আস্থা আর বিশ্বাসের সংকটে জনগণের সঙ্গে গণমাধ্যমের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে৷ মানুষ মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়ে সামাজিক মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ সামাজিক মাধ্যমের দৌরাত্ম্যে এখন কোনটা সংবাদ বা অপসংবাদ, কোনটা তথ্য বা গুজব— তা অনেক সময় বুঝা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশে কমবেশি প্রতিদিন কোন না কোন ভুয়া তথ্য ভাইরাল হচ্ছে৷ এগুলো যেমন বিশিষ্টজনেরা শেয়ার করছেন তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠিত মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও অনলাইন পোর্টাল সংবাদ হিসেবে প্রকাশ/প্রচার করে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন৷ কারণ তথ্যের যাচাই-বাছাই কিংবা সাংবাদিকতার মৌলিক নীতির চেয়ে জনপছন্দের দিকেই বেশি মনোনিবেশ করছে বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো৷ পাশাপাশি বছরে কয়েকটি ঘটনায় বাংলাদেশের সম্প্রচার সাংবাদিকদের মিস করা ইভেন্টের পুনর্নির্মাণ বা রি-এনাক্টমেন্ট প্রবণতা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের নীতি-নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷ ১৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সচিবালয়ের ক্লিনিকে করোনার টিকা নেয়ার ঘটনার ভিজ্যুয়াল পুননির্মাণ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে টিভি সাংবাদিকতার বিশ্বযোগ্যতা আরও একবার কাঠগড়ায় দাঁড়ায়৷ 

Bdnews-Deutsche Welle Talkshow
মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷ ছবি: bdnews24.com

ডিজিটাল প্লাটফর্মের প্রতি মানুষের অত্যধিক ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা ‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য আর্থিক সংকটকে ঢেকে এনেছে৷ বাংলাদেশের টিভি ও সংবাদপত্রের আয়ের প্রধান উৎস বেসরকারি বিজ্ঞাপন৷ বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পণ্যের বিজ্ঞাপন তাদের চলৎ শক্তির রসদ জোগায়৷ কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, বিশেষত গুগল, ফেসবুক ইত্যাদির প্রসারের ফলে গণমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎসটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বাজারের সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগকারী বহুজাতিক কোম্পানিটি গত তিন মাস ধরে দেশীয় টেলিভিশনে তাদের বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ ফলে সামনের বছরে বাংলাদেশের অনেক টিভি চ্যানেলের পক্ষে স্যাটেলাইট বিল পরিশোধেরও ক্ষমতা থাকবে না৷ এ সংকটে পড়ে অনেক সাংবাদিক চাকরি হারাবেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, অনেকে ঠিকে থাকবে 'হলুদ খাম সাংবাদিকতা’ করে৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে কানাডা টরন্টো স্টার পত্রিকা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যা করেছিল তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে৷ পত্রিকাটি ৪ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রথম পাতা সাদা রেখে ডিজিটাল প্লাটফর্মের কুতুব গুগল ও ফেসবুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের আর্থিক সুরক্ষার জন্য সরকারকে আইন প্রণয়ন করতে চাপ দিয়েছিল৷ নিউজ মিডিয়া কানাডার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতা পুরোটা খালি রেখেছিল টরন্টো স্টারসহ শতাধিক পত্রিকা৷ দেশটির গণমাধ্যমগুলো কোনো ধরনের নতুন তহবিল, আর্থিক সুবিধা বা কর রেয়াত চায়নি, তারা শুধু চেয়েছে তাদের ন্যায্য অংশ পেতে সহায়ক একটি আইনি কাঠামো৷

২০২১ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য সবকিছুই নেতিবাচক ছিল না৷ কিছু কিছু ইতিবাচক দিকও লক্ষ্য করা গেছে৷ মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন চ্যানেলে যেভাবে অপসাংবাদিকতা হয়েছে তা আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিল বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি খুব দুর্বল৷ আগস্ট মাসে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের উচ্চ মানসম্পন্ন পেশাদারিত্বের জন্য একটি ‘নৈতিক আচরণবিধি’ প্রণয়ন নিয়ে উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন৷ পাশাপাশি অননুমোদিত, অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রচার-প্রকাশ বন্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে এবং নিবন্ধনের জন্য বিবেচনাধীন অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে নিবন্ধন দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চান হাইকোর্ট৷ এর পরপরই অপসাংবাদিকতা বন্ধে ভূতুড়ে পত্রিকা, অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল ও আইপি টিভি বন্ধের উদ্যোগ নেয় তথ্য মন্ত্রণালয়৷ পাশাপাশি করোনা মহামারীর ব্যাপক প্রকোপ থেকে গণমাধ্যম শিল্পে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিবাচক প্রচেষ্টা ছিল৷ আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো সাংবাদিক রোজিনার গ্রেপ্তার ইস্যুতে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের চিরায়ত রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে মাঠে নামা, তার পাশে দাঁড়ানো৷ একজন সাংবাদিককে নিগ্রহের বিরুদ্ধে সারাদেশে যেভাবে অভূতপূর্ব প্রতিবাদের স্রোত দেখা গেছে সেটা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে ভাল ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চাহিদা এবং সক্ষমতা দুই-ই প্রবল৷

সাংবাদিকতা সবসময় চ্যালেঞ্জিং, এটাই এই পেশার সৌন্দর্য৷ এই চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য দরকার শিরদাঁড়া সোজা করা সাংবাদিকতা৷ আপোস বা চেপে যাওয়া সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কোন পরিবর্তন আনতে পারে না৷ একটি নিবর্তনমূলক আইন পাশ করা থেকে কিভাবে সরকারকে বিরত করতে হয় তার শিক্ষা অষ্ট্রেলিয়ান সংবাদপত্রগুলোর কাছ থেকে নেয়া যেতে পারে৷ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে সরকার আইন করায় এর বিরুদ্ধে একযোগে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর অভিনব প্রতিবাদ করেছিল অস্ট্রেলিয়ার সব সংবাদপত্র৷ দেশটির সব পত্রিকা তাদের প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদের ওপর মোটা করে কালি ঢেলে তার পাশে ‘সিক্রেট’ লেখা লাল সিল মেরে পত্রিকা প্রকাশ করেছিল৷ এ আন্দোলেনের জন্য সবগুলো পত্রিকা নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যিক বিরোধও ভুলে গিয়েছিল৷ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য ২০২২ হোক এমন একটি অভিনব প্রতিবাদের বছর৷ 'বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম কি চির–অধরাই থেকে যাবে', ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন বাতিল হচ্ছে না’, ‘মালিকদের আরও সাংবাদিক বান্ধব হতে হবে’ ইত্যকার বয়ান অনেক হয়েছে৷ সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক একযোগে প্রতিবাদ বা আন্দোলন করা না হলে ২০২২ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচক ও আর্থিক পরিস্থিতি যদি আরও এক ধাপ বা কয়েক ধাপ পতন হয় তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই৷ সরকার আরও একবার ভাঙ্গা টেপরেকর্ডার বাজিয়ে বলবে, ‘এসব সূচকের বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই'; আর ‘শত ফুল ফুটতে দেয়া’র নামে অজস্র রাজনৈতিক পরগাছা গণমাধ্যমের জন্ম দিয়েই যাবে৷ তাই ২০২২ হোক বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য এমন একটি বছর যে বছরে গণমাধ্যমের শিরোনাম পাঠক-দর্শকের জন্য শিরদণ্ড হবে না; বরং নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার তাগিদে শিরোনামের শিরদাঁড়া একযোগে সোজা করবে৷ ২০২২ হোক সংবাদ বাঁচানোর আন্দোলন, শিরোনাম বাঁচানোর আন্দোলনের বছর৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান